ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অশান্ত বান্দরবান

প্রকাশিত: ২১:১৬, ১০ জুলাই ২০২০

অশান্ত বান্দরবান

ফের অশান্ত ও রক্তাক্ত হলো পাহাড়। এবারের ঘটনাস্থল অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ বান্দরবান। সদর উপজেলার রাজটিলা ইউনিয়নের বাজারপাড়ায় মঙ্গলবার সকালে ঘটে হামলার ঘটনা। আকস্মিক হলেও সুপরিকল্পিত এই হামলায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতির (জেএসএস-এমএন লারমা) বান্দরবান জেলা সভাপতিসহ ব্রাশফায়ারে নিহত হন ৬ জন। আহত তিন। নিহত ও আহতদের সবাই একই দলের নেতা-কর্মী। ভয়াবহ ও মর্মান্তিক এই ঘটনার জন্য জেএসএস-এমএন-লারমা গ্রুপ দায়ী করেছে জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসকে। অবশ্য জেএসএস তা অস্বীকার করেছে। তারা ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে। উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালে জেএসএস তথা জনসংহতি সমিতি গঠিত হয়। মূলত ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য ২০১০ সালে গঠিত হয় জেএসএস-এমএল লারমা গ্রুপ। এরপর গঠিত হয় পার্বত্য শান্তিচুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক, মগ পার্টি ইত্যাদি। সেই থেকে পারস্পরিক সংঘাত-সংঘর্ষে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৮৬ জন। যথারীতি মামলা ও তদন্ত চলছে। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার কর্তৃক পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পর ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে বিবদমান আঞ্চলিক গ্রুপগুলো সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, যার জেরে এ পর্যন্ত প্রাণ দিতে হয়েছে অন্তত ৮৬ জনকে, যার মধ্যে বাঙালীও আছে। সত্যি বলতে কি, খুনের বদলে খুন সেখানে যেন একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক দল ও গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কয়েকটি গ্রুপের পারস্পরিক সংঘাত, সংঘর্ষ, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, গোলাগুলি, রক্তপাত ও হানাহানির ঘটনায় সর্বাধিক বিপর্যস্ত হয়েছে পাহাড়ী জনপদের জনজীবন। ফলে অনেক তরুণ-তরুণীকে নিরাপত্তার জন্য ইতোমধ্যে এলাকা ছাড়া হতে হয়েছে। সর্বাধিক আতঙ্কে বসবাস করতে হচ্ছে সেখানে বসবাসরত বিপুলসংখ্যক বাঙালীকে। সবচেয়ে যা দুঃখজনক তা হলো, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাইরে পাহাড়ী জনপদে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য স্থাপনের জন্য স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয়দের আদৌ কোন উদ্যোগ-আয়োজন নেই। ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ ও নেতৃত্বে পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর সঙ্গত কারণেই আশা করা গিয়েছিল যে, ওই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে দুঃখজনক হলো, দেশের জনগণের সেই প্রত্যাশা বাস্তবায়িত হয়নি। বরং ইতোমধ্যে কোন কোন অঞ্চল আবার অস্থির ও অশান্ত হয়ে উঠেছে। এর জন্য পাহাড়ীদের পক্ষ থেকে প্রায়ই শান্তি চুক্তির ধারাগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার অভিযোগ উত্থাপিত হয়ে থাকে। এই অভিযোগ সত্য নয়। বরং শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার বরাবরই আন্তরিক ও সচেষ্ট। তবে পার্বত্য অঞ্চলে সর্বাপেক্ষা জটিল সমস্যা ভূমি জরিপ ও বণ্টনের কাজটি এখনও অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে। বিষয়টি সময়সাপেক্ষ এবং জটিলও বটে। আইনী জটিলতাও আছে বৈকি। সর্বোপরি পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীরা একাধিক ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত। নেতৃত্বের সঙ্কটসহ বহুধাবিভক্ত গোষ্ঠী এমনকি সশস্ত্র গ্রুপও বিদ্যমান, যার জের চলমান। এমতাবস্থায় নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বহীনতা, পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস বিরাজমান থাকলে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন সুদূরপরাহত, তাতে আর সন্দেহ কি? পাহাড়ীদের এই সারসত্য বুঝতে হবে যে, নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাস ও অনৈক্য বজায় রেখে এমনকি সশস্ত্র সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়ে খুব বেশিদূর অগ্রসর হওয়া যাবে না। তাতে তারা নিজেদের গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনিবার্য ধ্বংসই ডেকে আনবে। বরং তাদের উচিত হবে বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শন করে পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সুনিশ্চিত করা। আগামীতে এই ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে এবং সব হত্যার দ্রুত বিচার হয় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের এবং রাজনৈতিক নেতাদের। প্রয়োজনে এ বিষয়ে সরকারকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
×