ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা ॥ মানুষ অমানুষ

প্রকাশিত: ২০:০৫, ১ জুন ২০২০

করোনা ॥ মানুষ অমানুষ

২৩ মে ২০২০ ফেসবুকের পাতায় আমার ফেসবুক বন্ধু নিলয় চক্রবর্তীর টাইমলাইনে দেখলাম একটা ছবি। একটা মানুষকে গামছা দিয়ে ঢেকে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়েছে। পাশে কয়েক ফুট দূরে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা বসে আছে। নিলয় তার টাইমলাইনে লাশটির পরিচিতি দিল এভাবে : নোয়াখালী জেলার সদর উপজেলার ১১ নং নেয়াজপুর ইউনিয়নের উত্তরে দাসপাড়া কোনার বাড়ির প্রমোদ মজুমদার নামে একজন করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সকালে মৃত্যুবরণ করলেও রাত অবধি তার লাশ রাস্তায় পড়ে ছিল। একটু পরেই আমাদের সফটওয়্যার শিল্পের স্নেহভাজন সাবিলা ইনুন যোগাযোগ করে জানাল যে, গামছায় ঢাকা এই মৃত ব্যক্তির ভাতিজা চন্দ্র সফটওয়্যার শিল্পের লোক ও তার বন্ধু। করোনা সন্দেহে চন্দ্রর কাকার লাশের সৎকারের জন্য কেউ এগিয়ে আসছে না। তাৎক্ষণিকভাবে আমার একান্ত সচিবের মাধ্যমে সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় অবশেষে আধ ঘণ্টার মধ্যেই তার সৎকার করা হলো। করোনাকালে ফেরি ভরে বাড়ি যাওয়া-আসার দৃশ্য বা বাজারে অস্বাভাবিক ভিড় দেখে আঁতকে উঠলেও বাস্তবে লাশ নিয়ে দুর্গতির একটি সাধারণ চিত্র এটি। করোনাকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেবল গুজব রটানো নয় আরও অমনুষ্যত্ব কিংবা আতঙ্ক চোখে পড়ে যখন আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন মানুষের সঙ্গে আপনজনসহ আত্মীয়স্বজন বা পাড়া প্রতিবেশীদের আচরণ ব্যাখ্যা করা হয়। কখনও কখনও মনে হয় আমরা যেন মনুষ্যত্ব চরমভাবে হারিয়ে ফেলেছি। যে দেশে একজন অতি সাধারণ মানুষও অন্য একজন মানুষের পাশে না থেকে নিজেকে স্বস্তিতে রাখত না সেখানে এখন মা-বাবা, সন্তানাদির সঙ্গে ভয়ঙ্কর আচরণ করা হচ্ছে। মানুষ তার প্রিয়জনকে ফেলে চলে যাচ্ছে বা মৃতদেহ সৎকার করছে না। ইমাম সাহেব জানাজা পড়াচ্ছেন না-বা জানাজায় শরিক হচ্ছে না কেউ অথবা কবর খোঁড়া বা গোসল করানোর মানুষ নেই। এমনকি কবরস্থানে কবর দিতে দেয়া হচ্ছে না। বাড়িওয়ালা সাধারণ মানুষ, কর্মজীবী, ডাক্তার-নার্সকে বাড়ি ছাড়তে নোটিস দিচ্ছে। মসজিদের খাটিয়া করোনা আক্রান্ত রোগী বহন করতে দেয়া হয়নি এমন নজিরও রয়েছে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে যে, মৃতদেহ থেকে সংক্রমণের আশঙ্কা ক্ষীণ। এসব দৃশ্য মানব ইতিহাসে অমানবিকতারই প্রমাণ। এটি সত্য যে ভাইরাসটি ছোঁয়াচে সংক্রামক। ফলে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন যাপন করা অতি প্রয়োজনীয়। তবে সেটি মানার ক্ষেত্রেও এমন কোন কারণ নেই যে আমরা অমানুষ হয়ে যাব। বরং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে হাটবাজার, বিপণি বিতান থেকে শখের কেনাকাটাতেও বিপুল জনসমাগম হয়েছে। লক্ষ্মীপুরের দোয়া মাহফিল বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জানাজা এবং এখন বিপণি বিতানগুলোর অবস্থা দেখলে খুব সহজেই বোঝা যায় যে করোনাবিষয়ক সতর্কতা মোটেই কার্যকরভাবে পালিত হচ্ছে না। ঘটনা এক ৬ মে ২০ ফেসবুকে প্রকাশিত সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন দেখুন: কেউই লাশ নামাতে দেয় না। আবদুল হাই (৬৫) অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। তার মরদেহ নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো অ্যাম্বুলেন্স। তখন রাত ১১টা। অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শুনে হাইয়ের আপন ভাই, চাচাতো-জেঠাতো ভাইয়েরা বেরিয়ে আসেন। প্রতিবেশীরাও হাজির। না, তারা কেউ লাশ নামাতে আসেনি। এসেছে যেন কেউ লাশটি নামাতে না পারে সেজন্য। সবাই একবাক্যে বলে দিল, আবদুল হাই করোনায় মারা গেছে। তার লাশ গ্রামে দাফন করা যাবে না। হাইয়ের স্ত্রী ফিরোজা এবং ছেলে শাহজাহান বারবার চেষ্টা করেও বোঝাতে পারেন না। লাশ নামাতে উদ্যত হলে উপস্থিত লোকজন তাদের ওপর চড়াও। ফিরোজা কান্নাকাটি শুরু করলেন। আকুতি জানালেন, গ্রামের কবরস্থানে জায়গা না হলে নিজের ভিটেমাটিতে স্বামীকে কবর দেবেন। ফিরোজার কান্নায় কারও মন গলল না। উল্টো উত্তেজিত লোকজন মা-ছেলেকে এসে মারপিট শুরু করল। এই ‘বীরপুরুষের’ দল গ্রাম রক্ষা করতে চায়। সাফ জানিয়ে দেয়, মরদেহ এখানে দাফন হবে না, মা-ছেলে এ্যাম্বুলেন্স ঘুরিয়ে চলে যান আরেক গ্রামে আত্মীয়ের বাড়ি। সেখানেও প্রত্যাখ্যাত তারা। এভাবে রাত ২টা বেজে গেল। একটি ভ্যানগাড়ি জোগাড় করেন শাহজাহান। এ্যাম্বুলেন্স থেকে বাবার লাশ নামিয়ে ভ্যানে তোলেন। ছেলে ভ্যান টানছেন, বাবার মরদেহের পাশে মা বসে আছেন। ঘটনাটি ময়মনসিংহের গৌরীপুরে। আবদুল হাইয়ের বাড়ি পৌরসভার সাতুতি গ্রামে। নানা গ্রাম ঘুরে হাইয়ের মরদেহ নিয়ে ভ্যানটি থামে পৌরসদরের একটি ধান মহালের সামনে। গভীর রাতে থানায় এ খবর গেলে পুলিশ ছুটে আসেন। তারা আবদুল হাইয়ের মরদেহ নিয়ে সাতুতি গ্রামে যান। ওই গ্রামেই মরদেহ দাফনের ব্যবস্থা করেন। আমি আসলে বুঝতে পারছি না কোন দেশে বসবাস করছি একবার চিন্তা করুন, যদি সত্যিই আবদুল হাই করোনার রোগী হতেন, সত্যিই করোনায় মারা যেতেন, তাহলে কী অবস্থা হতো স্বামীর মরদেহ নিয়ে একজন স্ত্রীর কিংবা বাবার মরদেহ নিয়ে সন্তানের রাতভর ছুটোছুটির এই ছবি কল্পনা করলেই শিউরে উঠি। সাতুতি গ্রামের এই কাপুরুষেরা কোনদিন মরবে না? ইতিহাস সাক্ষী থাকবে। স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক সমকাল। ঘটনা দুই এমন আরও একটি ঘটনা আমার নিজেরই মোকাবেলা করতে হয়েছে। মে মাসের ৩ তারিখ সকালে হঠাৎ করেই আমাদের টেলিটকের একজন কর্মচারী ফোন করল। কুশল বিনিময়ের আগেই মেয়েটি কাঁদতে শুরু করে দিল। কোন মতে কান্না থামিয়ে জানতে চাইলাম তার কি হয়েছে। সে জানাল সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর মার্চ মাসে সে ও তার স্বামী ঢাকা ছেড়ে তার শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিল। আজকে ফিরে এসেছে। কিন্তু বাড়িওয়ালা তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। আমি বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলে জানলাম তার ৮০ বছর বয়স। কিন্তু সদ্য বিবাহিতা তার নাতনির বয়সী মেয়েটির প্রতি তার কোন দরদ পাওয়া গেল না। অনেক অনুরোধের পর পুলিশের ভয় দেখিয়ে মেয়েটিকে বাড়িতে উঠতে দেওয়াতে পারলাম। কিন্তু স্বল্প আয়ের এই মেয়েটির ওপর দুই মাসের অগ্রিম বাড়িভাড়া দাবি করে বসল এই বাড়িওয়ালা। করোনার সময়ে নতুন বাড়ির সংস্থান করতে না পারার কারণে বাড়তি চাপই তাকে নিতে হলো। ঘটনা তিন গত ১৮ মের ঘটনা। মাত্র ১৭ দিনের একটি শিশুকে অসুস্থ মনে করে তাকে নিয়ে রাত ৯টায় এক মা ঢাকার একটি বিখ্যাত হাসপাতালের জরুরী বিভাগে গেলেন। সেখানেই ১৭ দিন আগে সন্তানটিকে সিজারিয়ান অপারেশন করা হয়েছে। মায়ের করোনা পরীক্ষাও করা হয়েছে- যা নেগেটিভ পাওয়া যায়। প্রায় আধা ঘণ্টা জরুরী বিভাগে রেখে শিশুটিকে কেউ দেখলও না। বরং মা টিকে সেই রাতে জরুরী বিভাগ থেকে বের করে দেয়া হলো। অন্য একটি হাসপাতাল দেখল শিশুটির সামান্য ইনফেকসন হয়েছে মাত্র। আরও অনেক করোনাকালে এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে। একদিকে স্বাস্থ্যবিধি মোতাবেক শারীরিক দূরত্ব বজায় না রেখে নিজের ও অন্যের জীবন বিপন্ন করা হচ্ছে, অন্যদিকে করোনা থাকুক বা না থাকুক অসুস্থ মানুষ মাত্র অমানবিক হয়রানির শিকার হচ্ছে। এটি শহরে যেমন আছে তেমনি আছে গ্রামে। মাকে গাড়িতে করে এনে জঙ্গলে ফেলে যাবার পর পুলিশ কর্তৃক উদ্ধার করার যেমন ঘটনা আছে তেমনি আছে বাড়ির উঠানে হাঁটতে যাবার জন্য মাকে ঘরে ঢুকতে না দেবার ঘটনাও। আমার গ্রামের বাড়ির পাশের থানা শাল্লায় দুই ছেলে ও তাদের স্ত্রীরা তাদের মাকে ঘরে ঢুকতে দেয়নি এই অজুহাতে যে মা নাকি বাইরে থেকে আসা ধান কাটা শ্রমিকরা যেখানে থাকে সেখানে গিয়েছিল। মা কেবল উঠানে বেড়াতে যাবার কথা বার বার বলার পরও অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। অবশেষে পুলিশকে এসে মাকে ঘরে তুলে দিতে হয়েছে। সাধারণ মানুষতো বটেই অমানবিকতার ধারাটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যুক্ত একাংশের মাঝেও বিস্তৃত ছিল। কোন কোন বেসরকারী হাসপাতালে বন্ধ নোটিস, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু, ডাক্তার ও নার্স না পাওয়া, হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও ডাক্তার না পাওয়া বা হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়া অতীতের সকল নির্মমতাকে হার মানিয়েছিল। বিশেষ করে আমাদের দেশের বেসরকারী হাসপাতালগুলো এই সময়ে তাদের কর্তব্য ভুলে ছিল বলেই মনে হচ্ছে। আমার নিজের ব্যাখ্যা হচ্ছে তাদের নিজেদের সুরক্ষা প্রস্তুতি না থাকায় তারাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও এমন ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বেসরকারী হাসপাতালগুলো যাদের ওপর দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার শতকরা ৬০ ভাগ নির্ভর করে তাদের নীরবতা সবাইকে বিস্মিত করেছিল। তবে ৯ এপ্রিল ২০২০ বেসরকারী হাসপাতাল ও কলেজের সমিতি প্রকাশ্যে ঘোষণা প্রদান করে যে, দেশের সকল বেসরকারী হাসপাতাল ২৪ ঘণ্টা খোলা থেকে জনগণকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে থাকবে। এটি প্রকৃতার্থে একটি বড় ঘোষণা। কারণ এর ফলে চিকিৎসা সেবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত হতে পারে। তবে মে মাসের শেষ সপ্তাহ এলেও স্বল্পসংখ্যক বেসরকারী হাসপাতাল নিজেদের প্রস্তুত করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। বাকিরা কবে প্রস্তুত হবে এবং এই দুঃসময়ে কবে জনগণের পাশে থাকবে সেটি কেউ জানে না। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে যে, করোনাতো দূরের কথা কোন কোন হাসপাতাল অন্য রোগীর সেবাও দিচ্ছে না। স্বাভাবিক অবস্থায় তারা যেভাবে ব্যবসা করে থাকে সেই তুলনায় তাদের জাতীয় দায়িত্ব হওয়া উচিত মহামারীর সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। বর্তমান জরুরী পরিস্থিতি কাটাতে পারলে এদের বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যদিকে সরকারী হাসপাতালগুলো তাদের ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পুরো জাতি এখন সালাম জানায়। ঢাকা, ২৯ মে ২০২০ (মতামত লেখকের নিজস্ব) লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা এর প্রণেতা [email protected], www.bijoyekushe.net.bd
×