ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

চেতনার শুদ্ধতম শিল্পী

প্রকাশিত: ২১:২৬, ৯ অক্টোবর ২০২০

চেতনার শুদ্ধতম শিল্পী

তিনটা কারণে এসএম সুলতান এযুগের অন্যতম শুদ্ধতম শিল্পী হিসাবে বিবেচ্য। প্রথমত: তিনি চেতনার সঙ্কট ও দর্শনকে চিত্রায়িত করেছেন। দ্বিতীয়ত: ভারতীয় চিত্রশিল্প ও আধুনিক চিত্র রীতিতে সমন্বয় এনেছেন এবং তৃতীয়ত: তিনি শ্রমজীবী মানুষের স্বপক্ষে কথা বলেছেন। সমগ্র ভারতীয় চিত্র শিল্পের ইতিহাস তিনি অনুসন্ধান করেছেন পরিশ্রমী দৃষ্টিতে। যুগপৎভাবে উৎসাহী হয়েছেন ইউরোপীয় চিত্রকলার আধুনিক প্রকৌশল নিয়ে। আদিম সভ্যতা, সভ্যতার বিকাশ, শক্তির উৎস এবং বাংলাদেশের প্রকৃতির চিত্রকল্প হয়েছে তার শিল্পের প্রেক্ষাপট। এসএম সুলতানের ছবিতে মানুষ ও মানুষের সৌকর্যময় পেশী এসেছে প্রকটভাবে। চমকপ্রদ ফিগার ও রঙের বিচিত্র প্রক্ষেপণ নতুন এক ডাইমেনশন এনেছেন। পিকাসোর সঙ্গে এখানেই যেন এসএম সুলতানের মিল। এসএম সুলতানের তুলির সংঘাতময় টান ও কারুকাজ ক্ষুব্ধ শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যানগগকে মনে করিয়ে দেয়। এসএম সুলতান কখনও যেন পিকাসো কখনও ভ্যানগগ। কখনও সে এ দুজনের চেয়ে অনেক বড়। ভাস্কর শিল্পী হেনরি মুর তাঁর ভিন্ন ধাঁচের ভাস্কর্যে একটা ব্যাপৃত যুগকে ধারণ করে রেখেছেন। এই শিল্পের বিকাশমান ধারায় তিনি চৌকস। রাম কিংকরের ভাস্কর্যও আমরা প্রকৃতিকে দেখি। বক্তব্য প্রকাশে সাহসিকতা, শক্তিশালী হাত ও মেধা পরিস্ফুট হয়েছে তাদের শিল্প মাধ্যমে। এসএম সুলতান তাঁর শিল্প মাধ্যম নিয়ে সচেতন। স্পষ্ট প্রেক্ষিত ও প্রক্ষেপণ তাঁর চিত্রে বিকাশমান নান্দনিক সৌকর্যে। আদিম মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে বিকাশ ঘটেছে চিত্রশিল্পের। প্রস্তর যুগের প্রথম ভাগে অর্থাৎ পুরনো প্রস্তর যুগে (আজ থেকে প্রায় ২৫-৩০ হাজার বছর পূর্বে) মানুষ ছবি আঁকতে শুরু করে । পুরনো প্রস্তর যুগের পর আসে নতুন প্রস্তর যুগ। এ সময়ের ছবির বক্তব্য ও বৈশিষ্ট্যে বিবর্তন আসে। নতুন প্রস্তর যুগের ম্যামথ, লোমওয়ালা হাতি- এই গুহাচিত্রগুলো উল্লেখ করার মতো। গুহামানবেরা চর্বি, রক্ত ও মাটি থেকে রং বানিয়ে ডালের তুলি দিয়ে ছবি আঁকতো। নব্য প্রস্তর যুগের ছবি ছিল উঁচু মানের। কিন্তু ছবির আকৃতিটা আয়তনের দিক থেকে ছোট হয়ে আসে। সিন্ধু সভ্যতা, বালুস্তানের পাহাড়ী গ্রাম মহেঞ্জোদারো, পাঞ্জাবের হরপ্পা, গুজরাটের লোথালে আদিম চিত্র কলার নিদর্শন রয়েছে। মধ্য যুগে চিত্রকলার বিকাশ ঘটে ভিন্ন ধারায। পাল শাসনকালে এই ধারার সৃষ্টি হয়। অজন্তার গুহাচিত্রে জাতকের পৌরাণিক গল্প ও দেব-দেবীর যুদ্ধের নমুনা রয়েছে। পশ্চিম ভারতের এলুয়া গুহা, দক্ষিণ ভারতের সিত্তম-ভাসাল গুহা- এগুলো এই সময়কালের চিত্রকলা। জৈন তীর্থকারী ও পৌরাণিক দৃশ্যাবলী রয়েছে এখানে। মুঘল সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটে বাবরের হাতে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে। তখন শুরু হলো ভারতীয় চিত্রশিল্পের অন্যতম একটি যুগের। কামালুদ্দিন, আব্দুস সামাদ, মীর সৈয়দ আলীÑ এরা ছিলেন এ সময়ের চিত্রকর। এরা প্রকৃতি ও রাজদরবারের বিভিন্ন ঘটনাকে ভিত্তি করে ছবি আঁকতেন। জাহাঙ্গীরের সময়েও এই ধারা অব্যাহত থাকে। দশবন্ত, কেসু, মনসুর, মনোহর ছিলেন এই সময়ের শিল্পী। এদের চিত্র শিল্পে পারসিক চিত্রধারায় স্পষ্ট ছাপ ছিল। কখনও বা এই ধারায় সঙ্গে দেশী ধারার মিলন ঘটেছে। মুঘল শাসনের শেষ ভাগে ভারতীয় চিত্রশিল্পে ইউরোপীয় চিত্র শিল্পের ছোঁয়া লাগে। মুঘল ও রাজস্থানীয় শিল্পীরা হিমালয়ের ছোট ছোট রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় মুঘল ও দেশীয় চিত্রকলার মিশ্রণে নতুন একটা ধারার বিকাশ ঘটতে দেখা যায়। ১৫ দশ শতাব্দীতে ইউরোপের শিল্পকলায় নতুন ধারার সৃষ্টি হয়। ফ্রা এঞ্জেলিক বেনো- গৎমোলি, লিপ্পি গিয়েভিন্নি ছিলেন এ সময়ের শ্রেষ্ঠ শিল্পী। ১৬ দশ, শতাব্দীতে এসেছিলেন লিউনার্দ দ্য ভিঞ্চি, রাফায়েল, মাইকেল এঞ্জেলো প্রমুখ। ১৭ শতাব্দীতে আসে পুস্যা, লরেন, রুবেন্স। ১৯ শতকের শেষ কিংবা বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই আধুনিক চিত্র শিল্পের উত্তরণ ঘটে। বিষয় নির্বাচন, নতুন ধারা সৃষ্টি এবং রং প্রক্ষেপণ, আলোছায়া- ইত্যাদিতে বিকশিত হয় চিত্র শিল্প নতুন আঙ্গিকে। এ সময়ের শিল্পীরা হলেন পিয়ের জেনার্দ জুলার্দ মাতিস, পিকাসো, মার্ক শ্যাগাল প্রমুখ। এদের কিছু আগে এসেছিলেন অন্য একজন শক্তিমান শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যানগগ। এদিকে মধ্যযুগের শেষে মুঘল ও স্থানীয় শিল্পীরা চিত্রকলার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে থাকেন। স্থানীয় শিল্পীরা ‘পটুয়া’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এরা পূজার সময় পট তৈরি ও রং করতে বলে এদেরকে পটুয়া বলা হতো। এরা ছিলেন অনগ্রসর শিল্পীগোষ্ঠী। পটুয়ারা ছিলেন হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। ১৮০০ এর প্রথম দিকে তখনও তেল রং, জল রং এ ছবি আঁকা শুরু হয়নি। এদেশে তখন ইউরোপ থেকে চিত্রকর আসতে শুরু করে। এদের সংস্পর্শে এসে স্থানীয় শিল্পীরা শিল্পের বিভিন্ন শাখার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এ সময় ল্যান্ডস্কেপ আঁকা শুরু হলো। তিসির তেল দিয়ে রং তৈরি হতো। ১৮৩৯ থেকে ইংল্যান্ড হতে এদেশে যে শিল্পীরা আসেন তাদের মধ্যে ছিলেন টি ভি কিলি, ডব্লিউ হজেস, জোকবী ডানিয়েল এডওয়ার্ড প্রমুখ। ত্রিবাঙ্কুরের রাজা রবিশক্ষমা ভেনিসের কাছে তেল রং শিখেন। এই সময়ের আর একজন বিখ্যাত পেইন্টার হলেন শশী কুমার। ইউরোপে উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে শিল্পকলার সনাতন রীতি ভেঙে নতুন শিল্প রীতির উত্থান ঘটে। সে সমস্ত শিল্পীরা হলো রসঢ়ৎবংংরড়হরংঃ যারা জীবনের প্রতিচ্ছবি আঁকেননি, এঁকেছেন মানুষ, আলো, আকাশ, বস্তু, বা প্রকৃতি দিয়ে নিজের কল্পনায়। ১৮৬০ সালের প্রথম দিকে চারজন শিল্পী ক্লডে মনেট, পিয়েরে-আগস্টে রেনোয়ের, আলফ্রেড সিসলি এবং ফ্রেডেরিক বাজিল একসঙ্গে তারা একাডেমিক শিল্পী চার্লস গ্লেইরির ছবি নিয়ে স্টাডি করছিলেন। তারা ঠিক করল ইতিহাস বা মিথোলজির উপর ভিত্তি করে ছবি আঁকবে না। তারা আঁকবেন প্রকৃতি ও সমকালীন জীবন নিয়ে। পোস্ট ইম্প্রেশনিজম নিয়ে শিল্পীরা তখন ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। চিত্র শিল্পের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ১৮৮৭ তে জন্ম নেন মার্ক শ্যাগাল, পিকাসোর চেয়ে ছয় বছরের ছোট তিনি। আর মার্ক শ্যাগালের জন্মের ৩৩ বছর পর জন্ম হয় এসএম সুলতানের যখন চলছিল আধুনিক চারুকলার বিকাশ ও বিভিন্ন আঙ্গিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ১৮৬৪ তে কলকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বাইতে আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার পর ভারতীয় চিত্র শিল্পের নতুন প্রকরণ শুরু হয়। ১৮৯৬ তে এ বি হ্যাভেল অবনীন্দ্রনাথকে নিয়ে এলেন কলকাতা আর্ট কলেজে। হ্যাভেল তখন অধ্যক্ষ। অবনীন্দ্র জাপানী শিক্ষক তয়াকুবার কাছ থেকে চিত্রাঙ্কনের জাপানী রীতি শিখেছিলেন। এর ফলে ভারতীয় চিত্রশিল্পের মুঘল, রাজস্থানিয় পটুয়া, ইউরোপীয় এই বিভিন্ন ধারার সঙ্গে নতুন একটা রীতির সমন্বয় ঘটে। এটাকে বলা হলো ভারতীয় চিত্রশিল্প বা ‘ওরিয়েন্টাল আর্ট’। কলকাতা আর্ট কলেজ তখন এই ধারার ধারক ছিল। অবনীন্দ্রনাথ ‘শাহজাহানের শেষ শয্যা’ এঁকেছিলেন। তার ছাত্র ছিলেন নন্দলাল বসু, অসিত হালদার, সারদা, চরণ ক্ষীতিন্দ্রকুমার, দেবীপ্রসাদ প্রমুখ। যামিনী গঙ্গোপাধ্যায় যখন ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন আর্ট কলেজের তখন তার ছাত্র ছিলেন যামিনী রায়, অতুল বসু। এদের মধ্যে যামিনী রায় বেশি নাম করেছিলেন। প্রফেসর শাহেদ সোহরাওয়ার্দী একটি নিবন্ধে তার চিত্রকর্মের আলোচনা করেছিলেন । অমৃতা সারগীল ভারতীয় আধুনিক চিত্রশিল্পের একজন শক্তিশালী শিল্পী ছিলেন। এরপর যাদের নাম। আসে তাদের মধ্যে জয়নুল আবেদীন, ফিদা হুসেন, সতীশ গুজরান, রাম কিংকর কালকিনি, কামরুল হাসান ও এস এম সুলতান উল্লেখযোগ্য। জয়নুল আবেদীনের চিত্রকর্ম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। নতুন বা আদি প্রস্তর যুগের শিল্পীরা দেয়ালচিত্রে মানুষের সংগ্রাম মুখর দিনকে চিত্রায়িত করেছিলেন। যেমন- ম্যামথ, হাতীদের বিরুদ্ধে আদিম মানুষের যুদ্ধ। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ফলে জীবনমুখী শিল্প খুব বেশি সংগঠিত হয়নি, এমন কি কলকাতায় আট কলেজ প্রতিষ্ঠানের পরও। মধ্যযুগের চিত্রশিল্পে পৌরাণিক কাহিনী প্রকট হয়েছে । শিল্পীরা রাজদরবারে উঠে এসেছেন, ফলে শিল্প থেকে বিচ্ছিন্ন হয় মানুষের জীবন-যাপন। জয়নুল আবেদীন চিত্র শিল্পে ভিন্ন ধারা নিয়ে এলেন যা তাঁর উত্তরসূরিদের চেয়ে ভিন্নতর। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে তিনি মানুষ ও নৈসর্গিক ছবি এঁকেছেন। এঁকেছেন দুর্ভিক্ষ-ক্লিষ্ট মানুষের ছবি। এভাবে তিনি চারুকলাকে সামন্ততান্ত্রিক কব্জা থেকে মুক্ত করে প্রথম মানুষের কাছে নিয়ে এলেন। জয়নুল আবেদীনের চিত্রে দর্শন ও অস্তিত্ব চেতনার যে অভাব প্রকট হয়েছিল। তা স্বকীয় ধারায় প্রোজ্জ্বল করলেন এসএম সুলতান। তিনি নিবিড় করে মাটির উপর আস্তানা গড়লেন। মাটি থেকে রস নিলেন। এদেশের মানুষের শোষণ, নির্যাতন ও প্রতিবাদের ধারাকে তিনি প্রথম সাহসের সঙ্গে তুলে ধরলেন। এখানে তার কোন আপোসকামিতা বা পিছুহটা নেই। এসএম সুলতান কলকাতায় এসে নগর কেন্দ্রিক জীবনের সঙ্গে পরিচিত হন। এই সময় বিখ্যাত কবি ও চিত্র সমালোচক হাসান শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সাহচর্যে আসেন। তিনি তাকে কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। একাডেমিক শিক্ষা শেষ না করেই এসএম সুলতান প্রথম বের হলেন- ভারতে, তারপর পাকিস্তানে। তিনি তাজমহল দেখলেন অনুভূতি দিয়ে। পুরনো পুরুষদের ওই ঐতিহ্য দেখলেন। সিমলাতে ১৯৪৬ এ তার প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয়। ১৯৪৮ এ হয় লাহোর। ১৯৪৯ সালে আরও একটি একক চিত্র প্রদর্শনী করলেন পাকিস্তানে। এর পর এলেন আমেরিকায়। নিউইয়র্কের ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন (ওওঊ) একটি আন্তর্জাতিক আর্টস প্রোগ্রাম ছিল যেখানে পাকিস্তান থেকে তরুণ ও প্রতিভাবান শিল্পী হিসাবে এসএম সুলতান অংশগ্রহণের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। এই প্রোগ্রামের মধ্যমে তিনি ১৯৫০ সালের গোঁড়ার দিকে আমেরিকাতে যাদুঘর পরিদর্শন, স্কুলে সৃজনশীল কাজ বা অধ্যয়ন ও আমেরিকান শীর্ষস্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে পরামর্শ এবং নিজের কাজ প্রদর্শনের সুযোগ পেয়েছিলেন। একই বছর প্রদর্শনী হয় লন্ডনে বিখ্যাত কনটেমপোয়ারি আর্ট মিউজিয়ামে। এটি পিকাসো, দালী, ক্লী প্রমুখ শিল্পীদের সঙ্গে যৌথভাবে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৩ সালে নড়াইলে ফিরে আসেন এস এম সুলতান। বাড়ির পাশে চিত্রা নদীর মনোরম দৃশ্যাবলী তাকে নতুন করে টানলো। জমিদার বাড়ির ঘাটে বসে স্মৃতি রোমন্থন করতেন। তার পিতা ছিলেন উঁচুদরের রাজ মিস্ত্রি। জমিদার বাড়িতে তার বাবার বেশ কদর ছিল। এস এম সুলতান বাবাকে তার কাজে সহযোগিতা করতেন। দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর পর ১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে এসএম সুলতানের চিত্র প্রদর্শনী হয় ঢাকাতে। এর ১১ বছর পর সর্বশেষ চিত্র প্রদর্শনী হয় জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ঢাকার উদ্যোগে। একুশে পদক পেয়েছেন তিনি, জাতীয় শিল্পী হিসাবে মনোনীত হয়েছেন। ১৯৮২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রকাশিত একটা বিশ্বকোষে তাঁকে শ্রেষ্ঠ কৃতী মানুষ হিসেবে সম্মান দেয়া হয়েছে। এশিয়া মহাদেশের তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই সম্মান পেলেন। এসএম সুলতানের চিত্রকলায় ক্লাসিজম ও রোমান্টিজম দুটি শিল্প মানানসই-ভাবে উপস্থিত। ফার্স্ট প্ল্যানটেশন, চর দখল, মুক্তিযুদ্ধ এসবে তিনি সুস্পষ্ট চিন্তা ও দর্শনকে তুলে ধরেছেন যা ছিল সহস্র বছরের সরল পরিণতি। ফার্স্ট প্ল্যানটেশন এ তিনি একজন বলিষ্ঠ পেশল মানুষকে মানুষকে এঁকেছেন। তার হাতে চারা বটবৃক্ষ। উপরে অপ্সরীগণ। শিল্পী আদিম মানবের শক্তিকে ছোট করেননি। তিনি মনে করেন এ ভূখ-ের কৃষকেরা মূলত এমন শক্তি পেশিতে ধারণ করে যে শক্তি ওই আদিম পুরুষরা ধারণ করতো। জেটিকলের মতো সেই পেশিশক্তি জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। একটা সুদূরপ্রসারী বৃক্ষের রোপণ সত্যিই তাৎপর্যপূর্ণ। শিল্পের মাধ্যমে এই চিরন্তন বৈজ্ঞানিক দর্শনকে সার্থকভাবে তুলে ধরতে একমাত্র তিনিই পেরেছেন। শিল্পী যখন জীবন ও জগতের দর্শন চিন্তাকে নিয়ম ও প্রক্রিয়ার মধ্যে পর্যবেক্ষণ করে তখন সেটা ক্লাসিক্যাল। এরপর স্বকীয় মেধা ও দ্রোহের বিন্যাসে বিচিত্র রং প্রকৌশলের মাধ্যমে যখন সেটা প্রকাশ করলেন ক্যানভাসে তখনই রোমান্টিক। সরল ও পেশল মানুষের আদিম অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ‘চর দখল’ এর জন্য যুদ্ধে যাওয়া কিংবা স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশজ অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করা- এই চিত্র চিত্রণের মধ্যে ও ঐ দুটি শিল্প মানস স্বয়ংক্রিয়। এসএম সুলতানের ছবিতে বহমান বাংলার নিসর্গ এসেছে। নদীতে মেয়েদের গোসল করতে আসা, ফেরিওয়ালাদের নৌকায় করে চুড়ি বিক্রি করা কিংবা রান্না ঘরে মেয়েদের মাছ কাটা- এসব ছবিতে মানুষের ফিগার অংকনে অনেক বেশি সাফল্য ও পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। আদিম সভ্যতায় পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকাকে উল্লেখ করেছেন তিনি। মেয়েদের বাহুকে পেশল করা নিছক শিল্প সৃষ্টি নয়। সভ্যতার প্রক্রিয়াকে আবার বুঝিয়ে বলা মাত্র। জীবনে একটা নিকটতম শিল্প চিত্রকলা। চিত্রকলার মৌলিক রং মূলত চারটি অন্যান্যগুলো যৌগিক। কিন্তু বড় সুবিধে হলো- আর্টের ভাষা সার্বজনীন। তাকে অনুবাদের গ-ি পার হতে হয় না বার বার এক জনগোষ্ঠী থেকে অন্য জনগোষ্ঠীতে যাবার সময়। সাহিত্যের ভাষা সার্বজনীন নয়। তাই একটা চারুকর্ম পৃথিবীর সমস্ত শিল্প রসিক মানুষের কাছে সমান বক্তব্য তুলে ধরে। জীবন নিয়ত একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবহমান। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ তাকে আজকের জায়গায় অনেক দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এমএস সুলতানের ছবিতে সময়ের নিশ্চিত প্রক্রিয়া রয়েছে যা কোন ভূখ-ের ঐতিহ্যের ফসল। এই প্রেক্ষাপটে তার সৃষ্টি নৈর্ব্যক্তিক। আবার চিন্তা তার মননে ঘনীভূত হয়ে মেধার মাধ্যমে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। রং এর প্রক্ষেপণ কৌশলে প্রোজ্জ্বল হয়েছে চিত্রপটে। তাই বলা যায় ব্যক্তির সৃষ্টি তার চিত্রকল্পও ব্যক্তিক বটে। এসএম সুলতান নিজ হাতে দেশজ উপাদান থেকে রং তৈরি করেন তারপিন তেলের সাহায্যে। নিজ হাতে ক্যানভাস তৈরই করেন পটুয়াদের মতো, কিন্তু তিনি পটুয়া নন। পটুয়াদের অনগ্রসরতাকে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন। একাডেমিক শিক্ষা পেয়েছেন তিনি। ইউরোপীয় আর্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছেন ব্যাপকভাবে। তবু বিমূর্ত শিল্প নিয়ে মেতে ওঠেননি। সভ্যতা ও মানুষের অস্তিত্বের সঙ্কটকে দেশীয় পটভূমিতে তুলে ধরেও তিনি আন্তর্জাতিক। এসএম সুলতানের সৃষ্ট ফর্মের স্থির বিশুদ্ধতা, পেশল ও শক্তিমন্ত ফিগার, রং এর সুষম বিন্যাস-কৌশল ও জীবনের চিরন্তন ব্যাখ্যা তাকে তার সমসাময়িকদের থেকে স্বতন্ত্র মহিমায় প্রোজ্জ্বল করেছে। তিনি আধুনিক চিত্রকলার একজন শক্তিমান পথিকৃৎ প্রধান শিল্পী। বক্তব্য নির্মাণ ও শৈলীর ব্যাপারে তিনি নতুন ডাইমেনশন এনেছেন এতে কোন সন্দেহ নেই। শিল্প সৃষ্টিতে তিনি অনেক বেশি সচেতন ও আন্তরিক। এসএম সুলতান তার অবচেতন মনে যা অনেক দিন ধরে লালন করেছেন সেটা নান্দনিক সৌন্দর্যে সুষমাময় করে প্রকাশ করেছেন বলেই তাঁর সৃষ্টি মাস্টারপিস হয়ে উঠেছে। বস্তুক শিল্পকর্মের মধ্যে যেমন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও সভ্যতার চিত্র তুলে ধরা যায়, তেমনি নির্বস্তুক চিত্রকল্পেও সম্ভব। সমস্তটাই নির্ভর করে শিল্পীর শিল্পরীতির উপর। আমিনুল ইসলামের ‘পরিবর্তন’ সিরিজ কিংবা মুর্তজা বশীরের ‘দেয়াল’ নির্বস্তক ঢং এ আঁকা বলেও তাতে সমাজ চিত্র এসেছে। সমাজ চিত্র এসেছে শাহাবুদ্দিন আহমেদের ছবিতে। মূলত কোন চিত্রই নির্বস্তুক নয়। আর শিল্পী হচ্ছেন একজন প্রযুক্তিবিদ। তারা মূলত একাডেমি থেকে প্রযুক্তিবিদ হিসাবে বের হন, এদের মধ্যে শিল্পী হতে পারেন খুবই কমসংখ্যক। তাকে একটা প্রক্রিয়ার ধারার সংশ্লিষ্ট হতে হয়। শিল্পময় সৃষ্টিতে ওই প্রক্রিয়াকে আরেক প্রজন্মে পৌঁছে দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে এসএম সুলতান অনেক বেশি সফল ও প্রাগ্রসর।
×