ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মো. আবু নাছের

নিরাপদ সড়ক ॥ প্রয়োজন সমন্বয় ও সচেতনতা

প্রকাশিত: ২১:০৩, ২২ অক্টোবর ২০২০

নিরাপদ সড়ক ॥ প্রয়োজন সমন্বয় ও সচেতনতা

মুজিববর্ষের শপথ, সড়ক করব নিরাপদ-প্রতিপাদ্য নিয়ে চতুর্থবারের মতো দেশে পালিত হতে যাচ্ছে নিরাপদ সড়ক দিবস। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা সরকারের অগ্রাধিকার। যদিও বিশ^ব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, তথাপি দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে প্রচেষ্টাও চলছে অবিরাম। আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছে সরকার। আশার কথা হলো, নানামুখী প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস এবং অংশীজনদের সহযোগিতায় ইতোমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসছে। যদিও এ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। পাড়ি দিতে হবে সুদীর্ঘ পথ। তবে সরকারের সদিচ্ছা এবং অগ্রাধিকার এ কঠিন পথকে সুগম করবে নিঃসন্দেহে। দুর্ঘটনায় প্রাণ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বিশ্বব্যাপী একটি অন্যতম প্রধান সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জনস্বাস্থ্যগত সমস্যা। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় এক কোটি চল্লিশ লাখ লোক দুর্ঘটনার শিকার হয় এবং এগারো লাখেরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এআরআইর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অর্থোপেডিক হাসপাতালের জরুরী বিভাগের মোট রোগীর শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর শতকরা ষাট ভাগই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, যাদের বয়স ষোলো থেকে পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে। দুর্ঘটনায় শুধু ব্যক্তির জীবনহানিই ঘটে না, বরং পারিবারিক অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয় এবং সমাজ ও রাষ্ট্র তার অবদান থেকে বঞ্চিত হয়। নিরাপদ ও ভ্রমণবান্ধব সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা সরকারের অগ্রাধিকার। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে এবং জাতিসংঘ ঘোষিত ইউএন ডিকেড অব একশন ফর রোড সেফটির আওতায় সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও এর ক্ষতি হ্রাসে আইনগত কাঠামো শক্তিশালী করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কার্যকর করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় আইনগত কাঠামোর সঙ্গে সমন্বয় করে ন্যাশনাল রোড সেফটি স্ট্র্যাটেজিক একশন প্ল্যান বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। প্রতিপালন করা হচ্ছে সড়ক নিরাপত্তায় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নির্দেশনা। নিরাপদ সড়ক বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি, সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদ এবং জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া কাউন্সিল অনুমোদিত একশ’ এগারোটি সুপারিশ বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে কাজ করছে একটি টাস্কফোর্স। বিভিন্ন সময়ে গঠিত কমিটির সুপারিশের আলোকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এসব কর্মসূচীর বাস্তবায়ন তদারকিতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে জাতীয় মনিটরিং কমিটি। এ কমিটি সড়ক নিরাপত্তা ছাড়াও যানবাহনে শিশু ও নারীদের হয়রানি বন্ধেও কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী মহাসড়কের পাশে পণ্যবাহী যানবাহন চালকদের জন্য প্রথম পর্যায়ে চারটি সড়ক-বিশ্রামাগার নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। দুর্ঘটনার জন্য অনেক সময় সড়ক-মহাসড়কের নির্মাণ- ত্রুটিকে দায়ী করা হয়। ত্রুটি অপসারণের পাশাপাশি এআরআইর সহায়তায় দেশব্যাপী বিভিন্ন মহাসড়কে ১৪৪টি দুর্ঘটনাপ্রবণ স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। এরই মাঝে গৃহীত প্রকল্পের আওতায় একশ’ একুশটি স্পটের ঝুঁকি প্রবণতা হ্রাস করা হয়েছে। একসময়ে মরণফাঁদ নামে পরিচিত ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে এখন দুর্ঘটনা নেই বললেই চলে। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে সাইন-সিগনাল ও রোড মার্কিং স্থাপন, বাস-বে নির্মাণসহ হাইওয়ে পুলিশ ও সওজ কর্তৃক চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ স্পট ও করিডরের উন্নয়নে গ্রহণ করা হয়েছে বিশেষ সড়ক নিরাপত্তা উন্নয়ন প্রকল্প। সড়ক নিরাপত্তা বিধানে সড়ক-মহাসড়কের স্থায়িত্বও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়ে সরকার অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে স্থাপন করেছে ওজন স্কেল। দেশব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আরও অধিক সংখ্যক ওজন স্কেল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আধুনিক সড়ক ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে উন্নত বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও চালু করা হয়েছে রোড সেফটি অডিট। এ পর্যন্ত সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতাধীন প্রায় পাঁচশ’ কিলোমিটার মহাসড়কে রোড সেফটি অডিট পরিচালনা করা হয়েছে। বর্তমানে প্রায় তিনশ’ কিলোমিটারে এ অডিট কার্যক্রম চলমান। গবেষণায় দেখা যায়, মহাসড়কের মাঝখানে বিভাজক স্থাপনের ফলে যানবাহনের মুখোমুখী সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে যানবাহনের ক্রমবর্ধমান চাপ বেড়ে যাওয়ায় সরকার মহাসড়কসমূহ পর্যায়ক্রমে চার বা ততোধিক লেনে উন্নীত করার কাজ হাতে নিয়েছে। বিগত এক দশকে প্রায় সাড়ে চারশ’ কিলোমিটার মহাসড়ক চার বা তদুর্ধ লেনে উন্নীত করা হয়েছে, ফলে এসকল মহাসড়কে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতকরণে প্রয়োজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চালক। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে সরকার পেশাজীবী গাড়ি চালকদের প্রশিক্ষণ সুবিধা বাড়িয়ে চলেছে। গাড়ি চালকদের জেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, যা পর্যায়ক্রমে উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হবে। বিগত দুই অর্থবছরে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে প্রায় এক লাখ পঁচাত্তর হাজার পেশাজীবী চালককে সড়ক নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। নারী গাড়িচালক তৈরির সুযোগও বাড়ানো হয়েছে। কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়ায় চালকদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং ড্রাইভিং কম্পিটেন্সি পরীক্ষা কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর লাইসেন্স প্রদান সহজতর করা ছাড়াও আরও পঁচিশটি মোটর ড্রাইভিং স্কুলের রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে মোটরযানের ফিটনেস প্রদানে মিরপুরে স্থাপন করা হয়েছে ভেহিক্যাল ইন্সপেকশন সেন্টার বা ভিআইসি। এ সুবিধা দেশব্যাপী সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গাড়ি চালকদের লাইসেন্স এবং যানবাহন রেজিস্ট্রেশনে জালিয়াতি বন্ধে বায়োমেট্রিক্সসমৃদ্ধ স্মার্টকার্ড ব্যবহার করা হচ্ছে। নম্বরফলকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি সরবরাহ করা হচ্ছে রেট্রোরিফ্লেক্টিভ ট্যাগ। বিআরটিএর পরিবহনবিষয়ক সেবা সহজীকরণ করা হয়েছে। পরিবহন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সেবা অনলাইনে দেয়া হচ্ছে। ঘরে বসে এবং ভোগান্তি ছাড়া সেবা গ্রহণ করছে সেবা গ্রহীতারা। মহাসড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। পরিবহন মালিকদের সহযোগিতায় ইতোমধ্যে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানের অননুমোদিত বাম্পার অপসারণ করা হয়েছে সফলভাবে। সড়ক নিরাপত্তায় পথচারী তথা সড়ক ব্যবহারকারীদের সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাফিক আইন মেনে চলার পাশাপাশি যানবাহন চালানো অবস্থায় সিটবেল্ট বাঁধা এবং চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ফুটওভারব্রিজ ব্যবহারে জনগণকে সচেতন করতে নেয়া হয়েছে বিশেষ কর্মসূচী। বাধ্যতামূলক করা হয়েছে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীর জন্য হেলমেট ব্যবহার। ঢাকা শহর ও দেশের অন্যান্য স্থানে পুরনো ও ত্রুটিপূর্ণ মোটরযান এবং অদক্ষ লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। সচেতনতা তৈরির অংশ হিসেবে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাক-প্রাথমিক থেকে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে প্রকৌশলগত ত্রুটি অপসারণের পাশাপাশি আইনের বাস্তবায়ন এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের সচেতনতা- এ তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এ বাস্তবতায় জনসচেতনতা তৈরিতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহ সমন্বিতভাবে কাজ করছে। একক কোন কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা নয়, সড়ক নিরাপদ করতে সকল অংশীজন এবং সরকারী উদ্যোগসমূহের কার্যকর সমন্বয় জরুরী। আমরা প্রত্যেকেই সড়ক ব্যবহারকারী। তাই আসুন, নিজে সচেতন হই, অপরকে সচেতন করি এবং ট্রাফিক আইন মেনে চলি; তবেই পূরণ হবে আমাদের নিরাপদ সড়কের প্রত্যাশা। নিশ্চিত হবে সড়ক নিরাপত্তা। লেখক : সাংবাদিক
×