ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম অনুষ্ঠান

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ৮ অক্টোবর ২০২০

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম অনুষ্ঠান

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখেন, দুদিন পর অর্থাৎ, ১০ জানুয়ারি। দীর্ঘ কারাভোগের পর শারীরিকভাবে ছিলেন ক্লান্ত এবং কিছুটা অসুস্থ। তৎকালীন ওচএগজ এর পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুকে বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিলেন। সে কারণে স্বদেশে আসার পরও তিনি বেশ কিছুদিন সভা-সমাবেশ থেকে দূরে ছিলেন। এরপর তিনি প্রথম যে অনুষ্ঠানে যোগদান করেন, সেটা হলো ১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর তৎকালীন ওচএগজ এর অ ব্লকের দোতলায় ‘কেন্দ্রীয় রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রটির’ উদ্বোধন। বর্তমানে যেটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ নামে পরিচিত। বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া কেন্দ্রীয় রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রটি অর্থাৎ বর্তমানের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগটি নিয়ে এই জন্য আমরা গর্বিত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে তিনি প্রথমে যে কথাটি বললেন তা হলো- ডাক্তার নুরুল ইসলাম সাহেব আমাকে বলেছেন, আপনি কোথাও যাবেন না। কোন প্রোগ্রামে এ্যাটেন্ড করবেন না। তাই কোন প্রোগ্রামে আমি এখন পর্যন্ত এ্যাটেন্ড করিনি। তার যখন প্রয়োজন, তিনি মনে করেছেন এখানে আসা দরকার, তিনি আমাকে নিয়ে এসেছেন। ডাক্তারের হুকুম আমাকে মানতেই হয়, আমি অসুস্থ যখন। তবু আমি খুশি আপনাদের সঙ্গে দেখা হলো। যে রক্ত সংরক্ষণ কেন্দ্র আপনারা খুলেছেন, এটা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। গবেষণার দিক দিয়ে এর অত্যন্ত গুরুত্ব রয়েছে। দেশের অবস্থা সম্পর্কে আপনারা জানেন। আপনাদের অবস্থা কি? স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্ন স্তরের লোকজন জীবন দিয়েছেন। এ পর্যন্ত যে নাম আমরা পেয়েছি, তাতে ৫০ ডাক্তার শহীদ হয়েছেন (পরবর্তীতে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৪)। এতজন ডাক্তার তৈরি করতে কী লাগে, তা আপনারা জানেন। ইতিহাসে দেখা যায়, যুদ্ধক্ষেত্রে ডাক্তারদের হত্যা করা হয় না। ডাক্তারদের অন্য একটা মর্যাদা আছে। দুই দেশের মধ্যে যখন যুদ্ধ হয় তখন ডাক্তারদের যদি গ্রেফতার করা হয়, তখন তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয় না। তাদের হত্যা করা হয় না। কিন্তু পাকিস্তানী নরপশুরা এত জঘন্য যে, আমার ডাক্তারদের তারা হত্যা করেছে। আমি অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে বলেছি, যেসব ডাক্তারের লিস্ট পাওয়া গেছে পিজি হাসপাতালের দরজার কাছে তাদের নামগুলো ইতিহাসস্বরূপ লিখে রাখুন। প্রত্যেক ডাক্তার যেন দেখে যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অবদান কতখানি। তাহলে বোধহয় দেশের জনগণের প্রতি তাদের দরদ বাড়বে। আমাদের একটা ইনস্টিটিউটের বিশেষ প্রয়োজন ছিল। আমি নিজে অন্যান্য দেশে দেখেছি। আপনার সেটা করেছেন। এটা নিয়ে জাতি গৌরববোধ করতে পারে। যদি আরও কিছু প্রয়োজন হয় সরকার নিশ্চয়ই সেদিকে নজর রাখবে। কিন্তু শুধু পয়সা দিয়ে কিছু হয় না, সেটা আপনারা বোঝেন। পয়সার সঙ্গে সঙ্গে যেটা দরকার সেটা হলো মানবতাবোধ। আমরা যেন মানবতাবোধ হারিয়ে ফেলেছি। আমি কুমিল্লায় জনসভায় বলেছিলাম, শেখ মুজিবুর রহমানকে বেটে খাওয়ালেও সোনার বাংলা গড়তে পারবেন না, যদি সোনার মানুষ গড়তে না পারেন। আমি যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছি আপনাদের কাছে বলতে গেলে যে, যেদিকেই আমি চাই, সেদিকেই যেন দেখি মানুষ এত নীচু হয় কি করে? মানুষ মানুষের পয়সা খায় কি করে? মানুষ গরিব-দুঃখীর কাছ থেকে কি করে লুট করে? আমি বুঝতে পারি না। দেশের জনগণ রক্ত দিতে কোনদিন কৃপণতা করেনি। গত আন্দোলনের সময় আমি জেলে যাওয়ার আগে যখন বলেছিলাম ব্লাডের দরকার। বাংলাদেশের মানুষ লাইন ধরে ব্লাড দিয়েছিল। রক্ত আপনারা পাবেন। রক্ত বাংলার মানুষ দেয়। গুলি খেয়েও রক্ত দেয়, আবার অন্যকে বাঁচাবার জন্যও বাংলার মানুষ রক্ত দেয়। কিন্তু রক্তের সদ্ব্যবহার হওয়াই দরকার এবং সেটা যদি হয়; নিশ্চয় ডাক্তার সাহেব রক্তের অভাব হবে না। বিদেশে আমাদের অনেক ডাক্তার ও প্রফেসরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আমাকে দেখতে এসেছিলেন তাঁরা। ডাক্তার নুরুল ইসলামের সামনে তাঁদের বলেছি, আপনারা সবাই দেশে ফিরে আসুন। দেশ আপনাদের, দেশ আপনাদের দাবি করতে পারে। কারণ যে মেডিক্যালে পড়েছেন, সে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে জনগণের টাকা থেকে আপনাদের সাহায্য করা হয়েছে, আর আপনারা লেখাপড়া শিখে বিদেশে গিয়ে বড় ডিগ্রী নিয়ে সেখানেই বেশি টাকা উপার্জন করতে চান, সেটা বড় অন্যায়। কারণ আপনারা যে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, তার পেছনে যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, তা এ দেশের দুঃখী মানুষের ট্যাক্স থেকে। আমাদের নার্সিং যেন আমাদের সমাজের জন্য একটা অসম্মানজনক পেশা। আমি বুঝতে পারি না এ সমাজ কিভাবে বাঁচবে। একটা মেয়ে দেশের খাতিরে নার্সের কাজ করছে, তার সম্মান হবে না। আমি ডাক্তার সাহেবদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলাম যে, আপনারা আমাকে একটা কর্মসূচী দেন, যাতে গ্র্যাজুয়েট মেয়েরাও এখানে আসতে পারে। তাদের আসতে হবে সেবার মনোবৃত্তি নিয়ে। আপনারা ডাক্তার যাঁরা আছেন, তাদের অনেকেই তো বিদেশে ঘুরে এসেছেন। বিদেশে যা শিখে এসেছেন তা আমাদের দেশে কেন চালু করেন না। এখানে এলে আপনারা মনে করেন যে, আপনারা বড় ডাক্তার সাহেব হয়ে গেছেন ও নার্সরা কিছুই না। কিন্তু ওখানে ডাক্তার নার্সের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সমীহ করে কথা বলে। ইজ্জতের সঙ্গে কথা বলে। যে কাজই করুক না কেন সে কাজের জন্য তার সম্মান আছে। এছাড়াও তিনি ওয়ার্ডবয়, ক্লিনার এবং সুইপারদের কাজের কথাও উল্লেখ করেন। তাদেরও মানসম্মান দিয়ে সবার কথা বলা উচিত। কারণ সবাই সেবক। সবার সম্মিলিত কাজ ব্যতীত উন্নত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শুধু নিজেদের পেটের তাগিদে তারা কাজ করে না, সমাজের প্রয়োজনেও তারা কাজ করে। ১৯৭২ সালের ‘অ’ ব্লকের ২য় তলার জায়গা নিয়ে ‘কেন্দ্রীয় রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র’টি শুরু হয়েছিল, যা নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন মোতাবেক চলছে যুগের চাহিদা মোতাবেক। বিভাগটি জরুরী বিধায় শুরু থেকেই বিভাগটির কার্যক্রম দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা চলমান ছিল এবং তা এখনও চলমান। বিশ্ব করোনা মহামারীর মধ্যেও বিভাগটির কোন কার্যক্রম এক মিনিটের জন্যও বন্ধ হয়নি। রোগীর প্রতি দায়িত্ববোধ এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই বিভাগের সকল শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা করোনা মহামারীর মধ্যেও দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। পরবর্তীতে আগের কার্যক্রমের পাশাপাশি একই জায়গায় ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগটি মেডিসিন ফ্যাকালটির অধীনে MD (Residency), MD, FCPS, DBS&T, MTM, MCPS & PhD Course চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকে। আগে রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রটি শুধু রক্ত সংগ্রহ ও বিতরণে সীমাবদ্ধ ছিল। অথচ এই সুদীর্ঘ সময়ে কাজের পরিধি বেড়েছে কয়েকগুণ। লেখক : কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×