ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অমানবিক!

প্রকাশিত: ২১:১৫, ১৫ জুলাই ২০২০

অমানবিক!

রবীন্দ্রনাথ সেই কত যুগ আগে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, এখনও গেল না আঁধার। আজও আমাদের সমাজ থেকে কিছুতেই অন্ধকার দূর করা যাচ্ছে না। আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অজ্ঞতা, বর্বরতা, কুসংস্কার, তমসা বা অন্ধকার যুগ থেকে পৃথিবী সামনের দিকে এগিয়েছে হাজার বছর। কিন্তু এই বঙ্গদেশে এক শ্রেণীর কূপম-ূক ধর্মান্ধ লোক যেন সেই অন্ধকার যুগই ফিরিয়ে আনতে তৎপর! ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘাটুরা গ্রামে সম্প্রতি সংঘটিত বর্বরোচিত অমানবিক ঘটনাটি যেন তারই উদাহরণ। সেখানে দাফনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নবজাতকের মরদেহ কবর থেকে তুলে ফেলা হয়েছে। ফেলে দেয়া হয়েছে রাস্তায়। মৃত শিশুটির ‘অপরাধ’ ছিল সে আহমদীয়া সম্প্রদায়ের। তাই সরকারী মুসলিম কবরস্থানে তার অন্তিম ঠিকানা হতে পারে না। ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। কোথায় মানবতা! মানুষের কি বিবেকবুদ্ধি সব লোপ পেল? ইসলাম হচ্ছে শান্তির ধর্ম। সেখানে এমন বর্বরতার কোন স্থান নেই। অথচ যারা এই অমানবিক কাজটি করেছে তারা ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়েই এটি করেছে। মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করা হয়েছে। তারপর কবর খুঁড়ে শিশুর লাশ তুলে নিয়ে সড়কে ফেলে রাখা হয়েছে। তাদের বুক কি একবারও কেঁপে উঠল না এমন জঘন্য কাজ করতে? আরও দুঃখের কথা হলো, স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসে এমন ন্যক্কারজনক অপরাধের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে আহমদীয়া সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারিত গোরস্তানে শিশুটির দাফনের তত্ত্বাবধান করেছে। পূর্বাপর বিষয়টি নিন্দনীয়। ধর্মের নামে অধর্ম কিছুতেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। নবজাতকের মরদেহের সঙ্গে অমানবিক ও অমর্যাদাকর আচরণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তি প্রাপ্য। শুধু নিন্দা জানানোই প্রতিকার নয়। সমাজে সুস্থতা ও ন্যায়বিচার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হলে এই গর্হিত অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতেই হবে। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন। এ ঘটনাকে বাংলাদেশে ঘৃণাপ্রসূত ধর্মীয় বিদ্বেষ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক ন্যক্কারজনক বিরল নজির অভিহিত করে সংস্থাটি বলেছে, “কেবল ভিন্নমতাবলম্বী পরিবারে জন্মগ্রহণ করার ‘অপরাধে’ উগ্রবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক এক নবজাতকের লাশকে ‘শাস্তি’ দেয়া এবং এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের নতজানু ভূমিকাÑ উভয়ই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিপরীত প্রবণতা।” বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে রাষ্ট্র কারও সঙ্গে বৈষম্য করবে না। আবার সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকারও দেয়া হয়েছে। হয়তো করোনাজনিত অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন, সুশীল সমাজ ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদমুখর হননি। যদিও সেটিই ছিল প্রত্যাশিত। মানবিকতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য বাংলাদেশের সুনাম রয়েছে। দেশের অধিকাংশ মানুষই ধর্মপ্রাণ ও ধর্মভীরু’ কিন্তু তারা ধর্মান্ধ নয়। গুটিকতক অন্ধকারের প্রাণীর জন্য দেশের সুনাম কিছুতেই বিনষ্ট হতে পারে না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা কতিপয় ধর্মান্ধ মানবতাবিরোধী অমানুষের জন্য একটি দেশের ভাবমূর্তি বিপন্ন হতে পারে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব এই অন্যায়ের প্রতিকার করা হবে ততই মঙ্গল। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা ও অবাধে তাদের ধর্ম পালনের অধিকার সুনিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য হওয়া সমীচীন।
×