ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় টক জাতীয় ফলের কদরও বেড়েছে, দাম চড়া

শেষ হয়ে আসছে সুস্বাদু আমের চালান, দামও বাড়ছে

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ১৮ জুলাই ২০২০

শেষ হয়ে আসছে সুস্বাদু আমের চালান, দামও বাড়ছে

ওয়াজেদ হীরা ॥ ক্রমেই কমে আসছে রসালো ফল আম। যা পাওয়া যাচ্ছে তারও মূল্য বেশ চড়া। আম যতই কমে আসছে ততই একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে দাম। ইতোমধ্যেই হিমসাগর, গোপালভোগ নেই বললেই চলে। বাজারে এখনও পাওয়া যাচ্ছে আম্রপালি, হাঁড়ি ভাঙ্গা, ল্যাংড়া, লক্ষণভোগ। এছাড়াও করোনাভাইরাসে ভিটামিন ‘সি’ (টক জাতীয়) সমৃদ্ধ ফলের কদর বেড়েছে অনেক। ফলে এই ধরনের ফলেরও দাম বেড়েছে। গত মে মাস থেকে বাজারে আসতে শুরু করে বিভিন্ন জাতের আম। দেখতে দেখতেই যেন শেষ হয়ে গেল। যদিও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাজারে আম পাওয়া যায়। তবে শেষের দিকে আম বাজারে কম থাকার কারণে দামও বেড়ে যায়। জানা গেছে, সারাদেশে বিভিন্ন নামের অর্ধশতাধিকের বেশি আম রয়েছে। এর মধ্যে সবার আগে মে মাসের মাঝামাঝি হতে বাজারে আসে গুটি আম। এরপর নানা নামের আম বাজারে আসতে থাকে। সবার শেষে ১০ জুলাই থেকে আশ্বিনা এবং বারী-৪ আম আসা শুরু হয় যা সেপ্টেম্বর মাঝামাঝি পর্যন্ত বাজারে থাকে। গত এক দশকে ১৮ লাখ টনের বেশি ফল উৎপাদন হয়েছে যেখানে ভূমিকা রয়েছে আমেরও। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, গত বছরের চেয়ে এ বছর জমি এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা দুটোই বেড়েছে। অধিদফতরের হর্টিকালচার উইংয়ের তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৩৬ হেক্টর জমিতে আমের উৎপাদন হয় ২২ লাখ ২৮ হাজার ৯৭২ মে.টন। এ বছর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে যেখানে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ২২ লাখ ২৯ হাজার একশ’ মে.টন। হর্টিকালচার উইংয়ের পরিচালক কবীর হোসেইন জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমের রাজধানী চাঁপাইয়ে আমের উৎপাদন হয় বেশি। গতবার ৩০৮ মে. টন আম রফতানি হয়েছে যার ৩০ শতাংশ মধ্যপ্রাচ্যের দেশে বাকিগুলো ইউরোপ আমেরিকা জাপানে। এদিকে, গত কয়েক মাস বাজারে পর্যাপ্ত আম সরবরাহ ছিল, দামও ছিল সাধ্যের মধ্যে। খুচরায় কোথাও কোথাও ৫০ টাকা কেজি দরেও আম বিক্রি হয়েছে। তবে এখন বেশিরভাগই ১০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে কোথাও কালেভদ্রে ৮৫-৯০ টাকা পাওয়া যাচ্ছে। সামনে আমের দাম আরও বাড়ার কথা বলছেন খুচরা বিক্রেতারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় আমফানে আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এরপরও আমের ফলন ভাল হয়েছে। সরবরাহও ছিল স্বাভাবিক। যে কারণে তুলনামূলক কম দামেই এবার আম বিক্রি হয়েছে। এখন আম কমে আসছে, তাই দামও বাড়ছে। ফলের পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজার সর্বত্রই দাম কিছুটা বেড়েছে। ফলের পাইকারি বাজার ওয়াইজঘাট ফল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ কুদ্দুস জনকণ্ঠকে বলেন, আম কমে আসতেছে, তাই কিছুটা দাম বেড়েছে। হিমসাগর, ল্যাংড়া কমে গেছে। এখন আম্রপালি পাওয়া যাচ্ছে। ভাল মানের আম্রপালি বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা বা একটু বেশি। আর নিম্ন মানের একটু কম। এই আম খুচরায় বিক্রি করতে গেলে খুচরা বিক্রেতারাও তো লাভ করবেন। একাধিক বিক্রেতা জানান, কিছুদিন আগেও আম্রপালি ৪৫-৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। এখন যত দিন যাচ্ছে আম কমে আসতেছে। আড়ত-এ দাম বেশি। তাই বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে, এখনও বাজারের পাশাপাশি ভ্যানে করে বিভিন্ন স্থানে আম বিক্রি হচ্ছে। তবে বাজারে আর ভ্যানের দামের পার্থক্য খুব একটা নেই। অথচ কদিন আগেও দুই জায়গায় দামের পার্থক্য ছিল কেজিতে ২০-২৫ টাকা। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আম্রপালির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকা। হাঁড়ি ভাঙ্গা ১০০-১২০ টাকা কেজি। ল্যাংড়ার কেজি ১০০-১৫০ টাকা। মগবাজারের ফল ব্যবসায়ী ছমির মিয়া বলেন, সামনেও আম আসবে। তবে দাম আরও বেশি থাকবে। ফজলি আম বড় হয়। একটিই এক কেজির মতো হয়। এখন আমের মৌসুম শেষের দিকে তাই দামও বাড়তি। হাতিরপুলের বিক্রেতা জুলহাস মিয়া বলেন, অনেক আম ইতোমধ্যেই ফুরিয়ে গেছে। কিছু ফুরানোর পথে। আবার কিছু জাতের আম সামনে আসতেছে। হিমসাগর এখন একেবারেই নেই। আম্রপালি ও ল্যাংড়া জাতের আমও শেষের পথে। হাড়িভাঙ্গা আম আছে। এরই মধ্যে ফজলি আসবে। তবে দাম এখন বাড়তি। পাইকারিতেও বাড়তি দাম তাই খুচরাও বেড়েছে। কাওরান বাজারে আম কিনেন আশিকুর রহমান। পেশায় এই ব্যাংকার জানান, সার্বিকভাবে এ বছর আম করোনার অজুুহাতে বাড়েনি। গতবছরের মতোই সাধ্যের মধ্যেই ছিল। তবে এখন একটু বেশি, এটাও ঠিক আম কমে আসছে। আমি গত মাসে ৫০-৬০ টাকা কেজি ধরে আম কিনেছি এখন ১০০ টাকা ধরে কিনতে হচ্ছে সামনে হয়তো আরও বাড়তেও পারে। একই বাজারের বিক্রেতা হালিম মিয়া বলেন, গত দশ দিনের ব্যবধানেই আমের দাম অনেক হয়েছে। একটি করে দিন যাচ্ছে দামও বাড়ছে। কিছুদিন আগেও আম্রপলি কেজি ৪০ টাকায়ও বিক্রি করেছি। ল্যাংড়া ৫৫- ৬০ টাকা কেজি বিক্রি করেছি। এখন আম্রপালি ৮০ টাকা এবং ল্যাংড়া ১০০টাকার উপরে। রাজধানীর পাইকারি ফলের আড়তগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায় এখন আমের পাইকারি বাজারও একটু বাড়তি। পাইকারি বিক্রেতারাও বলেন আমের মৌসুম শেষ হওয়ার দাম কিছুটা বেড়েছে। শঙ্কা কাটিয়ে খুশি চাষীরাও ॥ করোনায় এবার বাগানের আম বিক্রি করে লগ্নির অর্থ তোলা যাবে কি না তা নিয়ে এবার দুশ্চিন্তায় ছিলেন চাষী থেকে বিক্রেতা সবাই; তবে সেই শঙ্কা কেটে ভাল দামই পেয়েছে চাষীরাও। উত্তরাঞ্চলের আমচাষী আর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিপণনকর্মীরা জানান, অন্য বছরের তুলনায় দাম এবার ভালই পেয়েছে। ভাল বিক্রি হওয়ায় ক্ষতির শঙ্কা কেটে গেছে। দুই হাজারের বেশি ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেইজের সঙ্গে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলো যুক্ত রয়েছে আম বেচাকেনায়। মহামারীর কারণে এবার সরকারীভাবে ডাক বিভাগ ও রেলওয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় আম বাজারে পৌঁছে দেয়ায় বাগানমালিক কিংবা আমচাষীদের খুব একটা ঝামেলায় পড়তে হয়নি। গত ৮ জুন থেকে প্রতিদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় ট্রেনে করে ৭-৮ টন আম যাচ্ছে। এজন্য ব্যবসায়ীদের কেজি প্রতি এক টাকা ৩০ পয়সা করে দিতে হচ্ছে। ফলের দোকানগুলোও অন্য বছরের মতো আম বিক্রি করতে পারছে। এছাড়া ১৩ জুন থেকে প্রধান ডাকঘর তাদের গাড়িতে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় প্রতিদিন পাঁচ টন আম পরিবহন করছে। সেজন্য কোন চার্জ দিতে হয় না। চাঁপাইয়ের ওয়াহাব নামের এক ব্যবসায়ী জানান, যে শঙ্কা ছিল কেটে গেছে। সবাই বেশ ভাল দাম পেয়েছে। মেহেরপুরের আম ভাল হয় বলে সেখানে লগ্নি করেন জমির মিয়া। তিনি বলেন আমফানে প্রায় চারশ’ গাছের ৭০ ভাগ আম নষ্ট হয়। এত ক্ষতি আগে কখনও তার হয়নি। তবে তারপরও লোকসান গুণতে হয়নি তাকে। তিনি বলেন, বিক্রি করে লাভ না হলেও লোকসান হয়নি। হয়তো ঝড়ে ক্ষতি না হলে একটু লাভ হতো। ভাল দাম পেয়েছেন রাজশাহী ও নওগাঁর চাষীরাও। সাপাহারের এক আমচাষী মুঠোফোনে জানান, আম বিক্রি করে ভাল দাম পাওয়ার কথা। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মকর্তাদের নানা সহযোগিতার কথাও বলেন। সাপাহার আম আড়তদার সমিতির সভাপতি কার্তিক চন্দ্র সাহা এর আগে জানিয়েছেন, এবার চাষীরা গত বছরের প্রতি মণ আমে অন্তত ৩০০ টাকা বেশি পাচ্ছে। বেড়েছে টক জাতীয় ফলের চাহিদা ও দাম ॥ এদিকে আমের মতো টক জাতীয় ফলেরও দাম বেড়েছে। তবে অন্যান্য বছর টক জাতীয় ফলের দাম বৃদ্ধি পায় না। এবার করোনার অজুহাতে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ প্রায় সব ধরনের ফলের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আমলকীর। ডাক্তারের পরামর্শ মতে করোনায় ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফল যে কোন ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে সহায়ক। শরীরের জন্য ভাল। আর এতেই এই ধরনের ফল খাওয়াও বাড়িয়েছেন মানুষ। এতে করে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়েছে। করোনা হোক আর না হোক বাসায় সবাই এই ভিটামিন ‘সি’ (টক জাতীয়) ফল রাখছেন। তবে এসব ফলের দাম বাড়া নিয়েও তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বিক্রেতারা বলছেন, চাহিদার তুলনায় সামান্যতম ফল আসায় দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। আর ক্রেতারা বলছেন, মানুষ যে কোন উছিলায় দাম বৃদ্ধি করে। এখন করোনার অজুহাতে দাম বাড়িয়েছে। এই ধরনের টক ফল আসে শ্যামবাজারে। বাজারের একাধিক ব্যবসায়ীও জানান বাজারে টক জাতীয় ফলের দাম অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি চাহিদাও বেশি। বাজার ঘুরে দেখা যায়, ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফলে ঠাসা। বর্তমানে আমলকী বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১২শ’ থেকে আরও বেশি অথচ বছরের অন্য সময়ে আমলকী সর্বোচ্চ ১৫০ টাকার মধ্যে থাকে। বর্তমানে এসব ফলের দাম বেড়েছে আট থেকে নয় গুণ পর্যন্ত। আর অড়বরই প্রতি কেজি ৬০০-৭০০ টাকা, করমচা প্রতি কেজি ৫০০-৬০০ টাকা। অন্যান্য বছর এসব ফল ১০০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে বাজারে পাওয়া যেত। করোনাকালে এসব ফলের দাম আকাশছোঁয়া। ফলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব ফল কেউ ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম হিসেবে কিনছেন। যেখানে ১০০ গ্রাম ফলের দাম পড়ছে ৫০ টাকারও বেশি। প্রতি কেজি কামরাঙ্গা বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা, প্রতি কেজি লটকন বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা, জাম ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা। আমড়া ২০০ থেকে ২২০ টাকা, মাল্টা ২০০ থেকে ২২০ টাকা কেজি, জামরুল বিক্রি হচ্ছে কেজি ২০০ টাকা ধরে। কিছু দিন আগে লেবুর দাম কমলেও আবার একটু একটু করে লেবুর দাম বাড়তে শুরু করেছে। এর আগে বাজারে প্রতি লেবু ছয় থেকে আট টাকার মধ্যে পাওয়া গেলেও বর্তমানে তা ১৫ টাকা হাঁকা হচ্ছে। ফার্মগেটের এক বিক্রেতারা বলেন, টক ফলের সরবরাহ কম তাই দাম বেশি। একই বাজারে ক্রেতা ইমরুল হাসান সুমন বলেন, আমাদের দেশে কোন পণ্যে সেটি যাই হোক দাম বাড়ানোর কোন ইস্যু লাগেনা। যে কোন উছিলায় দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। করোনায় টক জাতীয় ফল ভাল শুনেই দাম বেড়েছে বলেই মনে করি। একাধিক ক্রেতা বলেন, বাজারে যদি সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকে তবুও বাড়তি মূল্য নেয়া হয় তাহলে সরকারের পক্ষ্য থেকে পরিচালিত বিভিন্ন সংস্থার অভিযান আরও বাড়ানো উচিত। এর কারণ হিসেবে বলেন, একজন কৃষক বা উৎপাদক টাকা না পেয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের এমন অত্যাচার মানা যায় না।
×