ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

হত্যা করে ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে আয়ের উৎস

অরক্ষিত সড়কে সক্রিয় ছিনতাইকারী চক্র

প্রকাশিত: ২১:২০, ২১ অক্টোবর ২০২০

অরক্ষিত সড়কে সক্রিয় ছিনতাইকারী চক্র

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে ॥ একটি মৃত্যু একটি পরিবারের জন্য সারাজীবনের কান্না। তেমনি অভিনব কৌশলে সক্রিয় থাকা ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ছিনতাই চক্রের সদস্যদের নির্মম আঘাতে প্রাণ হারিয়ে পরিবারের জন্য সারাজীবনের কান্না রেখে গেছেন মামুন রাঢ়ী (২৯) নামের এক যুবক। সারাদেশের ন্যায় বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে ইজিবাইক ছিনতাই চক্রের সদস্যরা। প্রায় প্রতিদিনই কখনও যাত্রীবেশে চালককে অজ্ঞান করে কিংবা কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে ইজিবাইক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ চক্রের ২/১ সদস্যকে গ্রেফতার করলেও হোতারা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে বন্ধ হচ্ছেনা ওই চক্রের অপতৎপরতা। এ নিয়ে বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চল ও সারাদেশে ইজিবাইক ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েই চলেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্যেও এ চক্রের সদস্যরা কৌশল পাল্টে প্রতিনিয়ত বের করছে অভিনব কৌশল। আর এসব কৌশলের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন ইজিবাইক চালকরা। ফলে অতি সম্প্রতি ইজিবাইক ছিনতাইয়ের কয়েকটি লোমহর্ষক ঘটনার পর অনেক চালকই ভয়ে তাদের ইজিবাইক বিক্রি করে দিয়েছেন। যে কারণে গ্রামাঞ্চলে ফের বেকারত্বের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। সূত্রমতে, বরিশালের শতকরা ৭০ ভাগ ইজিবাইক চালক শিক্ষিত বেকার যুবক। অভাবের সংসারে তারা চাকরি না পেয়ে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের মুখে আহার তুলে দেয়ার জন্য বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ইজিবাইক ক্রয় করেছেন। প্রতিদিন গড়ে তাদের ছয় থেকে সাতশ’ টাকা আয় হয়। ওই টাকা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের প্রতিদিনের খাবারের জোগান, ব্যাটারি চার্জের জন্য ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক বিলসহ ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হয়। একটি গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বরিশালসহ আশপাশের এলাকার কয়েকটি ইজিবাইক ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটি চক্রে ৮ থেকে ১০ সদস্য রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে তারা ইজিবাইক ছিনতাই করছে। এজন্য ওই চক্রটি ব্যবহার করছে নতুন নতুন কৌশল। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করে আগে থেকেই অবস্থান নেয় চক্রের সদস্যরা। এসব স্থানে কোন গাড়ি কোথায় রাতে চার্জে দেয়া হয়, চালক কিংবা মালিক কে, কোন গাড়ি মধ্যরাত পর্যন্ত চলাচল করে তা অনুসরণ করে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করে চক্রের সদস্যরা। তথ্য সংগ্রহের পর সুযোগ বুঝে চক্রটি ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে। সূত্রে আরও জানা গেছে, এ যাবত বরিশালে যতগুলো ইজিবাইক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশই যাত্রীবেশে মহাসড়কের নির্জন কোন স্থানে চালককে অচেতন করে ফেলে রেখে কিংবা চালককে কুপিয়ে জখম করে ছিনতাই করা হয়েছে। তবে এরমধ্যে ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সবচেয়ে নির্মম ও লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে বরিশালের গৌরনদী উপজেলায়। সূত্রমতে, গত ১৯ আগস্ট রাত ৯টার দিকে গৌরনদীর বাটাজোর বন্দর থেকে নিজের ইজিবাইকে যাত্রী নিয়ে বের হয়ে নিখোঁজ হন উজিরপুর উপজেলার বামরাইল ইউনিয়নের উত্তর মোড়াকাঠি গ্রামের আব্দুছ ছালাম রাঢ়ীর পুত্র মামুন রাঢ়ী। সূত্রমতে, নির্মম এ ঘটনার প্রায় দুইমাস অতিবাহিত হওয়ার পরও থানা পুলিশ এখনও মামুন হত্যার কোন ক্লু উদ্ঘাটন, এমনকি ছিনতাই হওয়া মামুনের ইজিবাইকেরও কোন সন্ধান বের করতে পারেননি। জানা গেছে, সর্বশেষ গত ১৮ অক্টোবর শামীম সরদার নামের এক ইজিবাইক চালককে ছুরিকাঘাত করে রাস্তায় ফেলে রেখে তার ইজিবাইক নিয়ে পালিয়েছে ছিনতাইকারীরা। শামীম সরদার (৪২) জানান, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উজিরপুর উপজেলার ইচলাদী বাসস্ট্যান্ড থেকে করেকজন যাত্রী সানুহার যাওয়ার জন্য তার ইজিবাইকটি ভাড়া করে। পথিমধ্যে একটি প্রাইভেটকার ইজিবাইকের গতিরোধ করে। একপর্যায়ে দেশীয় অস্ত্র ঠেকিয়ে তার (শামীম) চোখ ও হাত বেঁধে তাকে প্রাইভেটকারে তুলে অজ্ঞান করে ফেলে। এ সময় ওই যাত্রীবেশে ছিনতাইকারী চক্রের অপর সদস্যরা ইজিবাইকটি নিয়ে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে তাকে (শামীম) বহনকারী ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত প্রাইভেটকারটি আগৈলঝাড়া উপজেলার বাইপাস রোডের কান্দিরপাড় নামক স্থানে অজ্ঞান অবস্থায় শামীমকে ছুরিকাঘাত করে রাস্তার পাশে ফেলে পালিয়ে যায়। এর আগে একইভাবে গৌরনদীর হরিসেনা এলাকায় এক চালককে অজ্ঞান করে মহাসড়কের পাশে ফেলে রেখে তার ইজিবাইক ছিনতাই করে নেয়া হয়েছে। এভাবে অসংখ্য ইজিবাইক ছিনতাইয়ের ঘটনা রয়েছে। অপরদিকে চাঞ্চল্যকর মামুন হত্যার কয়েকদিন পরেই মহাসড়কের উজিরপুুরের মেজর এম এ জলিল সেতুর কাছে বসে অপর এক ইজিবাইক চালককে মারধর করে ইজিবাইক ছিনতাইকালে এক ছিনতাইকারীকে আটক করে থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। গৌরনদীর গেরাকুল গ্রামের ইজিবাইক চালক বেল্লাল মাতুব্বর জনকণ্ঠকে বলেন, মামুন রাঢ়ীকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনার পর অধিকাংশ ইজিবাইক চালকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। যে কারণে ইতোমধ্যে সে (বেল্লাল) সহ অনেক ইজিবাইক চালক ছিনতাইকারীদের হাত থেকে নিজেদের জীবন রক্ষার জন্য পেশা পরিবর্তন করতে গিয়ে এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। র‌্যাবের গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, চক্রের সদস্যরা কখনও দু’একটি সুটকেস আবার সন্দেহ এড়াতে নারী সদস্যদের নিয়ে স্বামী-স্ত্রী সেজে ইজিবাইকে যাত্রীবেশে ওঠে। চলতি পথে কখনও চালককে কিছু খাইয়ে কিংবা কৌশলে চালককে অজ্ঞান করে গাড়ি নিয়ে যায় চক্রের সদস্যরা। সূত্রমতে, এসব অপরাধীদের শনাক্ত করে আটক করতে র‌্যাব সদস্যরা যথেষ্ট তৎপর রয়েছে। এজন্য র‌্যাবের অনুসন্ধান টিম কাজ করছে। নির্ভরযোগ্য একটি গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ছিনতাই থেকে শুরু করে গাড়ি বিক্রি করা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ হয়ে কাজ করে চক্রের সদস্যরা। ছিনতাইয়ের অধিকাংশ গাড়ি মাদারীপুর শহর ও কালকিনির বিভিন্ন ইজিবাইকের গ্যারেজ ও শরিয়তপুরের জাজিরা এলাকায় বিক্রি করা হয়। সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)’র জেলা সভাপতি শাহ্ সাজেদা বলেন, এক থেকে দেড় লাখ টাকা মূল্যের একটি ইজিবাইকের জন্য একটি প্রাণ কেড়ে নেয়ার বিষয়টি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। অনতিবিলম্বে ইজিবাইক ছিনতাইকারী চক্রের হোতাদের শনাক্ত করে গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার জন্য তিনি প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কাছে জোর দাবি করেন। এ বিষয়ে বরিশালের রেঞ্জ ডিআইজি মোঃ শফিকুল ইসলাম বিপিএম, পিপিএম বলেন, বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়েছে। বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের ইজিবাইক ছিনতাইরোধে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে। এসব চক্রের বিষয়ে গোয়েন্দা নজদারিও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
×