ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

কানাডার কবি প্যাট লোথার

প্রকাশিত: ২১:৪৩, ৯ অক্টোবর ২০২০

কানাডার কবি প্যাট লোথার

কানাডার ষাটের প্রজন্মের কবি প্যাট লোথার (Pat Lowther)) ২৯ জুলাই ১৯৩৫ সালে ভ্যাংকুভারে তাঁর জন্ম। প্রতিভাবান এই কবি সত্তরের দশকের মাঝামাঝি নাগাদ সাহিত্যভুবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছিলেন প্রায়। ঠিক সেই পর্যায়ে, ১৯৭৫ সালে, তার অকাল মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না। তাকে খুন করা হয়েছিল। অসংখ্য কবির মতো প্যাটও নানা রকম বিষয়কে উপজীব্য করেছেন। তবে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাই প্রাধান্য পেয়েছে তার কাব্যে। নিহত হওয়ার তিন বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৮-এ A Stone Diary নামে তার একটি কবিতার বই বেরোয়। Oxford University Press থেকে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থে প্যাট লোথার নিজের সৃষ্টিশীল ভাবুকতার সবটুকু উজাড় করে দিতে পেরেছেন, আমার এমনটাই মনে হয়েছে। অবশ্য প্রথম কাব্যগ্রন্থ This, Difficult Flowering এই যে সক্ষমতা প্রদর্শিত হয়েছিল তাকে কেবল তরুণ কবির সক্ষমতা বললে কিছু কম বলা হয়। ওই বইয়ে যে নিয়ন্ত্রিত কাব্যভাষা এবং চিত্রকল্পনাভাবনার যে রূপ তিনি নিয়ে এসেছিলেন সেটাই পরে, A Stone Diary গ্রন্থে সৃদৃৃঢ় ভিত্তি পায়। এই উত্তরণ ঘটে ছয় বছরের ভেতর। অবশ্য মাঝখানে ১৯৭২ সালে, প্যাটের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ The Age of Bird প্রকাশিত হয়েছিল। কবির বয়সে তখন প্রায় সাঁইত্রিশ। লেখাবাহুল্য, এই বইতেও তিনি যথেষ্ট দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন। এর অনেকগুলো কবিতায় যুক্ত হয়েছে দুটি নতুন বৈশিষ্ট্য-অনিশ্চয়তাবোধ ও নাটকীয়তা। আর পূর্বতন শৈলীকেন্দ্রিক নিরীক্ষা তো ছিলই। This Difficult Flowering-এর আঠাশটি কবিতার ভেতর Two babies in two Years নামে একটি কবিতা আছে। লেখাটির শুরুর দিকে তিনি বলছেন, আমি এখন ভূমধ্য অঞ্চলের ওইসব মহিলার মতো যাদের অনেক বাচ্চাকাচ্চা হয়/ শিশুদের তারা মুখ করে চুমু খায়/ আবেগে-আনন্দে চিৎকার দেয়।’ A Stone Diary কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় লেখক বলেছেন, ‘তোমাকে ভালোবাসি/বা অস্বীকার করি তোমার সবটুকু/যা-ই করিনা কেন আমরা হাতের আঙ্গুলের মতো আলাদা আলাদা। একান্ত ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত কোন কোন কবিতায় খুব সাবলীলভাবে ঢুকে গেছে সহজ দার্শনিকতা। পাঠক, আমি যে মানুষটাকে ভালোবাসি/ সে আছে প্রত্যেক মানুষের ভেতর’ (A man I love/ in every man)- পঙ্ক্তিটা খেয়াল করুন। ১৯৭৪-এ Milk stone নামে প্যাটের আরেকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইয়ের কবিতাগুলো- অনেকগুলোই প্রেমের কবিতা-ভীষণ আবেগী। কিছু লেখায় জড়িয়ে আছে মায়ের স্মৃতি এবং মানবচরিত্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ দিক। লেখকের ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনা থেকে উৎসারিত উচ্চারণসমূহ নতুন অভীক্ষা ও মূল্য নিয়ে হাজির হয়েছিল গরষশMilk stone-এ। This Difficult Flowering, দীর্ঘ কবিতা ঞযব অমব The Age of bird এবং Milk stone বেরোনার পর কাব্যসাহিত্যের বোদ্ধাপণ্ডিত ও আগ্রহ কবিগণ (প্যাট যাদের সাহচর্য পেয়েছিলেন) উত্তরকালে তাৎপর্যপূর্ণ এক লেখকের আবির্ভাবের যে পূর্বাভাস পেয়েছিলেন সেটাই সর্বার্থে বাস্তব হয়ে উঠেছে ১৯৭৭ সালে, A Stone Diary-এর প্রকাশের বছর। কবির মৃত্যুর ছয় বছর পর ক্রিস্টিনা ওয়াইসেনথালের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় The Collcected Poems of Pat Lowther. এতে সঙ্কলিত হয়েছে অসংখ্য প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত কবিতা। প্যাটের বেদনাময় সৃষ্টিশীল জীবন ও মৃত্যুসংক্রান্ত নানা গুঞ্জনের ভেতর দিয়ে অতিবাহিত হয় অনেকগুলো বছর। ততদিনে সন্তানদের মনেও মায়ের হত্যা ও বাবার মৃত্যুর শোক থিতিয়ে আসে। একদিন চিলেকোঠায় বেথ লোথার (কবির মেয়ে) কর্তৃক আবিষ্কৃত হয় একটি ট্রাঙ্ক। ওই ট্রাঙ্কেই প্রকাশিত-অপ্রকাশিতা অনেক কবতার ভিড়ে লুকিয়ে ছিল একটি পান্ডুলিপি। বেথের উদ্যোগেই তা গ্রন্থের আকার লাভ করে ১৯৯৭ সালে। নতুন এই বইয়ের নাম ‘Time Capsule : New and Selceted Poems : প্যাটের রচনা সমগ্র Collcected works of pat Lowther-এর প্রকাশ সাল ২০১০। প্যাট লোথারের জীবনীকার টোবি ব্রুকসরচিত Pat Lowthers Contiment : Life and works থেকে জানা যায়, এই কবির জীবন ছিল সংগ্রামী, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। দেখতে পাই, তিনি ষোলো বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই পড়ালেখা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এবং তাকে উপার্জন করতে হয়। প্রথম বিয়েটা করেন আঠারো বছর বয়সে। পরের বছরেই মা হন। পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে তার আরেকটি সন্তান আসে। যখন বিবাহ বিচ্ছেদ হলো তখন তার বয়স চব্বিশ। বছর চারেক নিঃসঙ্গ কাটানোর পর প্যাট বিয়ে করেন রয় লোথারকে। ষাটের দশকের শেষ দিকেই তিনি প্রথম কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছিলেন তার বলিষ্ঠ আগমন বার্তা। ১৯৭২/৭৩ নাগাদ খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। প্রতিনিধিত্বকারী কবিতাসঙ্কলন গ্রন্থসমূহ তার লেখা স্থান পেতে থাকে। একাধিক Crealive writing course-এ এবং কবিতাসংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি। এভাবে কাব্যপ্রেমী পাঠক ও লেখক সমাজে তার প্রশংসনীয় পরিচিতি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন নিতান্ত অসুখী। দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গেও বনিবনা হয়নি। সাংসারিক অশান্তিতে ইন্ধন জুগিয়েছে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। সব মিলিয়ে একটা অসহনীয় বিচ্ছিরি অবস্থা। এ রকম পরিস্থিতিতেও, যদিও বন্ধুরা কেউ কেউ বিবাহবিচ্ছেদের পরামর্শ দিয়েছিল, প্যাট ওই পথে পা বাড়াননি। কেন বাড়াননি সে এক অতল রহস্য। রয় লোথার নিজেও ছিলেন কবি, তবে প্যাটের মতো অতটা ক্ষমতাবান ছিল না তার কলম। তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। আবার ওই দ্বৈত জীবন নিরঙ্কুশ অসুখী ছিল তাও বলা চলে না। সুখের দিনগুলোয় প্যাট অনেক কিছু নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি রয়ের সঙ্গে কবিতা ও রাজনীতির মতো গুরুতর বিষয়ে নিয়েও আলাপ করতেন। এ থেকে আমরা তার বুদ্ধিৃবৃত্তিক স্তর সম্বন্ধেও ইতিবাচক ধারণা নিতে পারি। এ বড়ই আপসোসের বিষয়, ওই কবি স্বামীর হাতেই তার মৃত্যু ঘটে। ১৯৭৫-এর সেপ্টেম্বরে নিখোঁজ হওয়ার তিন সপ্তাহ পর প্যাট লোথারের মৃতদেহ পাওয়া যায় ফারি ক্রিক নামক জায়গায়। হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল। স্ত্রী হত্যার দায়ে রয় লোথারকে কারাবরণ করতে হয় অনেক বছরের জন্য। ১৯৮৫ সালে তার মৃত্যু হয় ওই কারাগারেই। সমস্ত প্রতিকূলতার ভেতরেও প্যাট লোথার কার্বচর্চা করে গেছেন। দাঁড়িয়েছেন সমাজের অন্যায়- বিচারের বিরুদ্ধে। তার কাব্য, তাই, কখনও কখনও হয়ে উঠেছে প্রতিরোধের শব্দশিল্প। তার সংক্ষুব্ধ মনের প্রতিক্রিয়া বাণীরূপ নিয়েছে এভাবে-‘রাঘব বোয়ালদের জিভ আটকে যাক/তাদের চেয়ালের মাঝখানে,/বেনিয়াদের উপার্জনের হাত/হয়ে যাক অবশ’...Milk stone-এর এক জায়গায় লেখক বলছেন, ‘তুমি কি জানো/পাথরকে আলিঙ্গন করা কতটা মধুর/এবং তোমার দেহকে বাঁকা করে নেয়া/তার বাইরের চেহারার বিপরীতে?’ একদা, The Age of Bird কাব্যগ্রন্থে ধরা দিয়েছিল কবির প্রগাঢ় রাজনীতিমনস্কতা আর পাবলো নেরুদার কাব্যবিশ্বাসের প্রতি তার অনুরাগ। সমাজের নানা অসঙ্গতিবোধক ওই চেতনা ও মমত্ববোধ পরবর্তীকালেও অনেক কবিতায় দেখা যায়। দেখুন তার প্রকাশভঙ্গি-‘কেউ একজন নির্ধারণ করে দেবে/কারা খেতে পাবে/কারা পাবে না/আর কাদেরকে পেটানো হবে/কোথায়, শরীরের কোন্ কোন্ জায়গায়।’ অনুবাদ এমন বস্তু যে তা, যত ভালই হোক, মূল রচনার স্বাদ দিতে পারবে না। সে জন্য প্যাটের শব্দপ্রয়োগ এবং বলার ধরন বোঝানোর উদ্দেশ্যেই মূল থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি তুলে দিচ্ছি। এগুলো Milk stone কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত- I Shall surprise you a sleep/and hold you/through all your change/till you make me/pregnant with the world. কানাডার বিশ্বখ্যাত ঔপন্যাসিক ও কবি মার্গারেট অ্যাটউড তার গদ্যগ্রন্থ Second Words--এ প্যাট লোথারকে নিয়ে যে প্রবন্ধ লিখেছেন সেখানে বলা হয়েছে, Lowther’s death is specially sad becasue she was obviously coming into her own. Techniques mastered, vision clarifying, she was on the verge of writing more deeply and with greater range than she had ever done. সত্যিই তো, এমন বেদনাবিধুর মৃত্যু, বিশেষত কবি-শিল্পীদের ক্ষেত্রে, বিরল ঘটনা। এর ফলে কেবল প্যাটের বিড়ম্বিত পরিবার ও বন্ধু-স্বজনরাই নয় কানাডার আধুনিক সাহিত্যও অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সমালোচক হিলডাথমাস- যে মন্তব্য করেছিলেন- Pat Lowthers death robbed canadian poetry of one of its most vital and visionary poets-তা খুবই যথার্থ।
×