ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বৌদ্ধধর্ম বিষয়াসক্তির ধর্ম নয়

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ৬ মে ২০২০

বৌদ্ধধর্ম বিষয়াসক্তির ধর্ম নয়

গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম হলো বৌদ্ধধর্ম। যখন ধর্মের ক্ষেত্রটি হলো অবনমিত ও অর্থহীন আচারসর্বস্ব, কুসংস্কারে নিমজ্জিত। তখন বুদ্ধ এসেছিলেন তাকে সংস্কার করে তাতে নতুন জীবন সঞ্চার করার জন্য। বৌদ্ধধর্ম আচারসর্বস্বতা থেকে মুক্ত। বুদ্ধ নতুন যে ধর্মের প্রবর্তন করতে চেয়েছেন, তা ধর্মকে জড়তা এবং প্রাচীনতা থেকে মুক্ত করতে। ‘কোন অনুশাসন বা প্রাচীন শিক্ষার দ্বারা চালিত হয়ো না। যদি দেখ কোন শিক্ষাহিতকারী নয় এবং বাস্তবক্ষেত্রে তা লোকসান এবং দুঃখকেই ডেকে আনে- তা হলে তাকে পরিত্যাগ কর’ -এই ছিল বুদ্ধের অভিমত। বৌদ্ধধর্মে আত্মপ্রচেষ্টার ওপর সমধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দৈববাদীদের বক্তব্যকে বুদ্ধ নস্যাত করেছিলেন। তিনি বললেন, ...‘বুদ্ধগণ কেবল পথনির্দেশ করতে পারেন। কিন্তু তোমার মুক্তির পথ তোমাকেই পরিশ্রম করে তৈরি করতে হবে। প্রাচীন ‘ললিত বিস্তর’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে... ‘প্রাপ্য বিষয় যাতে লাভ করা যায়, সে রূপ আচরণ কর, এখানে অপরে তোমাদের সাহায্য করবে, এমন সম্ভাবনা নেই। স্বয়ং নিরন্তর প্রযত্ন সহকারে চেষ্টা কর। তাই ভগবান বুদ্ধও মহাপরিনির্বাণের আগে প্রিয় শিষ্য আনন্দকে সম্বোধন করে বলেছেন... হে আনন্দ! আত্মদীপ হয়ে বিহার কর, অনন্য শরণ হয়ে বিহার কর, ধর্মদীপ হয়ে বিহার কর, ধর্ম শরণ হয়ে বিহার কর। বৌদ্ধধর্মে অলৌকিকতার কোন স্থান নেই। সব রকম অনুমান, ভবিষ্যদ্বাণী বা পূর্বাভাস দেয়াকে বুদ্ধ নি¤œ পর্যায়ের বলে নিন্দা করেছেন। যদিও তিনি তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলেছেন যে, মানবমনের দ্বারা অতিলৌকিক শক্তি অর্জন সম্ভর-তথাপি তিনি তাঁর অনুগামীদের ঐসবের সংস্পর্শে আসতে নিষেধ করেছিলেন। মূল বৌদ্ধধর্মের বৈশিষ্ট্যগুলো হলোÑ ১। এটি অভিজ্ঞতাভিত্তিক। এর আগে কখনও ধর্ম প্রত্যক্ষ যুক্তিবাদের প্রতি এত দ্ব্যার্থহীন আবেদন নিয়ে উপস্থাপিত হয়নি। এখানে প্রতি প্রশ্নে আপন অভিজ্ঞতাই ছিল চূড়ান্ত পরীক্ষার ক্ষেত্র। ২। এটি বৈজ্ঞানিক। জীবনের অভিজ্ঞতাই এই ধর্মের চূড়ান্ত পরীক্ষা এবং এই ধর্ম সেই অভিজ্ঞতা তাতে কার্যকারণ সম্বন্ধকেই প্রাধান্য দিয়েছিল। ৩। এটি সর্বোৎকৃষ্ট বাস্তবধর্ম- যা শুধু দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব সমস্যাগুলোকেই নির্দেশ করে না, তাদের সমাধানের উপায়ও বলে দেয়। ৪। এটি আরোগ্যকারী। বুদ্ধের ভাষায়Ñ ‘আমি একটা জিনিস শিক্ষা দিইÑ দুঃখভোগ এবং দুঃখভোগের অবসান অর্থাৎ, ব্যাধি এবং তার নিরাময়। ৫। এটি মনস্তাত্ত্বিক। প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধ মানবসমাজের সমস্যা নিয়েই শুরু করেছিলেন এবং সেগুলোর সম্মুখীন হওয়ার পন্থাও নির্ধারণ করেছিলেন। ৬। এটি সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেই সময়ে কেউ না বললেও তিনি জোরের সঙ্গে বলেছিলেন যে, স্ত্রীজাতি পুরুষের মতোই আলোকপ্রাপ্ত হতে পারে। জাতিভেদ প্রথানুযায়ী বংশানুক্রমিক কুশলতার ধারণাকেও তিনি অগ্রাহ্য করেছিলেন। যদিও তিনি ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তথাপি তার স্বভাবানুযায়ী জাতিভেদের গ-ি ভেঙ্গে তিনি সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে তাঁর সঙ্গে স্থান দিয়েছিলেন। ৭। বৌদ্ধধর্ম ব্যক্তিমানবের জন্য প্রচারিত হয়েছিল। মানুষের সামাজিক দিকটা বুদ্ধ অগ্রাহ্য করেননি। তিনি কেবল ধর্মীয় সংঘই স্থাপন করেননিÑ সংঘের দ্বারা মানবের ব্যক্তিগত সমস্যাদির সমাধানের ওপরও জোর দিয়েছিলেন। প্রত্যেককে নিজস্ব পরিস্থিতি এবং দুরবস্থার মোকাবেলা করে আলোকপ্রাপ্তির পথে অগ্রসর হতে হবে। ত্রিরতেœ খচিত বৌদ্ধধর্ম। বুদ্ধ, ধর্ম আর সংঘ। বুদ্ধের মহাজীবন তাঁর ধর্মের প্রধান অবলম্বন। বুদ্ধের চার সত্য তাই মূলত আর্যসত্য। বৌদ্ধধর্মের একটি বড় কথা জন্মান্তরবাদ। চার আর্যসত্য আর আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গÑগৌতম বুদ্ধের ধর্মের এই হলো মূল কথা। চার আর্যসত্য হলো : (১) দুঃখজ্ঞান (বা দুঃখের স্বরূপ); (২) দুঃখের কারণ জ্ঞান (বা দুঃখের উৎপত্তি); (৩) দুঃখের নিরোধ জ্ঞান (বা দুঃখের বিনাশ) এবং (৪) দুঃখ নিরোধের উপায় (বা দুঃখ ধ্বংসের উপায়) অর্থাৎ, নিরেট জ্ঞান। বুদ্ধ এই চার আর্যসত্য ব্যতীত অন্য কোন ধর্ম নেই বলেছেন। সম্বোধি লাভের পর থেকে পরিনির্বাণ লাভ পর্যন্ত যা তিনি সূত্র ও গাথায় ব্যাখ্যা করেছেন, সে সবই এই চার আর্যসত্যের অন্তর্ভুক্ত। গভীর সমাধিতে এই চার আর্যসত্য উপলব্ধি করে সিদ্ধার্থ বুদ্ধ বা তথাগত নাম ধারণ করলেন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবের সমস্ত ব্যাপারটাই দুঃখময়। এই দুঃখের কারণ নিশ্চয়ই আছে। দুঃখের কারণ কি? তৃষ্ণা (তন্হা) বা বাসনা। এর আত্যন্তিক নিবৃত্তিতেই দুঃখের নাশ। কারণের নাশে কার্যের বিনাশ। উপায় হলো অষ্টাঙ্গিক মার্গ : (১) সম্যক দৃষ্টি, (২) সম্যক সঙ্কল্প, (৩) সম্যক বা (সত্য, সরল, প্রিয়বাক্য বলা), (৪) সম্যক কর্মান্ত (সৎ আচরণ), (৫) সম্যক আজীব (সর্বভুতে অহিংসাপূর্ণ সাধু জীবিকা), (৬) সম্যক ব্যায়াম (আত্মসংযম বা আত্মোৎকর্ষ), (৭) সম্যক স্মৃতি (ধারণা ঠিক রাখা), (৮) সম্যক। সমাধি (ধ্যান, মনন, নিদিধ্যাসন)Ñ এই অষ্টাঙ্গিক মার্গকে বুদ্ধদেব বলেছেন, ‘ব্রহ্মচরিয়ং’ বা ব্রহ্মচর্য। আবার চিত্তের পরম একাগ্রতারূপ সমাধিকেও তিনি বলেছেন সম্যক সমাধি। সম্যক সমাধি খুব বেশি রকমভাবে হিন্দুধর্মের রাজযোগ প্রদর্শিত পন্থাগুলোর সদৃশ এবং উভয়ের লক্ষ্য একই। তবে যা ছিল আর্যঋষিদের ধারণার সামগ্রী, তাকেই বাস্তব করে তুললেন বুদ্ধ। প্রত্যক্ষ করলেন নিঃসংশয়ভাবে এবং সার্থকভাবে প্রয়োগ করলেন মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে। বুদ্ধের বুদ্ধত্ব এইখানেই। বৌদ্ধধর্মের আর একটি অঙ্গ ব্রহ্মবিহার। ব্রহ্মবিহারের লক্ষণ বৌদ্ধশাস্ত্রে এইভাবে নেয়া হয়েছে : মা যেমন প্রাণ দিয়েও নিজের সন্তানকে রক্ষা করেন, ঠিক তেমনই সকল প্রাণীর ওপর অপরিমিত দয়াভাব দেখাবে। ঊর্ধ্বে, অধোদিকে, চতুর্দিকে সমস্ত জগতের প্রতি বাধাশ্যূন্য, হিংসাশূন্য, শত্রুতাশূন্য মনে অমিত করুণা দেখাবে। কি দাঁড়াতে, কি চলতে, কি কথা বলতে, কি শুতে, যতক্ষণ নিদ্রিত না হবে, এই মৈত্রীভাবে অধিষ্ঠিত থাকবে। এইটিই বৃহ্মবিহার। মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষা- এই চার রকম ব্রহ্মবিহারের কথা বৌদ্ধশাস্ত্রে আছে। জনসাধারণ যখন নিজেদের দ্বন্দ্ব আর সংশয় নিয়ে স্বয়ং বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হয়েছিল তখন তিনি উত্তরে যা বলেছিলেন তা তাঁর বাণীর সম্যক পরিচায়ক। তারা জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কি ঈশ্বর? ‘না’। কোন দেবদূত? না। কোন সাধু-মহাত্মা?’ আবার উত্তর, ‘না’। তখন প্রশ্ন হলো, ‘তাহলে আপনি কি? বুদ্ধ উত্তর দিলেন, ‘আমি বুদ্ধ’। বুদ্ধের উত্তরেই তার স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছিল। সংস্কৃত ভাষায় ‘বুধ’ শব্দের অর্থ জাগরিত হওয়া এবং জানা। সেই হিসেবে বুদ্ধ শব্দের অর্থ ‘আলোকপ্রাপ্ত (জ্ঞানী) অথবা জাগরিত।’ বুধ ধাতু থেকে ‘বোধি’ ‘বুদ্ধ’ এবং ‘বৌদ্ধ’ শব্দের উৎপত্তি। বুধ জাগরণ ও বিকাশনার্থে ব্যবহৃত হলেও বিশেষ করে জ্ঞানার্থে ব্যবহৃত হয়। বোধি অর্থ পরম জ্ঞান (ঊহষরমযঃবহসবহঃ)। বুদ্ধ পরম জ্ঞানী এবং বৌদ্ধ সে মহাজ্ঞানের সাধক বা বুদ্ধের অনুগামী শিষ্য। তাঁর জীবৎকালে তাঁর আপত্তি সত্ত্বেও বরাবর তাঁকে ঈশ্বররূপে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হয়েছিল। সর্বক্ষেত্রেই তিনি এর প্রতিবাদ করেছেন এবং নিজের মানবত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। নির্বাণ- এই একটি কথার মধ্যেই বিধৃত রয়েছে বুদ্ধ, বুদ্ধের ধর্ম এবং তাঁর দর্শন। বৌদ্ধ সাধনার চরম ও পরম লক্ষ্য নির্বাণ। নির্বাণের মূর্ত বিগ্রহ বুদ্ধ। নির্বাণ নেতিবাচক নয়। এটি শূন্য নয়। এটি ইতিবাচক। অনির্বচনীয় আনন্দময় জীবন প্রাপ্তিই নির্বাণ। তৃষ্ণার যে অনলশিখা প্রতিনিয়ত দাউ দাউ করে জ্বলছে, নির্বাণ তারই ক্ষয়। কর্মের বন্ধনই তৃষ্ণার মূল-জন্ম-জরা-মরণপথ-প্রবর্তক। সেই কর্মবন্ধনের ক্ষয়ই নির্বাণ। বুদ্ধ বলেছেন, সারথি যেমন অশ্বকে দমন করে, সেই রকম যিনি ইন্দ্রিয়কে শান্ত করেছেন, যিনি নিরভিমান ও কলুষহীন, দেবতারাও তাকে ঈর্ষা করেন। এ অবস্থা আনন্দের, নিরানন্দের নয়। লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন, ঢাকা email:[email protected]
×