ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা উপসর্গে ভোগা মানুষদের ফাঁদে ফেলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে

প্রতারণার সিন্ডিকেট গড়ে জেকেজি, চার্জশীট দিচ্ছে পুলিশ

প্রকাশিত: ২২:২৮, ১১ জুলাই ২০২০

প্রতারণার সিন্ডিকেট গড়ে জেকেজি, চার্জশীট দিচ্ছে পুলিশ

শংকর কুমার দে ॥ করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) পরীক্ষা না করেই করোনার রেজাল্ট নিয়ে প্রতারণা ও অবৈধ কর্মকা-ের দায়ে জোবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বা জেকেজি হেলথ কেয়ার নামের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চার্জশীট (অভিযোগপত্র) দিতে যাচ্ছে পুলিশ। রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকায় বুথ বসিয়ে পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট দেয়ার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আরিফ চৌধুরীসহ ৬ জনকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর আদালতের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে কারাগারে। তবে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এখনও রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। প্রতিষ্ঠানটির বিরদ্ধে কোন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক শ্রেণীর কর্মকর্তার যোগসাজশে করোনা পরীক্ষার অনুমতি পায় জেকেজি প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরের পৃথক ছয় স্থানে ৪৪টি বুথ স্থাপন করে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ জনের নমুনা সংগ্রহ করত জেকেজি প্রতিষ্ঠানটি। এর বিনিময়ে দিতে হতো ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু নমুনার কোন পরীক্ষা ছাড়াই একদিন পরই মনগড়া ফল দিয়ে দিতো। করোনা উপসর্গে ভোগা মানুষদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে এভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে জোবেদা খাতুন সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (জেকেজি হেলথ কেয়ার)। শর্ত ছিল-সরকার নির্ধারিত ল্যাবরেটরিতে নমুনা পাঠাতে হবে। কিন্তু হেলথ কেয়ার ওভাল গ্রুপের অঙ্গসংগঠন জেকেজি সব শর্ত ভেঙ্গে পরীক্ষা ছাড়াই করোনার ভুয়া টেস্ট রিপোর্ট সরবরাহের ফাঁদ পাতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। নিজস্ব কর্মীবাহিনী ছাড়াও সিন্ডিকেটে যোগ করে দালাল চক্র। জেকেজির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আরিফুল হক চৌধুরীর গ্রেফতারের খবরে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীবাহিনী গা ঢাকা দিয়েছে। করোনা ঘিরে প্রতারণার সিন্ডিকেট গড়ে জেকেজি। একে আগলে রাখতে তৈরি করেছিল শক্তিশালী ক্যাডার বাহিনী। যেখানে যেখানে বুথ স্থাপন করে, সেখানেই তারা এই ক্যাডার বাহিনী দিয়ে কায়েম করে ত্রাসের রাজত্ব। এমনকি স্বাস্থ্য অধিদফতরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়ে নিজেদের অনৈতিক কাজ করিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল জেকেজি হেলথ কেয়ার। তাদের অনৈতিক কর্মকা-ে সাড়া না দেয়ায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করতেন প্রতিষ্ঠানটির সিইও আরিফ চৌধুরী। জেকেজি প্রতিষ্ঠানটির ভুয়া রিপোর্ট সরবরাহসহ কিছু অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন আরিফুলসহ পাঁচজন। গ্রেফতার অন্যরা হলেন- হুমায়ুন কবীর, তার স্ত্রী তানজীনা পাটোয়ারী এবং সাইদ চৌধুরী ও আলমান। তাদের মধ্যে হুমায়ুন ও তানজীনা কিছুদিন আগে জেকেজি থেকে বেরিয়ে এসে নিজেরাই নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা ছাড়াই ফল দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছিলেন বেশুমার টাকা। বাকি দু’জন গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন জেকেজিতেই। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, তেজগাঁও থানায় জেকেজি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা, জালিয়াতি, অবৈধ কর্মকা-ের বিষয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় গ্রেফতারদের দুই দিনের রিমান্ড শেষে জেকেজির সিইও আরিফুল হক চৌধুরী, সাঈদ চৌধুরী, বিপ্লব দাস ও মামুনুর রশীদকে আদালতে হাজির করা হলে শনিবার ঢাকা মেট্র্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু সাঈদ তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এর আগে এ মামলার অন্য দুই আসামি হুমায়ুন কবির ও তার স্ত্রী তানজীনা পাটোয়ারী আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দী দেন। গ্রেফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, অনুমোদন ছাড়াই বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ ও ভুয়া নমুনা রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগে আটক জেকেজি হেলথ কেয়ারের সিইও আরিফুল হক চৌধুরীর সব দাপটের উৎস ছিলেন স্ত্রী ডাঃ সাবরিনা চৌধুরী। সরকারী চাকরিজীবী হয়েও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেননি তিনিও। যদিও স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়ে ডাঃ সাবরিনা এখন স্বামীর বিরুদ্ধে কথা বলছেন। দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর পরই এলাকাভিত্তিক ফ্রি করোনার নমুনা সংগ্রহের দায়িত্ব পায় জেকেজি হেলথ কেয়ার। কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও তার কর্মকা-ের জন্য বেছে নেয় সরকারী তিতুমীর কলেজ। প্রশিক্ষণের নামে কলেজ ক্যাম্পাসে সারারাত পার্টি করা নিয়ে কলেজের স্টাফদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করার ঘটনাও ঘটায় জেকেজি গ্রুপের কর্মচারীরা। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডিএমপি পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আরও বিস্তৃতি পরিসরে এই চক্রের প্রতারণ ও দুর্নীতি ধরার জন্য মাঠে নামবে তারা। তারা বের করার চেষ্টা করছে এদের সঙ্গে আর কে কে জড়িত। পুলিশ বলেছে, গ্রেফতারের পর আরও অন্তত ৩ নারী আরিফুলের স্ত্রী দাবি করে নানা অভিযোগ করেছেন। করোনা টেস্টের নামে মানুষের কাছ থেকে নমুনা নিতেন। তা পরীক্ষা না করেই দিতেন ভুয়া রিপোর্ট। বিষয়টি ধরা পড়লে গ্রেফতার হন জেকেজি হেলথ কেয়ারের সিইও আরিফুল চৌধুরী। এরপর থেকে বেরিয়ে আসছে তার নানা কাহিনী। রাজধানীর মহাখালীর তিতুমীর কলেজে বুথ স্থাপন করে করোনা পরীক্ষার নামে অশ্লীলতা, মাদকসহ অসামাজিক কার্যকলাপ চালানা হতো। তিতুমীর কলেজের স্টাফদের ওপর হামলা করেছিল জেকেজির লোকজন। এ ঘটনায় গত ২৩ জুন ওভাল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথ কেয়ারের প্রধান নির্বাহী আরিফুল চৌধুরীসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই দিন সন্ধ্যায় তেজগাঁও থানায় হামলা চালায় আরিফুল চৌধুরীর সহযোগীরা। লাঞ্ছিত করে দায়িত্বরত পুলিশকে, ভাংচুর করে সরকারী সম্পত্তি। সেই আরিফুল চৌধুরী, আবু সাঈদ ও হুমায়ুন কবীররা উস্কানি দেয় সে হামলায়। তবে আরও ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, নেশাগ্রস্ত আরিফ পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় ভাংচুর করেছেন থানার ভেতর। ভেঙ্গেছেন সিসি ক্যামেরা, ফ্যানসহ প্রায় ৩০ হাজার টাকার সরকারী সম্পদ। এমনকি নেশা করতে ইয়াবাও চান পুলিশ সদস্যদের কাছে। থানার সিসি ক্যামেরার ফুটেজে মিলেছে এসব দৃশ্য। ডিএমপির এক কর্মকর্তা বলেন, জেকেজি হেলথ কেয়ারের অবৈধ কর্মকা-ের বিষয়ে তদন্ত কাজ গুছিয়ে এনেছে পুলিশ। প্রতিষ্ঠানটির পেছনে প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও জড়িত থাকার বিষয়ে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোন কর্মকর্তা জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে পুলিশ। প্রতারণা, জালিয়াতি, অবৈধ কর্মকা-ের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকবে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তদন্ত শেষে খুব দ্রুতই জড়িতদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করা হবে বলে ডিএমপি পুলিশের দাবি। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে জেকেজির নমুন সংগ্রহ করার জন্য চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তি বাতিল করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। নমুনা সংগ্রহ করার অনুমতি কিভাবে পেয়েছিল, কারও কোন তদ্বির ছিল কিনা সেটা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ নমুনা সংগ্রহের বাইরে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য অধিদফতর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ওভাল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও জেকেজির সিইও আরিফুল হক চৌধুরীর স্ত্রী ডাঃ সাবরিনা চৌধুরী গণমাধ্যমে বলেছেন, আদর্শের সঙ্গে না মেলায় এক মাসে আগে তিনি জেকেজি ছেড়ে চলে এসেছেন। বিষয়টি তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককেও জানিয়েছেন। এরপর আরিফুল হক চৌধুরী একদিন তার হাসপাতালে (জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট) এসে ঝামেলা করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং তিনি নিজে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের রেজিস্টার্ড চিকিৎসক হয়ে তিনি ছিলেন জেকেজি হেলথ কেয়ারের কথিত চেয়ারম্যান হয়েছে কিভাবে? কে এই ডাঃ সাবরিনা : তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, জেকেজির চেয়ারম্যান ডাঃ সাবরিনা চৌধুরী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক। তার স্বামীর নাম আরিফ চৌধুরী। এই দম্পতির জীবনও রূপকথার মতো। আরিফের চতুর্থ স্ত্রী সাবরিনা। আরিফের এক স্ত্রী থাকেন রাশিয়ায়, অন্য একজন লন্ডনে। আর আরেকজনের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তবে ছাড়াছাড়ির পরও সাবেক ওই স্ত্রী বিভিন্ন জায়গায় আরিফের জন্য দেনদরবার করে যাচ্ছেন। মূলত সাবরিনার হাত ধরেই করোনার স্যাম্পল কালেকশনের কাজটি ভাগিয়ে নেয় অনেকটা অখ্যাত জেকেজি নামে এই প্রতিষ্ঠান। প্রথমে তিতুমীর কলেজে মাঠে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপনের অনুমতি মিললেও প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার অন্য এলাকা আর অনেক জেলা থেকেও নমুনা সংগ্রহ করছিলেন এই দম্পতি। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, স্বামী আরিফ চৌধুরী ও স্ত্রী সাবরিনা দম্পতি মিলে করোনা টেস্ট করলেও তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের নয়। স্ত্রীর সঙ্গে অশালীন অবস্থায় দেখতে পাওয়া গেছে-এমন অভিযোগ এনে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এক চিকিৎসককে মারধর করেন আরিফ চৌধুরী। পরে এ ঘটনায় স্বামীর বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় জিডি করেন ডাঃ সাবরিনা। এ ছাড়া জেকেজির এক কর্মীকে অশালীন প্রস্তাব দেয়ার ঘটনায় গুলশান থানার আরিফ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। বিএমএর নেতার পরিচয় ভাঙ্গিয়ে চলাফেরা করেন সাবরিনা। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের রেজিস্টার্ড চিকিৎসক হয়ে তিনি ছিলেন জেকেজি হেলথ কেয়ারের কথিত চেয়ারম্যান হয়েছে কিভাবে সেই বিষয়ে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।
×