ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ড. কামরুল ইসলাম

নির্বাচিত ৫০ কবিতা শাহীন রেজার কাব্যঅর্জন

প্রকাশিত: ১৯:৫৯, ১২ জুন ২০২০

নির্বাচিত ৫০ কবিতা শাহীন রেজার কাব্যঅর্জন

কবিতার নিজস্ব কোন চিত্র নেই, চরিত্র নেই। কবিতা কবির চিন্তা চেতনা এবং দর্শনের প্রতিফলন মাত্র। তার মানে এককথায় আমরা বলতে পারি কবির ভাবনাপ্রসূত বিষয়াদির সন্নিবেশই তার কবিতা। এবং এ জন্য একজনের কবিতা থেকে আর একজনের কবিতায় থেকে যাচ্ছে ভাষা উপস্থাপনা গতিপ্রকৃতি এবং উপমা উৎপ্রেক্ষার মধ্যে দারুণ অমিল। অনেক কবি অবশ্য পূর্বসূরিদের অনুসরণ করে থাকেন এতে করে ওইসব কবির ভাষা অভিব্যক্তি এমন কি প্রকাশভঙ্গিও উত্তরসূরির মধ্যে চলে আসতে পারে। তবে এটাকে কবিতার গভীরতম ব্যাখ্যায় তুলে আনা ঠিক নয়। পৃথিবীর সকল মৌলিক কবিতাই আলাদা চিন্তা ও দর্শনের ফসল। আর এসব দর্শন ও চিন্তাধারা ঐ কবিরই নিজস্ব প্রসূত। বাংলা কবিতায় আমাদের আশির দশক অনেকটাই ছিল সম্ভাবনাময়। এ দশকের কবিরা সত্তরের সেøাগাননির্ভর কবিতার বিপরীতে একটি নতুন ধারা সৃষ্টিতে মশগুল হয়েছিলেন তবে তাকে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন বাদে কেউ তেমন একটা সরব উঠেননি। কালক্রমে তাদের অনেকে আবার স্তিমিত হয়ে গেছেন, কেউ কেউ পড়েছেন ছিটকে রানওয়ে থেকে। যে ক’জন আশির দশকের সেই নবধারার সাক্ষী হয়ে তারই অনুপ্রেরণায় এখনো এগিয়ে চলেছেন তাদের একজন শাহীন রেজা। প্রথম দিকে অনেকটাই নিভৃতে থাকা শাহীন চল্লিশের পর খুলতে শুরু করেছেন তার খোলস এবং দিনের পর দিন প্রচন্ড গতি সঞ্চার করে এগিয়ে চলেছেন সামনের দিকে। শাহীনের শক্তির উৎস তার মৌলিকতা, বিশ্বাস এবং একাগ্রতা। তার কবিতায় একটা মাদকতা আছে। মেঘ মাল্লারের সুরে সুরে সেখানে নেমে আসে শব্দধারা। শাহীনের কবিতার একমাত্র সুর প্রেম হলেও সেখানে তিনি নিঃসংকোচে তুলে আনেন প্রকৃতি, জীবনবোধ এবং বিধাতাকেও। শাহীনের সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ’ নির্বাচিত ৫০ কবিতায় তিনি যেভাবে নিজেকে তুলে ধরেছেন তাতে পাঠকমাত্রেই চমকিত সচকিত এব অভিভূত হবেন। একজন কবি কিভাবে নিজেকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে আবার গড়তে পারেন তা তার এই গ্রন্থটি পাঠ না করলে অনুধাবন করা অসম্ভব। ছোট ছোট বোধকে বুহত্তর ক্যানভাসে গভীরতর ভাবে ফুটিয়ে তোলার শক্তি সবার থাকে না। সম্ভবত; শাহীন তাদেরই একজন যাদের পক্ষে এই অসম্ভবকে জয় করা সম্ভব হয়েছে। শাহীন এমনই এক ধারার কবি যিনি সহজেই অনাগত সব মুহূর্তগুলোকে তুলনা করতে পারেন প্রজাপতির সঙ্গে আর আষাঢ়ের তুমুল বর্ষণে গতিময় করে তুলতে পারেন তার দ্বৈরথ কে। মধ্যরাতকে দাঁড় করিয়ে জোছনার ললাটে ঘাসফুল এঁকে দেবার দূরন্ত সাহস যাকে দীপ্যমান করে তোলে তাকে কবি হিসেেেব শনাক্ত করার দ্বিধা অন্তরে পোষণ করবে এমন সাধ্য কার? তুমুল জোছনা পাতেও যখন ক্ষেত আলোময় হয়ে ওঠে না তখন বেগুন মরিচের নিচে জমে ওঠা অন্ধকারে যে আবিষ্কার করতে পারে শব্দের ভ্রুণ সেই তো কবি। ‘ভালবাসা জেলেদের জালে ওঠা মাছ বাজারে বিকায় জেলেনির ঘর জুড়ে জলের গন্ধ তবু ফেনা ওঠা ভাত’। (ভালবাসা) খুব কাছ থেকে জীবনকে আবিষ্কার করে তার ছোটখাটো ধ্বনি কিংবা খুনসুটি কবিতায় এত সহজভাবে উপস্থাপন খুব দৃঢ় কবিশক্তির প্রকাশ। শাহীন যে যথার্থ অর্থেই সেটা অর্জন করেছেন এই চারটি চরণই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। শাহীন চিরকাল কাব্য অভিসারী। কবিতার কাছাকাছি কবিতার পাশাপাশি নিজ অবস্থান নির্ণীত করে নিয়েছেন তিনি। এবং একথা স্বীকারও করে নিয়েছেন অকুণ্ঠ চিত্তে- ‘আমি কবি বেঁচে আছি পাখি ও কবিতার কাছাকাছি আমি কেন ভুল পথে যাব? (কেন ভুল পথে যাব) এই ভুল পথটা যে কবিতার নয় তা পাঠককে আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। শাহীন ‘বাংলাদেশের মতো আপনাকে’ কবিতায় শুরুতে যে শব্দগুলো গেঁথে দিয়েছেন তা যদিও তার নিজস্ব অনুভব, তবে এ অনুভবের সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছেন সকল কাব্যপিয়াসী হৃদয়কে। ‘অনুভবের মৃত্যু হলে বেঁচে থাকার আর কোন অর্থ থাকে না’ সত্যিই তো যেখানে অনুভব মৃত সেখানে জীবনই তো অস্তিত্বহীন, স্থবির, বন্ধ্যা। ছায়ার প্রতি শাহীন রেজার এক ধরনের পক্ষপাতদৃষ্টি এড়ায় না। তার কবিতায় ঘুরে ফিরে ছায়ার ব্যবহার গভীরভাবে লক্ষণীয়। ‘এক পৃথিবী ছায়া কিনতে কয় মুঠো কয়েন লাগে?’ ‘ছায়া’ শিরোনামের কবিতাটির শেষ লাইনে রেখে যাওয়া শাহীনের এই প্রশ্ন সবার মনে আলতো করে ঝংকার তুলে যায় বৈকি। শাহীন রেজা কবি। আর কবি বলেই তার কবিতায় আল মাহমুদের সেই দ্যোতনা আর ফজল শাহাবুদ্দীনের ঘোরকে আমরা প্রত্যাশা করি। একজন কবিকে কবিতার যে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হয় তা কষ্ট আর ত্যাগে পরিপূর্ণ। বাইরে থেকে কবির অন্তর্জ¡ালা ঠাহর করা খুব সহজ কাজ নয়। শাহীন রেজা যে কবিতার অন্তর্জ¡ালা ধারণ করে এগিয়ে চলেছেন তাই তার গতিপথ নির্ধারণ করে দিচ্ছে। শাহীন রেজা কবি হিসেবে ইতোমধ্যে তার অগ্রজ এবং নমস্য কবিদের আশীর্বাদ অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। এটিকে এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নেই। কবিতার মতো মানুষ শাহীন রেজা একজন প্রকৃত কবিতার মানুষে পরিণত হন সেটাই প্রত্যাশা।
×