ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ অরূপরতন চৌধুরী

স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই একমাত্র উপায়

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ১১ এপ্রিল ২০২১

স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই একমাত্র উপায়

দেশে এক সপ্তাহের ব্যবধানে করোনাভাইরাসে মৃত্যু বেড়েছে ৭১ শতাংশ। আগের সপ্তাহের তুলনায় ৫৫তম সপ্তাহে শনাক্ত বেড়েছে প্রায় ৬৭ শতাংশ। সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ২১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। করোনার এই নতুন ধরনের সংক্রমণের হার আগের চেয়ে ৭০ ভাগ বেশি আর জটিলতা বেশি ৩০ ভাগ। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, শিশুরাও এখন নিরাপদ নয়। আগে ধারণা করা হয়েছিল, শিশুদের করোনা হওয়ার ঝুঁকি কম, হলেও খুব সামান্য জটিলতা আছে। কিন্তু ইদানীং দেখা গেছে, শিশুরাও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এবারের ঢেউয়ে শিশুরা ব্যাপক সংখ্যক আক্রান্ত হচ্ছে। তাই শিশুদের করোনা থেকে বাঁচতে এখনই সতর্ক হতে হবে। এবার করোনায় প্রচুর সংখ্যক শিশু ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা ও বমি নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। আগে যেমন অনেকেরই গন্ধহীনতার উপসর্গ হতো, এবার তেমনটি দেখা যাচ্ছে কম। বড়দের মতো জ¦র, কাশি, গলাব্যথা তো থাকেই। তবে এবারের করোনায় মাথাব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা, শরীরব্যথার কথা বলছে অনেক শিশু। চোখ লাল হওয়া ও শরীরে র‌্যাশও দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রথম আঘাত শুরু হয়ে অনেকটা শেষ হওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল দেশ এ ভাইরাস থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে। ফলে করোনাভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের সকল পর্যায়ে যেভাবে নতুন নতুন প্রস্তুতি এগিয়ে যাচ্ছিল সেটি একপর্যায়ে থমকে যায়। বর্তমানে সেকেন্ড ওয়েব শুরু হওয়ার পর আবার নতুন করে থমকে যাওয়া সেই প্রয়াসকে এগিয়ে নেয়ার তৎপরতা শুরু হয়েছে। কিন্তু এরই মাঝে প্রতিদিন যে হারে এই ভাইরাসে মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে সেটি রীতিমতো অতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। প্রতিনিয়ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশের চিত্র সকল মহলকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, টিকা নেয়াটা যেমন জরুরী, তেমনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাও এখন জরুরী। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গেছে, করোনার দ্বিতীয় ওয়েভে ঢাকা চট্টগ্রামসহ ৩০ জেলাকে উচ্চহারে সংক্রমিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতোপূর্বে চট্টগ্রামে এ ধরনের সংক্রমণ না ছড়ালেও এখন তা বিপরীত ঘটনা। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন আলাদাভাবে কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। সন্ধ্যা ছয়টার পর সবধরনের দোকানপাট, শপিংমল বন্ধ করার ঘোষণা কার্যকর করেছে। কিন্তু সংক্রমণের হার ও রোগীর সংখ্যা যখন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, তখন মনোযোগ বাড়াতে হবে কোভিড রোগীদের জীবন রক্ষার প্রতি। কোভিড রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ বাড়াতে হবে, পর্যাপ্ত অক্সিজেন, আইসিইউ সেবাসহ চিকিৎসার মান উন্নত করার জন্য বাড়তি উদ্যোগ নিতে হবে, প্রয়োজনে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে । সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ, দায়িত্বশীল ও সুশৃঙ্খল করার উদ্যোগে সরকার সচেষ্ট। সংক্রমণের আরও বৃদ্ধি ঠেকানোর জন্য মাস্ক পরা, নিয়মিত হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার প্রতি সবাইকে আরও মনোযোগী ও দায়িত্বশীল করে তোলার জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি প্রতিটি বেসরকারী ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকেও ভূমিকা আরও জোরদার করতে হবে। পাড়ায় পাড়ায় সচেতনতা কার্যক্রমকে বেগবান করতে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এখন বিরাট ভূমিকা রাখতে পারবেন। প্রতিটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে। যারা ঘরের বাইরে বেশি সময় কাটাচ্ছেন, তারা আক্রান্ত বেশি হচ্ছেন। যুবকদের মধ্যে একটা অবহেলা, উপেক্ষার ভাব রয়েছে। অযথা ঘুরে বেড়ানো আড্ডা দেয়ার কারণে করোনায় আক্রান্ত বেশি হচ্ছে তারা। ফলে হাসপাতালগুলোতে তাদের সংখ্যা বেশি। চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্তের হার ২০ শতাংশের বেশি। আক্রান্তের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সী। শুধু তা-ই নয়, হাসপাতালের শয্যাও যুবকদের দখলে বেশি, প্রায় ৬৫ শতাংশ। স্বাস্থ্যবিধি না মানা, যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো, আড্ডাবাজিসহ নানা কারণে কম বয়সীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে চিকিৎসকরা মনে করেছেন। পাশাপাশি টিকা দেয়ার পর করোনা জয় করার প্রবণতাও কাজ করছে অনেকের মধ্যে। তাদের কারণে ঘরের বয়োবৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। বিষয়টি আতঙ্কের হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই এর থেকে পরিত্রাণের মূল উপায় হিসেবে এ পর্যন্ত চিহ্নিত হয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য, প্রায় ১৭ কোটি মানুষের ছোট্ট এদেশটি বিভিন্ন দিক থেকে সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্যগত বিষয়ে সমস্যা কমতি নেই। এরই মাঝে কোভিড-১৯ এদেশটিতেও আঘাত হেনেছে। করোনার প্রথম ওয়েভ মোটামুটিভাবে সামাল দেয়া গেছে। সরকারী উদ্যোগে দ্রুত ভ্যাকসিন প্রদানের বিষয় প্রশংসিত, যা এখনও অব্যাহতভাবে চলছে। বড়দের মাধ্যমেই শিশুদের করোনা হয়, তাই শিশুদের করোনা থেকে বাঁচতে বড়দের দায়িত্বই বেশি। এ ক্ষেত্রে মা বাবা কিংবা পরিবারের অন্যদের অবশ্যই সামাজিক অনুষ্ঠান, বিনোদনকেন্দ্র এবং যেখানে ভিড় হয় সেসব স্থান এড়িয়ে চলতে হবে। সম্ভব হলে লিফট এড়িয়ে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। কারও সামনে মাস্ক খোলা যাবে না। কর্মক্ষেত্র থেকেই এসে বাচ্চার কাছে যাওয়া যাবে না। আগে কাপড় বদলে ভালভাবে হাত মুখ ধুয়ে, গোসল সেরে শিশুর কাছে যেতে হবে। শিশুদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে শেখাতে হবে। কিভাবে হাঁচি-কাশি দিতে হয়, কিভাবে হাত ধুতে হয়, এসব শেখানো আমাদের দায়িত্ব। আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে করোনার টিকা দেয়া গেলে তাতে অর্থনীতিতে ২ হাজার ৪৮ কোটি ডলার বা পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার আর্থিক সুফল মিলবে। বিশ^ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে হলে টিকা কেনা থেকে শুরু করে সরবরাহের ব্যয়সহ কমপক্ষে খরচ হবে ১১৭ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ খরচ করে বিপুল মানুষের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করা গেলে তাতে অর্থনীতি ব্যাপকভাবে লাভবান হবে, বিশ^ব্যাংকের তৃতীয় হিসাবটিকে বিবেচনায় নিয়ে বলেছে, ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকাদানের আওতায় আনতে বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ১০ শতাংশ এবং পরের বছর দশমিক ২৩ শতাংশ খরচ হবে। ২০২০ ও ২০২১ সালের মধ্যে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়া হলে তাদের মধ্যে একধরনের হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে, যার ব্যপক অর্থনৈতিক সুফল রয়েছে, বিশ^ব্যাংকের হিসেবে যার আর্থিক মূল্য প্রায় ২ হাজার ৪৮ কোটি ডলার বা পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা। মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা- এই তিন হচ্ছে স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল। এ তিন ছাড়া কোন কিছুতেই উপকার হবে না। বাসার বাইরে বের হলেই এগুলো মানা বাধ্যতামূলক। ‘যারা বাসার বাইরে যাচ্ছেন, তারা যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানেন, তাহলে সরকারের বিধিনিষেধ আরোপ করে করোনা সংক্রমণের যে প্রচেষ্টা, তা ভেস্তে যাবে। সেই সঙ্গে আমাদের জীবনব্যবস্থারও পরিবর্তন করতে হবে, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত ৩০ মিঃ ব্যায়াম এবং তামাক বা ধূমপান জাতীয় মাদকদ্রব্যের নেশা থেকে মুক্ত থাকাই এখন সুস্থ থাকার একমাত্র উপায় ও অবলম্বন। লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং শব্দ সৈনিক (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র) [email protected]
×