ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তামান্না আফরিন

বিচারালয়ে অনিয়ম-অব্যবস্থা ও প্রতিকার

প্রকাশিত: ২০:১৯, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

বিচারালয়ে অনিয়ম-অব্যবস্থা ও প্রতিকার

দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট থেকে শুরু করে নিম্ন আদালত বিচারালয়ের সর্বত্র অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনাই যেন আজ নিয়মে পরিণত হয়েছে। একটা মামলা ফাইলিং থেকে শুরু করে রায় বা আদেশ পাওয়া পর্যন্ত প্রতি পদে পদে আপোস করতে হয় ঘুষ-অনিয়মের সঙ্গে। মামলা চলাকালীন বিভিন্ন ধাপে আদালতের বিভিন্ন কর্মচারীদের দিতে হয় ঘুষের টাকা যাকে আমরা আইনজীবীরা তদ্বিরের টাকা বলি। আদালতপাড়ায় এই ঘুষ, তদ্বির ও অনিয়মের ঘটনা যেন ওপেনসিক্রেট। সবাই সব কিছু জানে, কিন্তু কেউ মুখ খোলে না, প্রতিবাদ করে না। অনিয়মের সঙ্গে শুধু যে কোর্টের কর্মচারীরা জড়িত তা কিন্তু নয়। কিছু অসাধু আইনজীবীও জড়িয়ে আছেন অবৈধ সুবিধা দেয়া ও নেয়ার কাজে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জুনিয়র আইনজীবীগণ আদালতের কর্মচারীদের সঙ্গে ঝগড়া করে নিজের ক্যারিয়ার ধ্বংস করতে চান না। তাদের ভিতরে একটা ভয় সব সময় কাজ করে যে কোন প্রয়োজনে তাকে কোর্টে আসতে হবে এবং মামলা পরিচালনায় এসব কর্মচারীদের সহযোগিতা লাগবেই। সুতরাং আজ টাকা না দিয়ে প্রতিবাদ করলে কালকে তারা আর আমাকে সহযোগিতা করবে না বরং পদে পদে নানাভাবে আটকানোর চেষ্টা করবে। সময় মতো কাক্সিক্ষত আদেশ পেতে ব্যর্থ হলে মক্কেলের কাছেও অপদস্ত হতে হবে। এসব কারণে আদালতাঙ্গনে বে-আইনী সব লেনদেন সহজাত ব্যাপার হয়ে গেছে, যেন এটাই বিধিবদ্ধ নিয়ম। একটা মামলা দায়ের করার সাধারণ নিয়ম হলো মামলাটি ফাইলিং করার সময়ই মামলা পরিচালনা করার নিমিত্তে সরকার নির্ধারিত কোর্ট ফি জমা দিয়ে মামলা দায়ের করতে হবে। অতঃপর মামলার রায় বা আদেশ হলে এর সার্টিফাইড কপি ওঠানোর জন্য আরেক বার আদালতকে সরকার নির্ধারিত ফি দিয়ে কপি সংগ্রহ করতে হয়। এর মাঝখানে আদালতের কোন কর্মচারীকে কোন টাকা দেয়ার কোন বিষয় নেই। কিন্তু বাস্তবে মামলা পরিচালনা করার শুরু থেকেই আদালতের কর্মচারীদের ঘুষ না দিলে সময় মতো মামলা ফাইলিং হবে না, মামলার প্রতি তারিখে পকেট থেকে টাকা বের করে তদ্বির না করলে মামলার কাজ আগাবে না, টাকা না দিলে মামলার ফাইলটা একই জায়গায় পড়ে থাকে মাসের পর মাস কখনও বছরের পর বছর। উচ্চ আদালতে অনিয়মের চিহ্নিত স্থানগুলো হলো : ফাইলিং শাখা / এফিডেভিট শাখা, আদালতের বেঞ্চ অফিসার, মামলার আদেশ লিখতে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার অপারেটর, বিচারপতিগণের আরদালি (যিনি বিচারপতির চেয়ার ঠিক করে দেন), আদালতের পিয়ন (যিনি আদেশের কপি বেঞ্চ থেকে সেকশনে নিয়ে যান), সেকশন অফিস, অতিরিক্ত রেজিস্ট্রারের অফিস, আইটি সেকশন ও ডেচপাস শাখা। নিম্ন আদালতে অনিয়মের চিহ্নিত স্থানগুলো হলো : ফাইলিং শাখা/সেরেস্তা/ জি.আর.ও. শাখা, আদালতের পেশকার/জি.আর.ও. সাহেব, মামলার আদেশ লিখতে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার অপারেটর, বিচারকগণের আরদালি (যিনি বিচারকের চেয়ার ঠিক করে দেন), আদালতের পিয়ন, সমন জারিকারক, আইটি সেকশন ও ডেচপাস শাখা। এসব জায়গায় বেশিরভাগ কর্মচারী অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। টাকা না দিলে ফাইল নড়ে না। টাকা দিলে কাজ হয় দ্রুতগতিতে। তাই আদালতাঙ্গনে অনিয়মের এই টাকা দেয়াকে বলা হয় Speed Money . Speed Money কোথায় কত দিতে হয় : একটা সময় আইন পেশাকে রাজকীয় পেশা হিসেবে গণ্য করা হতো। তখন কেবল রাজা-জমিদারের সন্তানরাও ওকালতি করত। তাদের ধন-সম্পদের অভাব ছিল না। ওকালতি ছিল তাদের পরোপকার করার একটা মাধ্যম। পয়সার জন্য নয় বরং ন্যায় বিচারের জন্য আইনী যুদ্ধ করতেন। আর এখন সব শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা আইন পেশায় অনর্ভুক্ত হচ্ছে। ভাল ইনকাম না হলে এই পেশায় থাকার কোন মানেই হয় না এমন একটা ভাব। এছাড়া যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে অনেক পরিবর্তন এসেছে বিচারাঙ্গনে, পরিবর্তন এসেছে আমাদের ভোগে, বিলাসে, চাহিদায়, বেড়েছে আদালতের কর্মচারীদের দাবির পরিমাণও। আর এই সমস্ত দাবির কথা বিবেচনা করতে গিয়ে উকিল বাবুরা আজ মক্কেলের কাছে জল্লাদ। একটা মামলার শুরু বা ফাইলিং থেকেই ছোট সাহেবদের ডিমান্ড শুরু হয়ে যায়, এ যেন অনেকটা মামাবাড়ির আবদার। যা ধরেছে বায় না, তার এক আনা কম হলে ছোট সাহেব ঘুষ খায় না। তখন মামলার স্বার্থে ছোট সাহেবদের মন রক্ষা করার জন্য উকিল সাহেবদের তা পূরণ করতে হয়। আর তারপর একের পর এক ছোট সাহেবদের চাহিদা শুরু হয়। সবখানে দিতে হয় টাকা আর টাকা। হাইকোর্টে একটা রিট মামলায় সিলের জন্য দিতে হয় ১০০/- টাকা, টেন্ডার নাম্বারের জন্য দিতে হয় ১০০/- টাকা, এফিডেভিট শাখায় মামলার তদবিরকারক অনুপস্থিত থাকলে এফিডেভিট কমিশনারকে দিতে হয় ১০০০/- টাকা। আর উপস্থিত থাকলে দিতে হয় ২০০-৩০০/- টাকা। কমিশনারের পিয়নকে দিয়ে কাজ করতে হলে দিতে হয় ১০০-২০০/- টাকা। মামলা এফিডেভিট হয়ে যাওয়ার পর কোর্টে মোশন হিসেবে জমা দিতে হয়। কোন কারণে মোশন হিসেবে জমা দিতে না পারলে মামলার স্লিপ জমা নেওয়ার জন্য বেঞ্চ অফিসারকে ৫০০-১০০০/- টাকা দিতে হয়। মামলা লিস্টে আনার জন্য দিতে হয় ৫০০-৫০০০/-টাকা, ক্ষেত্রবিশেষে টাকার পরিমাণ আরও বাড়াতে হয়। মামলার সিরিয়াল এগিয়ে আনার জন্য দিতে হয় ৫০০-১০০০/-টাকা। (গত বছরের ২ ডিসেম্বর আপীল বিভাগের একটি মামলার শুনানির সময় এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম অভিযোগ করেন একটি মামলা আজ ৩ নম্বর সিরিয়ালে থাকার কথা। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তা ৮৯ নম্বর সিরিয়ালে গেছে। তিনি আরও বলেন, অনেকেই মামলার সিরিয়াল ওপর-নিচ করে কোটিপতি হয়ে গেছে)। অনেক সময় কোর্টে শুনানির জন্য সময় মতো ফাইল আসে না। তখন ১০০-৫০০/- টাকা দিয়ে তদ্বির করে ফাইল আনতে হয়। অতঃপর মামলার কাক্সিক্ষত আদেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে আসেন সংশ্লিষ্ট আদালতের আরদালি। তাকে দিতে হয় ১০০-৫০০/- টাকা। এটা নাকি তাদের বকশিশ। আদেশের কপি সাইন করানোর জন্য পিয়নকে দিতে হয় ১০০-৫০০/- টাকা। কোর্ট থেকে ফাইল সেকশনে পাঠানোর জন্য দিতে হয় ১০০/-টাকা। যদি কোন ফাইল খুঁজে না পাওয়া যায়, সেটা খুঁজে বের করার জন্য দিতে হয় ৫০০/- টাকা। সেকশনে মামলার আদেশটি টাইপ ও সার্টিফাইড কপির জন্য দিতে হয় ১০০০-৩০০০/- টাকা এবং সর্বশেষ ডেচপাসে দিতে হয় ১০০-২০০/- টাকা । দেশের নিম্ন আদালতগুলোতেও অনিয়মের একই চিত্র বিদ্যমান। হাইকোর্টের বেঞ্চ অফিসার/নিম্ন আদালতের পেশকার, পিয়ন, জারিকারক বাসে করে কোর্টে যাতায়াত করলেও এদের অনেকেরই আলিশান বাড়ি ও ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে। বিচার ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিন ধরে চলমান দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার শিকার সাধারণ আইনজীবীদের মাঝে অনেক দিন থেকেই একটু একটু করে ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। এসব দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারকে অবহিত করা হলে এ বিষয়ে গত ৮ আগস্ট ২০২০ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এক বৈঠকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দ আলোচনায় বসেন এবং সব শুনে প্রধান বিচারপতি জানান যে, ঢালাওভাবে নয় বরং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সুতরাং আমি মনে করি এসব অনিয়ম বন্ধ করতে হলে আইনজীবী সমিতিগুলোকে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ আইনজীবীদের পক্ষে কথা বলার জন্য প্রতি বছর বার সমিতিগুলোতে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হলেও নির্বাচনোত্তর বার প্রতিনিধিগণ নিজ নিজ কাজে ও জামিন বাণিজ্য নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। তাই সাধারণ আইনজীবীদের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি এসব অনিয়ম বন্ধে তারা তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে পারেন না। আমি আশা করি অনিয়মের জায়গাগুলো সুর্নিদিষ্টভাবে চিহ্নিত করে আলোচনায় বসলে এবং প্রশাসনিক নজরদারি বাড়ালে, বিচারপতিদের ঝটিকা অভিযান চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে বিদ্যমান থাকলে এসব অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা কমানো অসাধ্য কিছু নয়। লেখক : এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট [email protected]
×