ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

আগস্ট ॥ বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরিদের দায়িত্ব

প্রকাশিত: ২০:১৬, ৬ আগস্ট ২০২০

আগস্ট ॥ বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরিদের দায়িত্ব

(গতকালের পর) যখন কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী পালনের জন্য অর্থের প্রয়োজন হতো, তখন দুই টাকা, পাঁচ টাকা ও দশ টাকার কুপন ছাপানো হতো। দশ টাকার কুপনের উপরে বঙ্গবন্ধুর ছবিটা হতো আকর্ষণীয়। শনিবার (রবিবার ছুটি থাকত। এরশাদ শুক্রবার ছুটি চালু করেন) আশি টাকা সাপ্তাহিক বেতন থেকে দশ টাকার কুপনটি কিনে কোন কোন শ্রমিক আত্মতৃপ্তি লাভ করত। এখন চায়ের দোকানে রাজনৈতিক আড্ডা উঠে গেছে। তখন এগুলো বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের দখলে থাকত। যারা এই চায়ের আড্ডায় বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে প্রাণপাত করত, তাদের কিন্তু কোন চাওয়া-পাওয়া ছিল না। কোথাও কারও কাছে বঙ্গবন্ধুর একটা ছবি দেখলে তারা খুশিতে আত্মহারা হতো। বঙ্গবন্ধুর সময়ের পাঁচ টাকার নোটের উপরে তাঁর আকর্ষণীয় ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ছবি দেখে এক শ্রমিককে একদিন কেঁদে ফেলতে দেখেছি। এই শ্রমিকের আর কিছু পাবার ইচ্ছে ছিল না। কৃষকরাও অনুধাবন করে তাদের বন্ধু ছিলেন শেখ মুজিবই। এই যে শহর গ্রামে লাখো সমর্থক তাদের একমাত্র চাওয়া ছিল যদি বঙ্গবন্ধুর ছবিটা নির্বিঘ্নে দেখা যায়। এরমধ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফেরেন। ১৯৮১’র ৭ মে বিমানবন্দরে লাখো মানুষের ঢল নামে। প্রচন্ড বৃষ্টি উপেক্ষা করে তারা অপেক্ষা করে। ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ধীরে ধীরে বিভিন্ন অঞ্চল সফর করতে শুরু করেন। আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো যূথবদ্ধ হতে থাকে। শেখ হাসিনার মধ্যে কর্মীরা বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পায়। তাদের কাছে তখন ক্ষমতা বড় কথা নয়; বঙ্গবন্ধুর কন্যার ছবি পত্রিকার পাতায় ছাপা হচ্ছে- এটাই তাদের শান্তি। ইতোমধ্যে তিনি দলকে ঐক্যবদ্ধ করেন। কিন্তু এরশাদ এসে আবার অনেককে ভয় দেখিয়ে অথবা মন্ত্রিত্ব দিয়ে কিনে ফেলেন। তারপরও সংগঠনের শক্তি কমেনি। ’৯৬ এ ক্ষমতায় আসার পর দলের তৃণমূল থেকে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত সর্বত্রই মনে হতো যে, আওয়ামী লীগই রাষ্ট্র ক্ষমতায়। কারণ তখনও পুরনো নেতাকর্মীরা জীবিত ছিলেন, সংগ্রামীরা সামনে ছিলেন, নিবেদিতপ্রাণ ও আত্মত্যাগীদের হাতে দলের ক্ষমতা ছিল। ধীরে ধীরে সুবিধাবাদীরা দলে ভিড়তে থাকে। বঙ্গবন্ধুর নামে তারা মুখে ফেনা তোলে। কিন্তু তাদের অন্তরে বঙ্গবন্ধু নেই। ’৯১ এর নির্বাচনে সংসদীয় আসনগুলোতে বিএনপির মনোনয়ন দেয়াই কঠিন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু টাকার জোর ও জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে গোপন ঐক্য তাদেরকে বিজয়ী করে। ফলে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগও টাকাওয়ালা লোকদের দলে ভেড়ার সুযোগ করে দেয়। এ ছাড়া তাদের কোন উপায় ছিল না। কারণ জিয়া-এরশাদ ও খালেদার সময়ে অর্থ যেভাবে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে আওয়ামী লীগের হাত গুটিয়ে বসে থাকা সম্ভব ছিল না। ফলে নিবেদিতপ্রাণ ও প্রান্তিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নেতৃত্বের দুরত্ব তৈরি হতে থাকে। সংসদীয় আসনগুলোতে নতুন লোকেরা বসে স্থানীয় কমিটিগুলোতে তাদের পছন্দের মানুষ বসাতে শুরু করেন। ছিটকে পড়তে শুরু করে সর্বস্ব হারানো কর্মীরা। সামরিক-বেসামরিক আমলারাও দলে প্রবেশ করে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অবহেলা করতে শুরু করেন। এভাবে আসল আওয়ামী লীগের চেহারায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। কিন্তু ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে। বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটাই লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগকে হারানো। তাছাড়া বৃহত্তর জোট গঠনেও আওয়ামী লীগের অনীহা ছিল। কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী ৪ দলীয় জোট সরকারের শুরুতেই তারা দেশে যে তান্ডব শুরু করে প্রাথমিক অবস্থায় তা রুখে দেবার অবস্থা নেতা-কর্মীদের ছিল না। ধীরে ধীরে শেখ হাসিনা শক্তি সঞ্চয় করেন। নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকেন। বিএনপি-জামায়াত প্রকৃতপক্ষে দেশে একটি সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘকালের সংগ্রামী, সৎ ও মেধাবী নেতাদের জোটের দুর্বৃত্তরা বেছে বেছে খুন করতে থাকে। ২১ আগস্টের মতো ঘটনায় নেতা-কর্মীরা হত-বিহ্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু আবার যেন ভস্ম থেকে জেগে ওঠে দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী। আবার সেই পুরনোরা, নবাগতরা ঘরে বসে থাকে অথবা পালিয়ে চলে যায়। ২০০৭ এ শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের পর হাজারো নেতা-কর্মী রাস্তায় নামে। তিনি সাবজেলে থাকা অবস্থায় ডিআইজি প্রিজন শামসুল হায়দার সিদ্দিকীর ভাষ্য শোনার জন্য আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা রাস্তায় বসে থাকতেন। আজকের শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এই নিয়মিতদের মধ্যে একজন। তখনও আওয়ামী লীগের শক্তি এদেশের মানুষ অনুধাবন করেছে। পরবর্তীতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে যে কাউন্সিল অধিবেশন হয় মাঠের সকল নেতা সেখানে উপস্থিত হন এবং শেখ হাসিনার মুক্তির জন্য জীবন দিতে শপথ নেন এবং সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে দেন। এই হলো আওয়ামী লীগ। যত নির্যাতন, ততই জেগে ওঠা। আজ ১২ বছর যাবত আওয়ামী লীগ একাদিক্রমে রাষ্ট্র ক্ষমতায়। এই সময়ে সরকার, প্রশাসন ও দলে অনেক সুবিধাবাদী ও অসৎ লোকেরা বিভিন্নভাবে ঢুকে পড়েছে। বাংলাদেশের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস নেই এমন পরিবারের সন্তানেরা বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছে। কৌঁসুলি অনেক কর্মকর্তা অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে জায়গা বদল করে সুবিধা নিচ্ছেন। এখন মানুষের কল্যাণের আমলাতন্ত্র অনেক বেশি কাক্সিক্ষত। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা সঙ্কুচিত হচ্ছে। একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্র আবশ্যক। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদেরকে পাশ কাটিয়ে নয়। জনপ্রতিনিধি অনিয়ম করলে তাকে পুনরায় মনোনয়ন না দিয়ে আইনের আওতায় নেয়া যেতে পারে। স্থানীয় সমস্যাদি সম্পর্কে জনপ্রতিনিধিরা বেশি অবগত। সেজন্য বাকশালে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বঙ্গবন্ধু বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আগস্ট মাসে বাংলাদেশের মানুষ শোকার্ত থাকে। বিশেষ করে প্রকৃত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পারিবারিক উৎসব আয়োজনেও বিরত থাকে। পুরো আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রীও শোকাচ্ছন্ন থাকেন। এ মাসেই প্রকৃত নেতা-কর্মীদের শপথ নেয়া দরকার যে, তারা এ দেশে আর কোন রাজনৈতিক হত্যাকা- ঘটতে দেবে না, তারা নতুন কোন ১৫ আগস্ট বা ২১ আগস্টকে রুখে দেবে। সুবিধাবাদী, টাউট বাটপাড় ও অর্থলোলুপদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে এবং অসাম্প্রদায়িকতা ও সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য যে আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন সংগ্রাম করছে, নেতা-কর্মীরা সেই আওয়ামী লীগকে আঁকড়ে থাকার শপথ নেবে। (সমাপ্ত) লেখক : উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
×