ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার ভুয়া টেস্টে বিশ্বে প্রবাসীদের কর্মজীবন হুমকির মুখে

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২৪ জুলাই ২০২০

করোনার ভুয়া টেস্টে বিশ্বে প্রবাসীদের কর্মজীবন হুমকির মুখে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ করোনার ভুয়া টেস্টে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে এবং প্রবাসীদের কর্মজীবন হুমকির মুখে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বৃহস্পতিবার দুপুরে উত্তরার বাসা থেকে দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। পদত্যাগকারী স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের বিচার দাবি করে ফখরুল বলেন, তিনিই করোনা টেস্টের জালিয়াতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তাই তাকে তো বরখাস্ত করা উচিত ছিল। আর শুধু স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকই নন, এর সঙ্গে আরও যারা যারা জড়িত আছেন, যারা তথ্য দিয়েছেন জনগণকে তাদের ওপরও দায়-দায়িত্ব বর্তায়। এর দায় নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীরও পদত্যাগ করা উচিত। ফখরুল বলেন, করোনা মহামারীর এই চরম মানবিক বিপর্যয়ের সময়ও দেশব্যাপী চলমান দুর্নীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি আরও চরম আকার ধারণ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই যখন করোনা টেস্টের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট প্রতারক মহলের ভুয়া নেগেটিভ সার্টিফিকেট প্রদানের লোমহর্ষক কাহিনী উন্মোচিত হলো। বিএনপি মহাসচিব বলেন, সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল এবং আরিফ ও সাবরিনার জেকেজি পরীক্ষা না করেই মানুষকে বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশীদের করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট ইস্যু করেছে। তাতে একদিকে সংক্রমণের হতাশাব্যঞ্জক ঝুঁকিতে পড়েছে গোটা জাতি, অন্যদিকে বিশ্ব দরবারে দেশীদের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণœ হয়েছে। ফখরুল বলেন, করোনা টেস্ট কেলেঙ্কারির কারণে কয়েকটি দেশে বাংলাদেশী যাত্রীরা পড়েছে সঙ্কটে। বাংলাদেশের বিমানবন্দর পার হয়ে যাওয়া কিছু যাত্রীর মধ্যে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ায় কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট পরিচালনা নিষিদ্ধ করেছে। এ পর্যন্ত সাময়িক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশগুলোর মধ্যে আছে ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন। মির্জা ফখরুল বলেন, করোনা সংক্রমণের ভয়ে সব দেশই কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করছে। বিশ্বের বহু দেশ সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে করোনা পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো বাংলাদেশ সেটা পারেনি। ঢাকা থেকে বিভিন্ন দেশের ফ্লাইট বন্ধ ঘোষণাটি কেবল প্রবাসী বাংলাদেশীদের সমস্যাই নয়, এর সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রত্যেক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। তাই এই খাতে দারুণভাবে নেতিবাচক প্রভাবে পড়বে। তাছাড়া করোনার আগে উড়োজাহাজ ভর্তি করে যারা বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন, তাদের অনেকেরই ফিরে আসার ব্যাপারটি কিন্তু দেশের করোনা ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভরশীল। পর্যটন খাত পুনরুজ্জীবন এবং তার আরও বিকাশ, কিংবা বিদেশে শ্রমবাজারের আরও সম্প্রসারণের সঙ্গেও এ বিষয়ের একটি যোগসূত্র রয়েছে। ফখরুল বলেন, ভুয়া করোনা পরীক্ষার সার্টিফিকেট দেয়ায় ইতালির পত্রিকার শিরোনামে বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে যাওয়া বিমানকে তারা করোনাভাইরাসবাহী বোমা বলে আখ্যায়িত করেছে। করোনা পরীক্ষার ভুয়া সনদ বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ইতালির প্রথম সারির গণমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে প্রবাসীরা ইতালিতে গেছেন বলে শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে। যাদের সবার কাছে কোভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ ছিল। ইতালির বিমানবন্দরের পরীক্ষায় পজিটিভ আসার পর তারা স্বীকার করেন, ঢাকা থেকে তারা সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ, ১০ বা আরও বেশি পরিমাণ টাকা দিয়ে করোনা নেগেটিভ সনদ সংগ্রহ করেছেন। এতে যারা ইতালির বাইরে আছেন, ৫ অক্টোবর পর্যন্ত তারা যেতে পারছেন না। তাদের কাজ থাকা নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ফখরুল বলেন, কাগজ-পত্রহীনদের বৈধতার সুযোগ দিতে যাচ্ছিল ইতালি সরকার। বাংলাদেশীদের জন্য সেই সুযোগ কতটা কার্যকর থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাছাড়া এর ফলে ইতালিতে যে সকল বাংলাদেশী অভিবাসী অবস্থান করছে, করোনামুক্ত সার্টিফিকেট ছাড়া তারা কাজে যোগদান করতে পারছে না। প্রবাসী শ্রমিক ও বাংলাদেশী অভিবাসীরা রয়েছেন মহাসঙ্কটে। সব কিছু মিলিয়ে ইউরোপে বাংলাদেশীদের অন্যতম আশ্রয়ের দেশ ইতালি ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে। পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, দীর্ঘ সময় বিমান চলাচল বন্ধ থাকার পর সীমিত পরিসরে তা চালু হলেও শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পতাকাবাহী বিমান ও আমাদের সবুজ পাসপোর্টের মান মর্যাদার বিষয়টিও এখন এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। কাতার এয়ার ওয়েজের আরেকটি ফ্লাইটে থাকা ১২৫ জন বাংলাদেশীকে রোম বিমানবন্দর থেকে আবার ফেরত পাঠানো হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে সব ফ্লাইট এক সপ্তাহের জন্য নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ফ্লাইটটি কিভাবে দেশত্যাগ করল? এটি সমন্বয়হীনতা ও অপরিণামদর্শিতার উদাহরণ। তিনি বলেন, শুধু ইতালি নয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, করোনাভাইরাস টেস্টের মান যদি উন্নত না হয় তাহলে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বেকায়দায় পড়তে পারে বাংলাদেশ। ফখরুল বলেন, ঢাকাস্থ বিদেশী কূটনীতিকদের করোনা টেস্টের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইয়ার মার্কড হাসপাতালগুলোর মধ্যে রিজেন্ট হাসপাতাল অন্যতম। রিজেন্টের নাম স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অন্তর্ভুক্ত করেছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়। ঢাকাস্থ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশী কূটনীতিকরা এপ্রিল ও মে মাসে দলে দলে ঢাকা ত্যাগ করে কেন আমরা কি কখনও নিজেদেরকে প্রশ্ন করেছি? তাদের নিজ দেশে পরিস্থিতি ঢাকা থেকে নিরাপদ ভেবেই তো তারা চলে গেছেন। একটি আন্তর্জাতিক রিপোর্টে বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকায় করোনা সংক্রমণে জীবন হানির যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে তাকে তারা আমলে নিয়েছে। তারপর যোগ হয়েছে ভুয়া হাসপাতালকে কূটনীতিকদের টেস্টের জন্য চিহ্নিতকরণ। এটাকে কূটনৈতিকদের চলে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ আমজনতা না জানলেও কূটনীতিকরা ঠিকই খবর নিয়েছে রিজেন্টের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে। তিনি বলেন, করোনা টেস্টের ক্ষেত্রে উচ্চমান বজায় রাখার বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে আগামী দিনগুলোতে দেশকে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে। ফখরুল বলেন, টেস্ট না করেই করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট ও সার্টিফিকেট প্রদানকারীদের হোতা রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান প্রতারক সাহেদ এবং একটি বিশেষায়িত হাসপাতালে কর্মরত জেকেজির ডাক্তার সাবরিনার প্রতারণার কাহিনী ইতোমধ্যে সবাই অবগত আছেন। প্রশ্ন হলো ২০১৪ সাল থেকেই রিজেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্স অবৈধ জানা সত্ত্বেও হাসপাতালটিতে করোনা টেস্ট ও চিকিৎসার জন্য সরকার কিভাবে চুক্তি করল? উক্ত চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিবসহ কয়েক সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এ ধরনের চুক্তি সই অনুষ্ঠানে মন্ত্রীরা উপস্থিত থাকার প্রটোকল নেই। প্রটোকল ভেঙ্গে এ ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে মন্ত্রীর উপস্থিতি এবং অনুষ্ঠানটির ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বহুল প্রচার করার সঙ্গে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনেকেই জড়িত রয়েছেন। কারণ, বহুরূপী এ সাহেদের হাত অনেক লম্বা। ফখরুল বলেন, চুক্তি অনুযায়ী রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি বিনামূল্যে করোনা টেস্ট ও চিকিৎসা দেবে এবং সরকার এ ব্যয় বহন করবে। কিন্তু একদিকে তারা রোগীদের বিপুল পরিমাণ বিল পরিশোধে বাধ্য করেছে, অপরদিকে চিকিৎসা বাবদ সরকারের কাছে কোটি কোটি টাকার বিল জমা দিয়েছে। সীমাহীন অনৈতিকতার এর চেয়ে নগ্ন উদাহরণ আর কি হতে পারে? মির্জা ফখরুল বলেন, এদিকে রিজেন্ট ও জেকেজির ভুয়া টেস্ট রিপোর্ট দেয়ার মতো ঘটনায় মানুষ রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। ফলে অনেকে স্বাস্থ্যগত সমস্যায় টেস্ট করানোর পরিবর্তে বাসাবাড়িতে অবস্থান করে নিজের মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাচ্ছেন। এতে করে অনেকেই করোনায় মারা গেলেও তা হিসেবে আসছে না। ফলে কত মানুষ করোনায় মারা গেল তা বোঝা যাচ্ছে না। এতে যে সমস্যা হবে সেটি হলো, সরকার করোনার প্রকৃত পরিস্থিতিটা বুঝতে পারবে না। পরিস্থিতির গুরুত্ব না বুঝলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ারও প্রশ্ন উঠবে না। মানুষ যেমন বিনা চিকিৎসায়, বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন তেমনই প্রাণ হারাতে থাকবেন। এটি কোন স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়, অরাজকতা। ফখরুল বলেন, একদিনে করোনাভাইরাস শনাক্তের সংখ্যার দিক দিয়ে এশিয়ায় প্রথম ভারত, এর পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। আর মৃত্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। দেশে করোনাভাইরাসে প্রথম মৃত্যুর চার মাসের মাথায় সরকারী হিসেবে মৃতের সংখ্যা পৌঁছে যায় আড়াই হাজারে। সীমিত পরীক্ষা সত্ত্বেও দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার বলছে, ঝুঁকি এখনও উর্ধমুখী। কিন্তু সংক্রমণ রোধে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামাজিক দূরত্বের ধারণাটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছেনা ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে। রাজধানীর চিত্র দেখলে মনে হয়, স্বাস্থ্যবিধি এখানে পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে। অথচ মহামারী চলাকালীন বিশ্বজুড়ে এটিই হচ্ছে প্রমিত অনুশীলন। দেশে লকডাউন প্রত্যাহার করার পর থেকে বেশির ভাগ মানুষই এই নির্দেশনা অমান্য করে চলেছে। মাস্ক না পরলে জরিমানা করার যে বিধান প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে তা বাস্তবে দেখা মিলছে না। এজন্য সরকারের সমন্বয়হীনতা ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তই দায়ী বলে আমরা মনে করি। বিএনপি মহাসচিব বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই স্বাস্থ্য সামগ্রীসহ সরকারী বিভিন্ন সামগ্রী কেনাকাটায় চরম দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যখন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, যখন সরকারী হিসেব মতেই দৈনিক প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন করে করোনা রোগী মারা যাচ্ছে তখন স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বহীনতা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের শামিল। তাই স্বাস্থ্য খাতের জবাবদিহিতাহীন দুর্নীতির দায় দায়-দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে।
×