ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মাকিদ হায়দার

আমাদের দাদুভাই

প্রকাশিত: ২১:১৯, ১৫ জুলাই ২০২০

আমাদের দাদুভাই

আমরা কেবলই দুঃখ এবং অসুবিধা বহন করি, কিন্তু দায়িত্ব বহন করতে চাই না। রবীন্দ্রনাথ পথের সঞ্চয় প্রবন্ধে ওই রকমই জানিয়েছেন। আমরা পরবর্তীতে জেনেছি তাকেই হাজার রকমের দায়ভার গ্রহণ করতে হয়েছে। জমিদারি থেকে শুরু করে প্রজাদের সুখ-দুঃখের ভার তিনি কখনই এড়িয়ে যেতে পারেননি। মানবিক গুণাবলীতে একজন সম্পন্ন মানুষ হিসেবেই তাকে দেখতে হয়েছে। এত অজ¯্র বিষয়ে জানতে হয়েছে, শুধু শিল্প-সাহিত্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলেও প্রাধান্য দিয়েছিলেন নিজ দায়িত্বের প্রতি এবং কখনই সচেতনভাবে এড়িয়ে যাননি তার যাবতীয় দায়িত্ব। আমাদের হায়দার পরিবারের দুই অগ্রজ জিয়া হায়দার এবং রশীদ হায়দার। দুজনই সানন্দেই দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন অনুজদের শিক্ষাদীক্ষায় আলোকিত করার। পঞ্চাশ দশকের শেষ দিকে জিয়া ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৬১ সালে পাস করার আগ পর্যন্ত তিনি অবজারভার গ্রুপের ‘পল্লীবার্তায়’ এবং এর কিছুদিন পরে সাপ্তাহিক ‘চিত্রালীতে’ পার্টটাইম চাকরির সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছিলেন তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা কেন্দ্রের ঘোষক হিসেবে। ইতোমধ্যেই কবি এবং গীতিকার হিসেবে পেয়েছিলেন প্রতিষ্ঠা। উপরন্তু এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী। এমএ পরীক্ষার রেজাল্টের পর পরই চাকরি পেয়েছিলেন শিক্ষকতার নারায়ণগঞ্জের তুলারাম কলেজে। অপরদিকে আমাদের দাদু ভাই রশীদ হায়দার, ১৯৬১ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। পাবনা থেকে ঢাকায় আসতে তখনকার দিনে মাত্র দুই দিন সময় লাগত। দাদু ভাই ঢাকায় আসার আগেই সোনা ভাই (জিয়া হায়দার) পুরান ঢাকার বেচারাম দেউরিতে একটি বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। সেই ভাড়া বাসাতেই এসে একত্রে থাকাকালীন সময়ে জিয়া ভাইÑ [সাপ্তাহিক চিত্রালীতে সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ, যিনি এসএম পারভেজ নামেই ছিলেন খ্যাত।] একদিন এসএম পারভেজের কাছে দাদুভাইকে নিয়ে গিয়ে পরিচয় পর্ব শেষে অনুরোধ করেছিলেন, আমার চিত্রালীর পার্টটাইম চাকরিতে রশীদকে দিতে হবে। সেই আলোচনায় সৈয়দ শামসুল হক এবং ফজল শাহাবুদ্দীন জানতে চেয়েছিলেন রশীদ লেখাপড়া কোথায় করে। দাদু ভাই কিছু বলার আগেই জিয়া ভাই জানিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা প্রথম বর্ষে। সৈয়দ হক উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন চিত্রালী হচ্ছে সিনে পত্রিকাÑ মাঝে মাঝে এফডিসিতে যেতে হবে এবং নায়ক-নায়িকাদের ইন্টারভিউ নিতে হবে। সাপ্তাহিক চিত্রালী তখনকার দিনে সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনে পত্রিকা। উভয় পাকিস্তানের নায়ক নায়িকাদের রসালো গল্প এবং বিভিন্ন পোজের রঙিন ছবি তখন একমাত্র ওই চিত্রালীতেই ছাপা হতো, দাম ছিল মাত্র ৪ আনা। রশীদ ভাইয়ের বেতন সম্ভবত ১০০ টাকার নিচেই ছিল। ওই টাকা দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শুরু হলো। আমাদের দাদুভাই পাবনা গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনের প্রথম এবং শেষ সম্পাদক, যিনি ১৯৫৮ সালে স্কুলের ছাত্রদের লেখা নিয়ে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছিলেন। সম্পাদক ছিলেন রশীদ হায়দার। দাদু ভাইয়ের এমএ শেষ হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। সেই বছরেই দুই অগ্রজ তাদের অনুজদের শিক্ষায় আলোকিত করার জন্য যে অমানুষিক পরিশ্রম, যে দায়ভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, সেটি এক কথায় অভাবনীয়। পিতা প্রতি মাসেই কয়েক বস্তা চাল পাঠাতেন, আসত পাবনা থেকে সদরঘাটে লঞ্চে। আমি জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরে আমাদের পাশের বাসায় ডাঃ আজহারুল ইসলামের একান্ত প্রচেষ্টায় চাকরি পেয়েছিলাম পুরান ঢাকার নিমতলীর টিউবারক্লোসিস হাসপাতালে মাসিক ৭০ টাকায়। ইতোমধ্যে জিয়া ভাই আমেরিকার হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্কলারশিপ পেয়ে সে দেশে গিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত টাকা পাঠাতেন। তিনি জানতেন দুলালের (রশীদ হায়দার) পক্ষে বাসা ভাড়া দিয়ে এতগুলো মানুষের আহারের ব্যবস্থা কঠিন থেকে কঠিনতর। সেই কঠিন বাস্তবতার ভেতরে দাদুভাইকে দেখেছি বুকের নিচে বালিশ দিয়ে নিয়মিত গল্প লিখছেন। যেহেতু বাসায় না ছিল পড়ার টেবিল, না ছিল খাবার টেবিল। আমাদের স্নেহময়ী মা ছেলে-মেয়েদের ভাত মাছ মাংস যাই দিতেন যেন অপচয় না হয়। মাকে দেখেছি সন্ধ্যার পরে রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি পড়তেন মাঝে মাঝে। ফরিদা কিংবা দাউদ যুক্ত শব্দ উচ্চারণে মায়ের অসুবিধা হলে, ওরা দুইজন, মাকে সাহায্য করতেন। চোখের বালি পড়ে মাকে প্রায়শই কাঁদতে দেখতাম। হয়ত আমার মায়ের মনে পড়ত তার ফেলে আসা সেই বিশাল বাড়ি, পুকুর, পারিবারিক সুখ, দুঃখÑ সবকিছুই হয়ত তাকে নস্টালজিয়াতে পেয়ে বসত। উপন্যাস চোখের বালি আমার মায়ের জীবনেরই এক অংশ বলে মা প্রায়শই বলতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি বাংলা একাডেমিতে যোগ দিয়েছিলেন, অবসরে গিয়েছেন পরিচালক পদ থেকে তার আগে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়েছিলÑ দুই ভাই পারিবারিক আড্ডায় একদিন বলেছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জনৈক উপসচিবকে তিনি স্যার না বলায়, সেই উপসচিব রূঢ় ব্যবহার করায় পরদিনই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন বাংলা একাডেমিতে। অথচ তার ডজন খানেকের বেশি বন্ধুই সচিব-সিএসপি। একাডেমি থেকে অবসর গ্রহণের পর পরই বর্তমান সরকার দাদুভাইকে দুই টার্মের জন্য নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। তার কাছে অনেকেই অনেক সময় উপঢৌকন এনে অপমানিত হয়ে ফিরে গেছেন। তিনি যখন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে, ‘বই’ পত্রিকার কাগজ কেনার সময় সাপ্লাইয়ার উৎকোচ দিতে চেয়েছিলেন, সেই সাপ্লাইয়ের কন্ট্রাক্ট বাতিল করে বলেছিলেন, টাকা দিয়ে রশীদ হায়দারকে কেনা যাবে না। অতিশয় সৎ জীবন তার। বহু সম্মাননাÑ বাংলা একাডেমি, একুশে পদকসহ ভারতে শিক্ষার জন্য স্কলারশিপ, আমেরিকাতে স্কলারশিপ, সব কিছুরই উর্ধে তিনি। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘স্মৃতি ৭১’ সম্পাদনার জন্য আমরা আশা করেছিলাম এ বছর তিনি ‘স্বাধীনতা’ পুরস্কার পাবেন, হয়নি। আমাদের দুই ভাই এর জন্মদিন ১৫/০৭/২০২০। তিনি এখন বাকরুদ্ধ। তবু আমাদের দাদুভাইয়ের ৮০তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা দিবসে তার মঙ্গল প্রত্যাশা। পুনরায় বলতে হয়, আমাদের দুই অগ্রজ দায়ভারÑ দায়িত্ব গ্রহণে কোনদিন পিছপা হননি। হলে অন্যান্য ভাইবোনের লেখাপড়া হতো কিনা সন্দেহ। লেখক : কবি
×