ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

চাঞ্চল্যকর সিনহা হত্যা কারাগারে প্রেরণ

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়নি প্রদীপ

প্রকাশিত: ২২:৪২, ২ সেপ্টেম্বর ২০২০

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়নি প্রদীপ

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের হত্যাকে কেন্দ্র করে যাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা টেকনাফের তৎকালীন সেই ওসি প্রদীপ কুমার দাশ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়নি। টানা ১৫ দিনের রিমান্ড শেষে মঙ্গলবার দুপুরে তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়েছে। অপরদিকে, সিনহা হত্যার পর টেকনাফ থানায় পুলিশের পক্ষে দায়েরকৃত প্রথম মামলার ৩ সাক্ষীকে এদিন ফের ৩ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে র‌্যাব। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটিকে রিপোর্ট প্রদানে আরও একসপ্তাহ সময় দেয়া হয়েছে। এছাড়া ওসি প্রদীপের স্ত্রী চুমকি যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে সে ব্যাপারে দুদক প্রদত্ত পত্রের বিপরীতে পুলিশ সদর দফতর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সিনহা হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ৩ জন। এরা হলেন টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী, থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পুলিশ ফাঁড়ির এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত। এদের মধ্যে নন্দদুলালকে সঙ্গে নিয়ে লিয়াকত আলী সোর্সের খবর অনুযায়ী ৩১ জুলাই রাত ৯টার পর শামলাপুর এপিবিএন নিয়ন্ত্রিত তল্লাশি চৌকিতে যান। সোর্সের খবর ছিল মারিসবুনিয়া পাহাড়ে ডাকাত ঘোরাফিরা করছে। প্রধানত যে ৩ সোর্স লিয়াকতকে ডাকাত আসার খবর দিয়েছেন তারা হচ্ছেন মারিসবুনিয়া এলাকার নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও মোঃ আয়াছ। এরা তিনজনই স্থানীয় কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সদস্য। এদের মধ্যে নুরুল আমিন দফায় দফায় মোবাইল ফোনে লিয়াকত আলীকে তাগাদা দিয়েছেন ডাকাতরোধে। সোর্সের তথ্য অনুযায়ী লিয়াকত আলী সহযোগী এসআই নন্দদুলালকে নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। এরপর আটকে দেন সিনহা ও সহযোগী শিফাতকে বহনকারী প্রাইভেট কারটিকে। এরপরই ঘটে গেল ঘটনা। গাড়ি থেকে হাত তুলে নামতে বলার পর শিফাত প্রথমে নেমে যান। তাকে হাত তুলে গাড়ির পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সিনহা হাত তুলে নামতে গিয়েই লিয়াকতের চারদফা গুলির শিকার হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আদালত সূত্রে জানা গেছে, ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী স্বীকার করে নিয়েছেন তিনিই সিনহাকে গুলি করেছেন। এছাড়া এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত স্বীকার করেছেন তিনি লিয়াকতের সহযোগী হয়ে এ ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। সিনহাকে লক্ষ্য করে লিয়াকতের পক্ষে গুলির ঘটনাটি তাৎক্ষণিক নাকি অন্য কিছু তা লিয়াকতই জানেন। এছাড়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদানকারী এপিবিএনের তিন সদস্য ঘটনার সময় স্বচক্ষে যা যা দেখেছেন সেটাই বর্ণনা করেছেন। অনুরূপভাবে এ ঘটনার পর পুলিশী মামলার ৩ সাক্ষী নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও মোঃ আয়াছ প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে একই বর্ণনা দিয়েছেন। এ ৫ জনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর পর তদন্ত সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের মহলের আগ্রহ ছিল এজাহারভুক্ত ২নং আসামি টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ভূমিকা নিয়ে। অর্থাৎ তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিচ্ছেন কিনা। তদন্ত সংস্থার সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, টানা পনেরো দিনের রিমান্ডে তিনি সিনহা হত্যার সঙ্গে তার কোন ধরনের দায় ছিল না বলে দাবি করেছেন। এমনকি রিমান্ডের শেষদিন সোমবারও তাকে কোনভাবে মুখ খোলানো যায়নি। তিনি বলেছেন, ঘটনার সময় তিনি থানায় ছিলেন। লিয়াকতের ফোন পেয়ে তিনি প্রায় আধাঘণ্টা সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছেন এবং সিনহাকে হাসপাতালে প্রেরণ করেন। এদিকে সিনহার মূল কিলার ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী হলেও ওসি প্রদীপ কুমার দাশই আলোচনার পাদপীঠে রয়েছেন। কেননা, টেকনাফ থানায় তার ২২ মাসের দায়িত্ব পালনকালে তিনি ১৬১টি ক্রসফায়ারের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এতে প্রাণ হারিয়েছে ২০৪ জন। সিনহা হত্যাকা-ের ঘটনাও তার থানার আওতাধীন থাকায় তিনি এ হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত হওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি চাউর হয়েছে। তদন্তে এবং রিমান্ডে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদকালে ঘটনার সময় প্রদীপ উপস্থিত ছিলেন এমন তথ্য যেমন কেউ দেননি, তেমনি প্রধান দুই আসামি ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দদুলাল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে জড়াননি। আর ওসি প্রদীপ কুমার দাশও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেননি। র‌্যাব কর্মকর্তার জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ঘটনার পরম্পরা যা জেনেছেন বা দেখেছেন তারই বর্ণনা দিয়েছেন। এ ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা নেই বলে দফায় দফায় দাবি করার পর তাকে টানা পনেরো দিনের রিমান্ডে রাখা হয়। কিন্তু হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কোন তথ্য উদ্ধার করা যায়নি। ফলে মঙ্গলবার আদালতে সোপর্দ করার পর তাকে কক্সবাজার আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর নির্দেশে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। মঙ্গলবার আদালতে সোপর্দ করার আগে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পুলিশী মামলার তিন সাক্ষী, নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও মোঃ আয়াছকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। এদিকে, তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের সিনিয়র এএসপি খাইরুল ইসলামের আবেদনের প্রেক্ষিতে সিনহা হত্যার পর পুলিশী দায়েরকৃত মামলার আলোচিত তিন সাক্ষীকে আরও ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। দ্বিতীয় দফায় চার দিনের রিমান্ড শেষে মঙ্গলবার দুপুরে কক্সবাজার আদালতে সোপর্দ করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা তাদের আরও অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের স্বার্থে পুনরায় চার দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক তামান্না ফারাহ ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আসামিরা হলেন নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও মোঃ আয়াছ। এর আগে গত ২০ আগস্ট এদের প্রথম দফায় ৭ দিন ও ২৫ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় ৪ দিনের রিমান্ডে নেয় র‌্যাব। গত ৬ আগস্ট সিনহা হত্যা মামলা দায়েরের পর ৯ আগস্ট পুলিশী মামলার এ তিন সাক্ষীকে র‌্যাব গ্রেফতার করে। এদিকে, এ হত্যাকা- এবং পরবর্তীতে মামলার পর তদন্ত প্রক্রিয়া জোরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আইনজীবীদের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, সিনহা হত্যাকা-ে ওসি প্রদীপের সম্পৃক্ততা ছিল কি ছিল না তা নিয়ে উৎসুক মহলের আগ্রহ যেমন বেশি, তেমনি তদন্ত প্রক্রিয়াও এগিয়েছে অনেকটা সেভাবে। প্রদীপ কুমার দাশ যেহেতু ওই সময় টেকনাফ থানার ওসির দায়িত্বে ছিলেন এবং তিনি অসংখ্য ক্রসফায়ারের নেতৃত্ব দিয়েছেন এক্ষেত্রে সিনহা হত্যায় তার সম্পৃক্ততা কেমন ছিল সেদিকেই সকলের নজর অনেকটা বেশি। ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী সিনহাকে লক্ষ্য করে গুলি করেছেন। এটা শুধু তল্লাশি চৌকির এপিবিএনের তিন সদস্য নয়, ঘটনাস্থলে প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে বলেছেন। এসব প্রত্যক্ষদর্শী র‌্যাবের তদন্ত কর্মকর্তাকে যেমন জবানবন্দী দিয়েছেন, তেমনি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির কাছেও। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হচ্ছে হত্যাকারী নিজেই আদালতে তার দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন। এর ফলে আসামিদের মধ্যে ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দদুলাল নিশ্চিতভাবে চার্জশীটভুক্ত হবেন। অন্যান্য আসামিদের সম্পৃক্ততা আসবে প্রমাণ সাপেক্ষে। এক্ষেত্রে মারিসবুনিয়ার নুরুল আমিন কেন বার বার তাগাদা দিয়ে ডাকাত ধরার জন্য লিয়াকতকে ঘটনাস্থলে আসতে উদ্বুদ্ধ করলেন সেটাও একটি বিবেচ্য বিষয়। এ নুরুল আমিন মারিসবুনিয়ার মসজিদ থেকে মাইকযোগে ডাকাত পড়েছে বলে এলাকাবাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানিয়েছিলেন। যদিও এর আগে এলাকার অনেকে ওরা (সিনহা ও শিফাত) ডাকাত নয় বলে জানালেও নুরুল আমিনের অতি উৎসাহের শেষ পরিণতি একটি তরতাজা প্রাণ ঝরে যাওয়ার ঘটনা। এরপরও আগ্রহী মহলে যে উত্তরটি সুনির্দিষ্টভাবে খোঁজা হচ্ছে সেটি এখনও পরিষ্কার হয়নি। কেননা, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীদাতাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান দুই আসামি ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত তাদের জবানীতে কি উল্লেখ করেছেন তা পরিপূর্ণভাবে এখনও প্রকাশ হয়নি। তবে তদন্ত কর্মকর্তা সিনিয়র এএসপি খাইরুল ইসলাম মঙ্গলবারও সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ঘটনা প্রমাণে ইতোমধ্যে বহু তথ্য উপাত্ত মিলেছে। যার গুলিতে সিনহা মারা গেছেন সেই লিয়াকত আলী তার দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন। সহযোগী এসআই নন্দদুলালও তার সম্পৃক্ততা উল্লেখ করেছেন। এখন কলাবোরেটিভ এভিডেন্সের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করে চার্জশীট প্রদান করা হবে। ফলে আসামিদের দফায় দফায় রিমান্ডে আনা হয়েছে। মঙ্গলবার পুলিশী মামলার তিন সাক্ষীকেও ৩ দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। অপরদিকে, আসামিদের পক্ষে চার পুলিশকে আদালত ৭ দিনের রিমান্ড প্রদান করলেও এখনও তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র‌্যাব হেফাজতে নেয়া হয়নি। এরা হলেন কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়া। এরা লিয়াকত ও নন্দদুলালের সঙ্গীয় ফোর্স হিসাবে ঘটনাস্থলে ছিলেন। তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন এদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পৌনপুনিকভাবে ঘটনা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মেলানো হবে আসামি ও সাক্ষীদের বক্তব্য দিয়ে। এ ব্যাপারে তার আশা সিনহা হত্যা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবে। এরপরও যে প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি সেটি হচ্ছে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নির্দেশনায় লিয়াকত আলী এ হত্যাকা- ঘটিয়েছেন কিনা। কিন্তু এ পর্যন্ত এ ধরনের কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ মেলেনি। এছাড়া কোন সংস্থার পক্ষে অন্য কোন সংস্থার সদস্যকে গুলিতে হত্যার কোন প্রশ্নই আসে না। এটি হতে পারে ইন্সপেক্টর লিয়াকতের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের জের। এছাড়া ইন্সপেক্টর লিয়াকত ডাকাত মনে করে রাইট অব প্রাইভেট ডিফেন্স নিয়ে গুলি করেছেন কিনা সেটাও পাওয়া যেতে পার তার প্রদত্ত জবানবন্দীতে।
×