ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

পোল্ট্রি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা কমিশনের মামলা ভিত্তিহীন

জীশান হাসান

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ৭ মে ২০২৪; আপডেট: ১৪:০৪, ৮ মে ২০২৪

পোল্ট্রি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা কমিশনের মামলা ভিত্তিহীন

পোল্ট্রি কোম্পানির বিরুদ্ধে কৃত্রিমভাবে মুরগি ও ডিমের দাম বাড়ানোর অভিযোগ এনেছে

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন গত দুই বছরে অনেক পোল্ট্রি কোম্পানির বিরুদ্ধে কৃত্রিমভাবে মুরগি ও ডিমের দাম বাড়ানোর অভিযোগ এনেছে। এই অভিযোগে কাজী ফার্মসসহ বেশ কয়েকটি পোল্ট্রি কোম্পানিকে দোষী সাব্যস্ত করে কোটি কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তবে কমিশনের এসব কার্যক্রমে স্পষ্ট যে, তাঁরা বাজারে কৃষিপণ্যের দাম ওঠা-নামার মৌলিক অর্থনৈতিক নীতিগুলি বুঝতে অক্ষম। যেকোনো বাজার পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়নের জন্য প্রথমে অর্থনৈতিক তত্ত্ব অধ্যয়ন ও বোঝা জরুরি।
প্রতিযোগিতা কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে, উৎপাদন খরচ এবং বিক্রয় মূল্যের তুলনা করে ‘উচ্চ মুনাফা যোগসাজশ’ দাবী করা হয়েছে; যা অর্থনৈতিক তত্ত্বের সাথে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাজারে কৃষিপণ্যের দামের ওঠা-নামা করে একটি অন্তর্নিহিত অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায়। ডিম এবং মুরগি অন্যান্য পণ্যের মতো মিল-কারখানায় উৎপাদিত হয় না; কয়েক মাস ধরে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় খামারে এগুলো উৎপাদিত হয়।

বর্তমানে বাজারে যে পরিমাণ চাল পাওয়া যাচ্ছে তা নির্ভর করে কৃষকরা গত মৌসুমে কী পরিমাণ ধান উৎপাদন করেছেন তার ওপর। ডিম ও মুরগির ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। কৃষকরা কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন- প্রতিটি চক্রে কী পরিমাণ ধান, ডিম বা মুরগি উৎপাদন করতে হবে? সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য দ্বারা বাজারে পণ্যের দাম নির্ধারিত হয়। যখনই কোনও পণ্যের ঘাটতি হয় তখনই সেই পণ্যটির দাম বেড়ে যায়। আর কোনও পণ্যের দাম বেড়ে গেলে কৃষকরা পরবর্তী উৎপাদন চক্রে আরও বেশি উৎপাদন করতে অনুপ্রাণিত হন।

এতে পরবর্তী উৎপাদন চক্রে ওই পণ্যের সরবরাহ বাড়বে এবং স্বভাবতই দাম কমে যাবে। এ কারণেই কৃষিপণ্যের বাজারে স্বল্পমেয়াদে দাম ওঠা-নামা করে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সরবরাহ বাড়ে এবং ঘাটতি কমে যায়। স্বল্পমেয়াদী উচ্চতর-দাম এবং দীর্ঘমেয়াদী নিম্নতর-দাম অর্থনীতিবিদদের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়; যতক্ষণ উৎপাদকরা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতে উৎপাদন করেন।

প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের পোল্ট্রি বাজারে হাজার হাজার ক্ষুদ্র খামারি প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতেই কাজ করে থাকেন। একজন অর্থনীতিবিদ, হাজার হাজার উৎপাদকের এই বাজারকে প্রতিযোগিতামূলক এবং ন্যায্য বাজার হিসাবে গণ্য করবেন। এমন বাজারে ‘কারসাজি’ হয় না বা করা সম্ভবও নয়। 
খামারিরা কখনোই নিশ্চিতভাবে অনুধাবন করতে পারেন না ভবিষ্যতে কি পরিমাণ ডিম ও মুরগি উৎপাদন করা প্রয়োজন হবে; কেউই নিশ্চিতভাবে এমন পূর্বাভাস দিতে পারবেন না। একটি নির্দিষ্ট উৎপাদন চক্রে সাধারণত চাহিদার তুলনায় বেশি বা কম উৎপাদন হয়। এই ধরনের ভারসাম্যহীনতার কারণে দাম ওঠা-নামা করে। কৃষিপণ্যের দামের ওঠা-নামার এই ব্যাখ্যাকে বলা হয় ‘কবওয়েব তত্ত্ব’। ১৯৩৪ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে অর্থনীতিবিদ নিকোলাস কালডর এই তত্ত্বের প্রস্তাবনা করেন।

১৯৪৭ সালে প্রকাশিত জেফরি শেফার্ড এর লেখা ‘এগ্রিকালচারাল প্রাইস এনালিসিস’ বইয়ে ‘কবওয়েব তত্ত্ব’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে (যা আইওয়া স্টেট ডিজিটাল প্রেস থেকে বিনামূল্যে ডাউনলোডের জন্য উপলব্ধ)। উদাহরণস্বরূপ, বইটির ৩১ পৃষ্ঠা থেকে নিম্নলিখিত গ্রাফটি অন্তর্ভুক্ত করা হলো-
উপরের গ্রাফটিতে, উলম্ব রেখাটি (P) দ্বারা দাম ও আনুভূমিক রেখাটি (Q) দ্বারা পরিমাণ এবং বাম দিক থেকে ডান দিকে ঊর্ধ্বগামী বক্র রেখাটি (S) দ্বারা সরবরাহ ও বাম দিক থেকে ডান দিকে নিম্নগামী বক্র রেখাটি (D) দ্বারা চাহিদা বোঝানো হয়েছে। এতে সরবরাহ ও চাহিদার বক্ররেখা বরাবর দাম এবং পরিমাণের গতিবিধি দেখা যাচ্ছে; যা একটি মাকড়সার জালের মতো দেখায়।


ধরা যাক, প্রাথমিকভাবে অনেক বেশি পণ্য (QI) উৎপাদিত হয়েছে। এর ফলে, চাহিদা বক্ররেখায় (D) কম দাম (PI) দেখা যাচ্ছে। উৎপাদিত পণ্যের কম দাম কৃষকদের হতাশ করবে এবং পরবর্তী চক্রে উৎপাদন হ্রাস পাবে। ফলে, সময়ের সাথে সাথে ওই পণ্যের পরিমাণ Q2-তে নেমে আসবে (যা সরবরাহ বক্ররেখা ঝ-এ সরবরাহকারীরা ঐ মূল্যে উৎপাদন করতে ইচ্ছুক) এবং ঘাটতি তৈরি হবে। কিন্তু, সরবরাহ কমে Q2-তে অবস্থান করায় উচ্চ মূল্য P2-তে চাহিদা বক্ররেখা D-কে ছেদ করে; তাই ঘাটতি দাম বাড়ায়। 
এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, এখানে স্বাভাবিকভাবেই পণ্যটির ঘাটতি হচ্ছে এবং এতে সরবরাহকারীদের মধ্যে ‘যোগসাজশ’-এর কোনো বিষয় নেই। কারণ, কৃষকরা ভবিষ্যতের চাহিদা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে অক্ষম ছিলেন। বাস্তব জীবনে সবসময় এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।
যাইহোক, বাজারের সক্ষমতা হলো এই যে, এটি আত্ম-সংশোধন করে। কারণ, খামারিরা উচ্চমূল্যে বেশি উৎপাদন করতে উৎসাহিত হবেন। সুতরাং পরবর্তী উৎপাদন চক্রে উচ্চতর পরিমাণ Q3 উৎপাদিত হবে, এবং দাম P3-এ পড়বে; যা PI-এর কাছাকাছি। এই ঘটনাক্রমে কৃষি বাজারে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ওঠা-নামার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এতে প্রতীয়মান হয় যে, বাজারে পণ্যের ঘাটতি কমানোর অস্থায়ী প্রতিকার হলো- মূল্যবৃদ্ধি; যা একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতে সব সময় সরবরাহ বৃদ্ধি করে এবং সময়ের সাথে সাথে দাম কমায়।
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কয়েক মাসের জন্য ডিম এবং মুরগির দাম বাড়লে প্রতিযোগিতা কমিশন যে অনৈতিক কারসাজির অভিযোগ তোলেন তা অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন। কৃষিপণ্যের বাজারে দামের ওঠা-নামা স্বাভাবিক। এতে ‘যোগসাজশ’ প্রমাণিত হয় না।

যদি দীর্ঘ সময় ধরে (এক বছর বা তার বেশি) ডিম ও ব্রয়লারের দাম ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেতেই থাকত এবং ঘাটতি কমাতে সরবরাহ বাড়ানো না হতো; তাহলে পোল্ট্রি শিল্পকে অভিযুক্ত করার ভিত্তি থাকত। কিন্তু এমনটা কখনো হয়নি। যেকোনো সময়ের তথ্য নিলে দেখা যাবে যে, ডিম ও ব্রয়লারের দাম নিয়মিতভাবে ওঠা-নামা করে; ঠিক যেমনটি কবওয়েব মডেলে পূর্বাভাস করা হয়েছে।
দেশের পোল্ট্রি বাজার যে প্রতিযোগিতামূলক, তার আরেকটি প্রমাণ হলো- যদি কৃত্রিমভাবে মূল্য নির্ধারণ করা হতো, তাহলে ডিম ও ব্রয়লার উৎপাদনকারীরা কখনই তাদের পুঁজি হারাতেন না। কারণ একচেটিয়া কোম্পানিগুলি ক্রমাগত উচ্চ মূল্য এবং মুনাফা নিশ্চিত করতে উৎপাদন কমিয়ে দিতেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, যেকোনো পর্যবেক্ষক দেখতে পাবেন যে, বাংলাদেশে ডিম ও ব্রয়লারের দাম ক্রমাগত ওঠা-নামা করে এবং বছরে অন্তত এক বা দুই মাস খামারিরা লোকসান করেন। কবওয়েব মডেল অনুযায়ী, মুরগির ও ডিমের দামের ওঠা-নামা; প্রতিযোগিতামূলক কৃষি বাজারের পক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশেও প্রতিযোগিতা কমিশনের মতো সংস্থা রয়েছে। উন্নত দেশগুলিতে এই জাতীয় সংস্থায় সাধারণত অর্থনীতি বা ব্যবসা প্রশাসনে স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি ডিগ্রিধারীসহ যোগ্য টেকনোক্র্যাটদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তা না হলে, তাঁদের পক্ষে যেকোনো বাজারে চলমান দাম, দ্রব্যমূল্যের গতিবিধি, অবৈধ অ-প্রতিযোগিতামূলক কার্যকলাপ চলছে কি না তা বিচার-বিশ্লেষণ করা অসম্ভব।

দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনে কর্মকর্তাদের অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক দক্ষতার অভাব রয়েছে এবং এটা স্পষ্ট যে, কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণে কবওয়েব মডেলের মতো মৌলিক অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলি সম্পর্কে তাঁরা অবগত নন; যদিও এই মডেলটি গত শতাব্দীর বেশিরভাগ সময় ধরে মানসম্মত কৃষি অর্থনীতি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কবওয়েব মডেল অনুসারে, দামের ওঠা-নামা যেখানে স্বাভাবিক; দক্ষতার অভাবে, প্রতিযোগিতা কমিশন সেখানে ‘ফিক্সিং’ দেখছেন।
এর ফলে, ন্যায্যবিচার নিশ্চিত না করেই পোল্ট্রি কোম্পানিগুলোকে কোটি কোটি টাকা জরিমানা করা হচ্ছে, যা এই খাতে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের পোল্ট্রি শিল্পের ভবিষ্যত বিকাশের জন্য এই শিল্পের বিরুদ্ধে সমস্ত মামলা প্রত্যাহারকরণ এবং অবিলম্বে যোগ্য অর্থনীতিবিদদের অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিযোগিতা কমিশনের সংস্কারের দাবি জানাচ্ছি।

জীশান হাসান : কাজী ফার্মস গ্রুপ এবং দীপ্ত টিভির সহযোগী কোম্পানি কাজী মিডিয়ার একজন পরিচালক।

×