ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

৮০টি হেলিকপ্টার থাকতে পারবে

কাওলায় হচ্ছে দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ হেলিপোর্ট

প্রকাশিত: ২১:৫৬, ১৭ আগস্ট ২০২০

কাওলায় হচ্ছে দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ হেলিপোর্ট

আজাদ সুলায়মান ॥ দেশে প্রথমবারের মতো একটি পূর্ণাঙ্গ হেলিপোর্ট নির্মাণ করতে যাচ্ছে সিভিল এভিয়েশন। প্রায় পাঁচ শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে এক শ’ বিঘা জমির ওপর নির্মিতব্য এই স্থাপনায় ইতোমধ্যেই স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ ও পরামর্শে একটি আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন হেলিপোর্ট নির্মাণ যতটা সম্ভব দ্রুত শেষ করা হবে বলে জানিয়েছেন বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান। তার মতে, সবার সহযোগিতা পেলে আগামী এক থেকে দেড় বছরেই হেলিপোর্ট নির্মাণ করা সম্ভব। নানা ধরনের জটিলতা মোকাবেলায় ভিন্ন কৌশলে হলেও নতুন এই প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু করতে চায় বেবিচক। জানা গেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের গোলচক্কর লাগোয়া দক্ষিণে রেললাইনের পূর্ব প্রান্তে বেবিচকের নিজস্ব জমিতেই হেলিপোর্ট নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিষয়টি প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, সিনিয়র সচিব মহিবুল হকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছেন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান। প্রকল্পের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বেবিচক সদস্য এয়ার কমোডর খালিদ হোসেন। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে। বেসরকারী বাণিজ্যিক হেলিপোর্ট নির্মাণ দেশে এই প্রথম। এখানে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বলতে- মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি, জায়গা নির্ধারণ ও অর্থ উৎস সবই চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এখন দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরামর্শক নিয়োগ করে ড্রয়িং-ডিজাইনসহ অন্যান্য সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করে টেন্ডারে যেতে হবে। এগুলো আগামী তিন মাসের মধ্যে হয়ে গেলে বাকি নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে যাবে নির্ধারিত সময়েই। আমাদের টার্গেট যত কম সময়ের মধ্যে হেলিপোর্ট নির্মাণ করে অপারেশনে যাওয়া। উল্লেখ্য, দেশে হেলিকপ্টারের বাণিজ্যিক ব্যবহার বাড়ছে। বাড়ছে যাত্রী সংখ্যাও। আগে সাধারণত কর্পোরেট কোম্পানিরগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তা এবং তাদের বায়ারগণ এই সেবা নিলেও এখন সমাজের উচ্চবিত্তদের মাঝেও হেলিকপ্টার ভ্রমণে আগ্রহ বাড়ছে। চড়া দামে টিকেট কেটে মানুষজন হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন। রোগী আনা নেয়ার ক্ষেত্রেও এখন হেলিকপ্টার ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণাংশে বেবিচকের পৃষ্ঠপোষকতায় বেসরকারী হেলিকপ্টার সংস্থাগুলো নিজস্ব উদ্যোগে স্থাপনা তৈরি করে তাতে অপারেশনাল কাজ চালাচ্ছে। যা ইতোমধ্যে থার্ড টার্মিনালের জন্য সরিয়ে নেয়া হয়েছে বিমানবন্দরের উত্তর প্রান্তে। কিন্তু যেভাবে হেলিকপ্টারের নেটওয়ার্ক ও ব্যবসার পরিধি বাড়ছে তাতে নিকট ভবিষ্যতে এখানেও অপারেশনাল কাজে আরও বিস্তৃতি ঘটবে। তখন পরিস্থিতি সামাল দেয়া হবে আরও কঠিন। এমন বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান একটি পূর্ণাঙ্গ হেলিপোর্ট নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন এবং একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপনের পর তাঁর সদয় অনুমতি ও সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস মেলে। তারপরই হেলিপোর্ট নির্মাণ প্রকল্পের তোড়জোড় শুরু হয়। এ সম্পর্কে সিনিয়র সচিব মহিবুল হক দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি সময়োচিত সিদ্ধান্ত। এ বিষয়ে নির্দেশনা পাওয়ায় দ্রুততম সময়ে এখন তা শেষ করাই হবে চ্যালেঞ্জ। আমরা সেভাবেই নির্দেশনা দিয়েছি বেবিচককে। এ বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল মালেক জানান, হেলিপোর্ট নির্মাণের কাজটি বলা চলে একেবারেরই প্রারম্ভিক। দেশে ইতিপূর্বে কারোরই এ ধরনের প্রতিষ্ঠান করার অভিজ্ঞতা নেই। আইকাও গাইডলাইন অনুযায়ী সব ধরনের শর্তাদি মেনেই হেলিপোর্ট নির্মাণ করতে হয়। কাজেই পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে এখানে বিদেশী কোম্পানির সহযোগিতা নিতে হবে। যা শুধু ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। সে জন্য বিকল্প পন্থায় বর্তমানে থার্ড টাার্মিনালের নির্মাণে নিয়োজিত পরামর্শক কোম্পানি জাপানের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান নিপ্পনকে দিয়ে যদি করানো যায়- সেটা হবে খুবই সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ের। নইলে শুধু পরামর্শক কোম্পানি নিয়োগ করতেই চলে যাবে প্রায় ৮ মাস। এমন বাস্তবতার প্রেক্ষিতে আমরা ইতোমধ্যে জাইকাকে চিঠি লিখেছি- যাতে নিপ্পনের সহায়তা পাওয়া যায়। আশা করা হচ্ছে- জাইকার অনুমতি পাওয়া গেলে নিপ্পনকে দিয়েই এ কাজটা করানো যাবে। এ পদ্ধতিতে হলেই সম্ভব দ্রুততম সময়ে প্রকল্প শুরু ও শেষ করা। প্রকৌশল বিভাগের মতে, প্রস্তাবিত হেলিপোর্ট কমপক্ষে ৮০টি হেলিকপ্টার ধারণের সক্ষমতা থাকবে। এক সঙ্গে দুটো হেলিকপ্টার ওঠা-নামার সুযোগ থাকছে এতে। মূলত বেসামরিক বাণিজ্যিক হেলিকপ্টার সেবাকে আরও সুবিস্তৃত ও নির্ভরযোগ্য শিল্প হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এমন একটি হেলিপোর্ট নির্মাণের আবশ্যকতা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মোঃ মফিদুর রহমান। তিনি বলেন, বর্তমান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অতি সংলগ্ন এর চেয়ে সুবিধাজনক স্থান আরও নেই কোথাও। সব দিক বিবেচনা করেই কাওলায় বেবিচকের কোয়ার্টার সংলগ্ন ফাঁকা জমিতে হেলিপোর্ট নির্মাণের জন্য বাছাই করা হয়েছে। আগামী ৫০ বছরের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নিয়ে প্রাথমিকভাবে এক শ’ বিঘার ওপর এটা নির্মাণ করতে হচ্ছে। জানতে চাইলে বেবিচকের সদস্য (এফএসআর) গ্রুপ ক্যাপ্টেন চৌধুরি জিয়াউল কবীর জানিয়েছেন, হেলিকপ্টার ব্যবহারে সরকারের নীতিমালা রয়েছে। সে অনুযায়ী নয়টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে আরও কয়েকটি কোম্পানি লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন। এগুলো যাচাই-বাছাই হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হেলিকপ্টার সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় কোম্পানি হলো সিকদার গ্রুপের মালিকানাধীন আরএনআর এয়ারলাইন্স। বর্তমানে তাদের সাতটি হেলিকপ্টার। এগুলো হলো- বেল-৪০৪, আর-৬৬ ও আর-৪৪ ও দুটি আর-৬৬। সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্সের চারটি (২টি আর-৪৪, ১টি আর-৬৬), বসুন্ধরার তিনটি, স্কয়ার গ্রুপের তিনটি, পিএইচপি গ্রুপের একটি, বাংলা ইন্টারন্যাশনালের একটি, বিআরবি ক্যাবলের দুটি, মেঘনা গ্রুপের তিনটি, ইমপ্রেস এভিয়েশনের দুটি, এমএএস বাংলাদেশের দুটি হেলিকপ্টার রয়েছে। এর মধ্যে আর এ্যান্ড আর, বিআরবি ক্যাবল, বাংলা ইন্টারন্যাশনাল, পিএইচপি এয়ারলাইন্সের শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিশাল হ্যাংগারও রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে গ্রুপ ক্যাপ্টেন চৌধুরি জিয়াউল কবীর বলেন, অনুমতি নিয়ে সবাই হেলিকপ্টার চালাচ্ছেন। হেলিকপ্টার পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। সেই নীতিমালা অনুযায়ী কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা চালাচ্ছে। নীতিমালার মধ্যেই বলা আছে হেলিকপ্টার উড্ডয়নের ৪৮ ঘণ্টা আগে সিভিল এভিয়েশনকে জানাতে হবে। কারণ হেলিকপ্টারের নির্দিষ্ট কোন রুট নেই। এ কারণে কোন হেলিকপ্টার আকাশে উড্ডয়ন করলে টাওয়ারকে প্রস্তুত রাখতে হয় যাতে সহজে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। নির্দিষ্ট রুট না থাকায় অনেক সময় পাইলটরা ভুলে অনুমতি ছাড়া অন্য দেশের সীমানায় ঢুকে পড়ে। এটি খুবই বিপজ্জনক। টাওয়ার প্রস্তুত থাকলে এই সমস্যা এড়ানো সম্ভব। তবে জরুরী হলে ৫, ১০ ও ১৫ মিনিট এমনকি এক ঘণ্টার মধ্যেও অনুমতি দেয়া হয়। বেবিচক সূত্র মতে- দেশে শুরুতে মাসে হেলিকপ্টার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল গড়ে মাসে ৫শ’ থেকে ১ হাজার। এখন তা বেড়ে মাসে ৫ থেকে ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্স নামে একটি কোম্পানি বাণিজ্যিক লাইসেন্স নিয়ে এই ব্যবসা শুরু করে। সিভিল এভিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে নয়টি কোম্পানির ২৭টি হেলিকপ্টার রয়েছে। কোম্পানিগুলো আরও সমানসংখ্যক হেলিকপ্টার আনার জন্য সিভিল এভিয়েশনে আবেদন জানিয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই সেবাটি অনেক ব্যায় বহুল হয়ে পড়েছে। তাছাড়া বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনার জন্য সিভিল এভিয়েশনের নীতিমালা অনেক কঠিন শর্ত থাকায় সম্ভবনাময় এই সেক্টরটি দ্রুত এগোতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রতিনিয়ত বেড়ে যাওয়া অসহনীয় যানজট এড়াতে সামর্থ্যবান ব্যবসায়ী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, হাসপাতাল মালিক ও বিদেশী বিনিয়োগকারীরা খুঁজছে বিকল্প পথ। এর ধারাবাহিকতায় কর্পোরেট লেভেলে বৃদ্ধি পাচ্ছে হেলিকপ্টারের ব্যবহার। এছাড়া সিনেমার শূটিং, রাজনৈতিক সভা সমাবেশ, রোগী আনা-নেয়া, বিভিন্ন কোম্পানির বোর্ড মিটিং কভার থেকে শুরু করে অনেকে বিমানবন্দর থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়ায়ও ব্যবহার করছেন হেলিকপ্টার। কিন্তু প্রতিবার উড্ডয়নের জন্য সিভিল এভিয়েশন থেকে অনুমতি নিতে হয়। জ্বালানি সঙ্কটেও প্রায় ফ্লাইট বন্ধ রাখতে হয়। হেলিকপ্টার কোম্পানি শুরুর দিকে দুর্গম এলাকায় ভ্রমণ, সিনেমার শূটিং, ওপর থেকে প্রজেক্ট এলাকা পরিদর্শন, ছবি তোলা ইত্যাদি কাজের লক্ষ্য নিয়ে হেলিকপ্টার ভাড়া দেয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে দ্রুত যানজট এড়িয়ে গন্তব্য পৌঁছানোর জন্য কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে হেলিকপ্টার।
×