ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীর ঐতিহ্য হালখাতা

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ১৪ এপ্রিল ২০২১

বাঙালীর ঐতিহ্য হালখাতা

নিরবধি কালচেতনায় প্রবহমান সময়ের অলস ধারাকে ধরার চেষ্টা কলসে সাগর ভরার মতো। জীবন যেখানে শুধুমাত্র কিছু মুহূর্তের সমষ্টি, সময় নিত্য প্রবহমান। তবু মানুষ তার বুদ্ধিবলে সময়কেই বন্দী করেছে ফ্রেমে। সেকেন্ড, মিনিট ও ঘণ্টা বাঁধা ঘড়ির কাঁটায় আর দিন, সপ্তাহ, মাস ও বছরের হিসাব দেয়াল পঞ্জিকায়। নিজস্ব সংস্কৃতি ও প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন জাতির নিজ নিজ ক্যালেন্ডার আছে। একইভাবে বাংলা ক্যালেন্ডারের উদ্ভব। বাংলা ‘হাল খাতা’ উৎসবের ইতিহাস কয়েক শতাব্দী প্রাচীন। পহেলা বৈশাখ, নতুন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় বাঙালীর নতুন জীবন। পহেলা বৈশাখ আর হালখাতা যেন অনেকটা যমজ ভাইবোনের মতো। উৎসবপ্রিয় বাঙালীর প্রাণের উৎসব হালখাতা। বাঙালীর অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় হালখাতাই ছিল বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব। সময়, সুযোগ আর পরিবেশ মিলে যোগ-বিয়োগ ঘটে অনেক ঐতিহ্যের। কিছু ঐতিহ্যের শিকড় এত গভীরে যে আধুনিকতার শত ঝাঁপটায়ও টিকে থাকে প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো। বাঙালীর চির ঐতিহ্য এই হালখাতা। সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব পালনে আড়ম্বরতায় ভাটা পড়েছে বটে, তবে তা টিকে আছে স্বমহিমায়। বাংলা নববর্ষে অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবেই আসে ‘হালখাতা’। বাংলা সন চালু হওয়ার পর নববর্ষ উদযাপনে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে হালখাতা দ্বিতীয় বৃহৎ অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেনাদার ও পাওনাদারের মধ্যে বিশ্বাস, আস্থা ও গভীর সম্পর্কের প্রকাশ ঘটত হালখাতার মাধ্যমে। এটা ছিল সৌজন্য প্রকাশের এক ঐতিহ্য। চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব বকেয়া পরিশোধ করা এবং পরবর্তী দিন পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিক ও ব্যবসায়ীরা তাদের প্রজা ও পণ্য ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে নতুন বছরের হিসাব শুরু করতেন। মুঘল আমলে খাজনা আদায় করা হতো হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে। কিন্তু হিজরি বর্ষপঞ্জি চন্দ্র মাসের হিসাবে চলার কারণে এখানে কৃষি খাজনা আদায়ে অসুবিধা হতো। খাজনা আদায়ের শৃঙ্খলা আনা ও প্রজাদের অনুরোধে মুঘল সম্রাট আকবর বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে বাংলা সালের সংস্কার আনার নির্দেশ দেন। তিনি সেই নির্দেশ অনুসারে হিন্দু সৌর ও হিজরি পঞ্জিকা বিশ্লেষণ করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম নির্ধারণ করেন। বাংলা সালের ইতিহাস সুস্পষ্টভাবে জানা না গেলেও অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও প-িত মনে করেন ১৫৫৬ সাল বা ৯৯২ হিজরিতে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সন চালু করেন। আধুনিক গবেষকদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, আকবর সর্বভারতীয় যে ইলাহী সন প্রবর্তন করেছিলেন তার ভিত্তিতেই বাংলায় আকবরের কোন প্রতিনিধি বা মুসলমান সুলতান বা নবাব বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সে জন্য একে ‘সন’ বা ‘সাল’ বলা হয়। ‘সন’ কথাটি আরবি, আর ‘সাল’ হলো ফারসী। প্রথমে এ সালের নাম রাখা হয়েছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা নববর্ষ হিসেবে পরিচিতি পায়। এরপর চৈত্র মাসের শেষ দিনে (সংক্রান্তি) জমিদারি সেরেস্তারা প্রজাদের কাছ থেকে কৃষি ও রাজস্ব কর বা খাজনা আদায় করতেন। এ সময় প্রত্যেক চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাসুল বা কর পরিশোধ করা হতো। এর পরের দিন পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজেদের অঞ্চলের প্রজা বা অধিবাসীদের মিষ্টি, মিষ্টান্ন, পান-সুপারি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। একই ধারাবাহিকতায় ১৬১০ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে ঢাকায় সুবেদার ইসলাম খান চিশতি তার বাসভবনের সামনে প্রজাদের শুভকামনা করে মিষ্টি বিতরণ ও উৎসবের আয়োজন করতেন। খাজনা আদায় ও হিসাব নিকাশের পাশাপাশি চলত মেলা, গান বাজনা ও হালখাতা অনুষ্ঠান। পরবর্তী সময় ব্রিটিশ আমলে ঢাকায় মিটফোর্ডের নলগোলার ভাওয়াল রাজার কাচারিবাড়ি, ফরাশগঞ্জের রূপলাল হাউস, পাটুয়াটুলীর সামনে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে পুণ্যাহ অনুষ্ঠান হতো। তবে রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি ‘হালখাতা মহরত’ থেকেই যে ‘হাল খাতা’ উৎসবের উদ্ভব সে বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই। ‘হাল’ শব্দের অর্থ নতুন সংযোজন এবং খতিয়ান অর্থে ‘খাতা’। পুরান ঢাকায় হিন্দু ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে পাইকারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশ আড়ম্বরে হালখাতা করার প্রবণতা ছিল। এটা বেশ ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালন করা হতো। সারা বছরের লেনদেনের পর পহেলা বৈশাখে হিসাবের খাতাটি হালনাগাদ করা হতো। সেটি ছিল লাল সালু কাপড়ের মলাটে মোড়ানো লাল রঙের একটি খাতা। দুই-তিন ভাঁজ দিয়ে ফিতা দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। সেই খাতায় পুরনো হিসাব চুকিয়ে নতুন হিসাব খোলা হতো। যারা বাকিতে পণ্য নিয়েছিলেন তারা সেই দিন দল বেঁধে এসে বাকি পরিশোধ করতেন এবং নতুন বছরের জন্য অগ্রিম অর্থ দিয়ে যেতেন। হিন্দু ব্যবসায়ীরা পুরনো খাতা বাদ দিয়ে পহেলা বৈশাখে হালখাতা শুরুর আগে নতুন খাতাটি নিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যেতেন। পূজা দিতেন। পূজারিরা সিঁদুরের মধ্যে কাঁচা পয়সা ডুবিয়ে সেই পয়সা সিলমোহরের মতো ব্যবহার করে নতুন খাতায় ছাপ মেরে তা উদ্বোধন করতেন। পয়সাকে লক্ষ্মী হিসেবে বিবেচনা করে ব্যবসায় লাভবান হওয়ার আশায় এই আচার পালন করতেন তারা। তবে বর্তমানে অনেকটাই বদলে গেছে হালখাতার রীতিনীতি। মিষ্টির সঙ্গে এখন নানা রকম আকর্ষণীয় ও রসনাবিলাস ভূরি ভোজের আয়োজন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের হালখাতা আর শহরের হালখাতার মধ্যে একটু ভিন্নতা দেখা যায়। গ্রামের হালখাতাতে ব্যবসায়ীরা বৈশাখের প্রথম দিনে সকালে এসে দোকান পরিষ্কার করে কাগজের ফুল দিয়ে সাজান বর্ণিল সাজে। শহরের ব্যবসায়ীরা হালখাতার দিনে নানা রঙের আলোকসজ্জায় দোকান সাজিয়ে থাকেন। তারা নামকরা অথবা পাশের কোন মিষ্টির দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে রাখেন। নামকরা বাবুর্চি দিয়ে তৈরি করেন পোলাও, বিরিয়ানি, তেহারি, জর্দ্দা, দধিসহ নানা খাদ্যসামগ্রীর। হালখাতার আয়োজক অতিথি অনুযায়ী বিভিন্ন রকমের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন পরিবেশনকারীদের। আবার অনেক জায়গা দেখা যায়, হালখাতায় মিষ্টি মুখ করাতে ব্যবসায়ীরা প্যাকেটের আয়োজন করেন। যাতে মিষ্টি, জিলাপি ও নিমকিসহ বিভিন্ন রকমের প্যাকেজ থাকে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে হালখাতায় সর্বোচ্চ ক্রেতাদের বিভিন্ন উপহারাদি প্রদান করার অঘোষিত রীতি। এছাড়াও এ হালখাতায় র‌্যাফেল ড্র’র মাধ্যমে আকর্ষণীয় পুরস্কার প্রদান ও সাংস্কতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। হালখাতার হাল আগের মতো না থাকলেও চিরায়ত এ অনুষ্ঠানটি কিন্তু হারিয়ে যায়নি এখনও। সর্বজনীন উৎসব হিসেবে ‘হালখাতা’ বাংলা নববর্ষের অন্যতম উপাদান। হালখাতার এই আতিথেয়তায় এক অন্যরকম তৃপ্তি, অন্যরকম স্বাদ, বাঙালীর হাজার বছরের ঐতিহ্য আর সম্প্রীতির প্রতীক। অসাম্প্রদায়িক বাঙালী জীবনে হালখাতা উৎসব হোক সুখকর ও সমৃদ্ধময়। সমস্ত হিংসা ও বিদ্বেষ ফেলে আপন আলোয় আমাদের শুভবোধ, সত্য ও সুন্দর স্বপ্নরা হোক চিরজীবী। লেখক : ব্যাংকার ও সাংস্কৃতিক কর্মী
×