ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ এই ঘাতকও মহামারীর মতো সাংঘাতিক!

প্রকাশিত: ২১:০০, ১১ আগস্ট ২০২০

সিডনির মেলব্যাগ ॥ এই ঘাতকও মহামারীর মতো সাংঘাতিক!

বাংলাদেশেও করোনা এখন তার ভয়াল থাবা নিয়ে বিস্তার লাভ করেছে। মানুষের জীবন আছে মহাসঙ্কটে। একদিকে কোভিড-১৯-এর ছোবল আরেকদিকে খাদ্যাভাব আর অর্থকষ্ট। এমনও শুনছি কিছু কিছু মানুষের সামনে নাকি দুটো পথ খোলা। হয় করোনায় মরতে হবে নয়ত অপুষ্টিতে। মানুষ কোনটা বেছে নিতে পারে সেটা অনুমান করা কঠিন কিছু না। এই মহামারী এবং সমস্যা যখন দেশ ও জাতিকে প্রায় পাগল করে তুলেছে, তখন চোখের আড়ালে সমাজকে ধ্বংসের প্রায় শেষ সীমায় নিয়ে যাচ্ছে আরেক গুপ্ত সমস্যা। এটিকে এখন আর গোপন না বলাই সমীচীন। এই অন্ধত্ব বা উগ্রতা একদিনে তৈরি হয়নি। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর যে যখন গদিতে তার আমলে কোন না কোনভাবে এই প্রক্রিয়া বেগবান হয়েছে। আমরা ধরে নিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সময় এটি আস্তে আস্তে লঘু হয়ে পড়বে। বা, এর কার্যকারিতা নষ্ট করার কাজ চলবে। আসলে কি তা হয়েছে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাঙালী প্রেম ও বাঙালীয়ানাকে শ্রদ্ধা করেই বলি তাঁর অজান্তে তাঁর সামনে নানা ভাবে এই প্রক্রিয়া আজ এতটাই শক্তিশালী যে, সে এখন এক একচোখা দৈত্য। যাকে রোখা প্রায় অসম্ভব। আমরা ধরে নেই এটা নাকি ভারত বিরোধিতার ফসল! এক সময় তা ছিল। যখন মাওলানা ভাসানী থেকে শুরু করে চৈনিক বামেরা ফারাক্কা নিয়ে নানাভাবে মাঠ গরম করতেন। তখন তা এমনই ছিল। কিন্তু যতদিন গিয়েছে এরশাদ, খালেদা জিয়া এমন কি আওয়ামী লীগ আমলেও এর বিস্তার বেড়েছে। আজ এটা এমন এক রোগ, যার সংক্রমণ করোনার চাইতে কম কিছু না। বাড়তে বাড়তে এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে, মনে হতে পারে আর কোনদিন আমাদের জাতি এ ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পাবে না। এ ছাড়াও মানুষের ভেতর যে সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ, তাকেও গিলে ফেলেছে এই উগ্র অন্ধুত্ব। আপনি হয়ত ভাবছেন আমি শুধু হিন্দু বা অমুসলিমদের কথা বলছি। না। মোটেও না। আমার প্রথম উদাহরণটি এদেশের এক স্বনামধন্যা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। যাকে পুরো দেশ এমনকি পাশের দেশেও এক নামে সবাই চেনে। শান্তিনিকেতনের কৃতী ছাত্রী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা আমাদের জাতির সম্পদ। আমার মনে আছে শেখ হাসিনা যখন শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদি তাঁর ভাষণে সবার আগে যার নামটি উচ্চারণ করেছিলেন তিনি রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। এই কৃতী সন্তানটি যে শান্তিনিকেতনের ছাত্রী সেটাই বলতে চেয়েছিলেন মোদি। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তার গানের ভক্ত। চ্যানেল আইয়ের আয়োজনে বন্যার জন্মদিনে তিনি ফোন করে তাকে শুভেচ্ছা জানাতেও ভোলেননি। এসব তার কীর্তি। তিনি যখন করোনা আক্রান্ত স্বাভাবিক কারণেই তা সংবাদ। আর এই সংবাদটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা দেখলাম পঙ্গপালের দল কিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল! আমি নিজে এর ভুক্তভোগী। বিডি নিউজে অনেক লেখার মতামতে ‘মালাউন’ গালি শোনাটা আমার অভ্যাসের অংশ এখন। কিন্তু বন্যা তো কোন অমুসলিম নামের কেউ না। তার ধর্মীয় পরিচয় বাঙালী মুসলিম। তাছাড়া আপনি আমাকে এমন একটা ছবি বা কাহিনী দেখাতে পারবেন যেখানে তাকে উগ্র মনে হয়েছে? বরং তার স্বভাবের মতো, কথার মতো তিনি শীতল, শান্ত। সেই বরেণ্য নারী যখন কঠিন করোনা আক্রান্ত তখন দেশের এক বিপুল বিরাট জনগোষ্ঠী নেমে পড়ল তাকে অভিশাপ দিতে। অভিশপ্ত করতে। কি কারণ? তার অপরাধ তিনি রবীন্দ্রনাথ নামের এক হিন্দুর গান করেন। অথচ এই মূর্খরা জানেই না রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ছিলেন না। মূর্তি পূজাবিরোধী ব্রাহ্ম হলেও এদের চোখে তিনি হিন্দু। কমেন্টসগুলো কিন্তু উড়িয়ে দেয়ার মতো না। কেউ কেউ তাকে বলেছে কপালের টিপ মুছে নজরুলের গান গাইলে করোনা চলে যাবে! এদের দৌড় বা মগজে কি আছে তা এসব কথায় স্পষ্ট। বোকা ভ- লোকগুলো জানে না নজরুল কতগুলো শ্যামাসঙ্গীত বা কালী বন্দনা লিখেছেন। যেখানে রবীন্দ্রনাথ কখনও যাননি। নজরুলের মতো অসাম্প্রদায়িক বাঙালী মানুষকেও এরা প্রয়োজনে সাম্প্রদায়িক ঢাল বানাতে চেষ্টা করছে। তাদের এই মনোভাবকে পাত্তা না দেয়া বা কাউন্ট না করার পরামর্শদাতারাও মূলত এক ধরনের সাম্প্রদায়িক। এরা আমার চোখে কাকের মতো। কাক মানুষের বিষ্ঠা খাবার সময় চোখ বন্ধ করে ফেলে যাতে কেউ না দেখে। কিন্তু দুনিয়া যে তা দেখছে সেটা কাক টের পায় না। এরা মুখে এসব বলে মনে শান্তি পায় বটে, কিন্তু এটা ঠিক জানে দিনে দিনে এই অপকর্ম আজ পাহাড় হয়ে উঠেছে। চোখ বন্ধ করে তার অস্তিত্ব নেই বলা যাবে না। সত্যপ্রসাদ মজুমদার নামে বুয়েটের এক শিক্ষক সে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ লাভ করেছেন। সরকারের বুকের পাটা আছে বটে। এমন সমাজে শেখ হাসিনাকেই যখন বলা হয় ‘কওমি জননী’, সত্য প্রসাদ বাবু কি না উপাচার্য! ব্যস্ শুরু হয়ে গেল গালাগালি আর বীভৎস সব কমেন্টস। ঘোর কলিকালে সত্য যখন জীবনের সব জায়গা থেকে পালিয়ে বেঁচেছে, সেখানে বুয়েটে তিনি কি করবেন, তার জবাব দেবে সময়। তবে এটা দেখলাম মুক্তিযুদ্ধ আর অসাম্প্রদায়িক যে বাংলাদেশ, তা আসলে এখন প্রায় অলীক। এই বিকৃতি কতটা ভয়ঙ্কর তার সর্বশেষ উদাহরণ আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা মোহাম্মদ নাসিম। তার মৃত্যুর আগে যে উল্লাস আর পরবর্তীতে যে আস্ফালন, তা যদি আওয়ামী লীগ বুঝতে না পারে তবে তাদের কপালে দুঃখ আছে। আমাকে কেউ কেউ এমন কথা বলে সান্ত¦না দিয়েছেন, দেখুন ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর বেলায় কি এমন হয়েছিল? নাসিম সাহেব বিতর্কিত বলেই এমনটা। নাসিমের পিতা এদেশ পাকিস্তান থেকে মুক্ত করার নেতা ছিলেন আর নাসিম নিজেও ছিলেন আওয়ামী লীগের সামনের সারির নেতা। এটাই গালাগালির বড় কারণ। যেভাবেই আমরা দেখি না কেন পাক প্রীতি আর ভারত বিরোধিতার বল গড়াতে গড়াতে মাঠের বাইরে ছক্কা হাঁকিয়ে এখন সেঞ্চুরির পথে। কারও সাধ্য নেই একে ঠেকাতে পারে। কঠিন করোনাকালে মানুষ যখন একে অন্যের পাশে দাঁড়াতে মরিয়া, মানুষ যখন শুভ কামনা দোয়া আর আত্মবিশ্বাসের জন্য পাগল, তখন এই প্রবণতা কি মনে করিয়ে দেয়? রাজনীতির ভুল একমুখিনতা আর অচলায়তন কি এর জন্য দায়ী? না এর বাইরেও আছে নানাবিধ কারণ? মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব, ভারত বিরোধিতা, অমুসলিম বা বাঙালী সংস্কৃতির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব-সব মিলিয়ে উগ্রতা এখন বিষবৃক্ষ। আজ যা রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সত্য প্রসাদ বাবু কিংবা মোহাম্মদ নাসিমের জন্য সত্য, অচিরেই তা দেশের শীর্ষ থেকে নিম্ন-সর্বস্তরের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য। সত্যিকারের বুদ্ধিবৃত্তি আর মননহীনতার আকালে কে বা কারা পথ দেখাবেন? আদৌ আমরা বাঙালী থাকব কি-না, সেটাই এখন মৌলিক প্রশ্ন। তবু চাই, জয় হোক বাঙালীর, জয় হোক বাংলাদেশের। [email protected]
×