ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

বিশ্বের দেশগুলো স্বার্থপর হবে না তো?

প্রকাশিত: ০০:৩৫, ৩০ এপ্রিল ২০২০

বিশ্বের দেশগুলো স্বার্থপর হবে না তো?

প্রাণঘাতী করোনা মহামারী একদিন নিশ্চয় শেষ হবে। তখন দেশে দেশে অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার রেষারেষি শুরু হয়ে যাবে না তো? এই শঙ্কাটি মনে উদয় হয় নানা কারণে। প্রথমত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এত লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, বিশেষত ইউরোপে। মনে করা হয়েছিল- ইউরোপ আর কোনদিন যুদ্ধে জড়াবে না বা কোন যুদ্ধে মদদ দেবে না। কিন্তু, রেনেসাঁ পরবর্তী জ্ঞান-বিজ্ঞানে দ্রুত অগ্রসর হতে যাওয়া ইউরোপে এক ধর্মান্ধ, অন্ধ জাতীয়তাবাদে আসক্ত চরম সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভিত্তিতে নতুন এক গণহত্যার আহ্বানকারী একনায়ক হিটলারের উত্থান দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূচনা ঘটায়। এই নাজিবাদের শত্রু গণ্য হলো- ইহুদী ধর্মীয় গোষ্ঠী ও কমিউনিস্ট দেশগুলোর। জার্মানির হিটলার ইতালির মুসোলিনি জাপানের সঙ্গে এক অক্ষ শক্তির জন্ম দিলেন। নতুন কমিউনিস্ট দেশ- সোভিয়েত রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র মিত্রবাহিনী গঠন করে। বিশ্বময় যে রক্তাক্ত, ধ্বংসযজ্ঞ এবং পরমাণু বোমার আঘাতে সংঘটিত সেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারের বিরুদ্ধে মিত্র বাহিনী বিজয়ী হয়। হিটলারের নাজি বাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে এটা প্রয়োজনীয় ছিলÑ একথা বলাবাহুল্য। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের পর ইউরোপের রণক্লান্ত দেশগুলো বিশেষত ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, হল্যান্ড অন্য প্রকৃতির এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকার অনুন্নত দেশগুলোকে নিজেদের শাসনাধীন উপনিবেশ বানায়। অর্থাৎ, ইউরোপের সূচিত শিল্প কারখানার কাঁচামাল সরবরাহ ও তৈরি পণ্যের বাজার তৈরি, স্থানীয় উপনিবেশগুলোর খনিজ, বনজ, অন্যান্য সম্পদ ইউরোপে স্থানান্তর করার নতুন এক শোষণের অর্থনীতির সূচনা করে। যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে ব্রিটেনের অধীনতা ছিন্ন করে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেছিল। ব্রিটেন ভারত উপমহাদেশকে যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্য সরবরাহ করার পুরস্কার হিসেবে স্বাধীনতা দেয়ার কথা দেয়। ১৯৪৭ সালে বিভক্ত ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়। এই ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে আমরা বর্তমানে যে ভয়াবহ বিশ্বজুড়ে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সঙ্গে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে এক যুদ্ধে রত আছি, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যে আমরা আরেক হিটলারের মতো নেতৃত্ব দেখতে পাচ্ছি, যা আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। বিশেষত সেখানে এফবিআইয়ের গবেষকরা এবং একই সঙ্গে বিজ্ঞানীরা এই করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হিসেবে জলবায়ু উষ্ণ হওয়ার ফলে বরফ গলে তার নিচ থেকে বের হয়ে আসা লাখো বছর যাবত জমে থাকা ভাইরাসের সূর্যের আলো, হাওয়া তাদের পুনর্জীবিত করেছে এবং বাদুড়, বনরুইÑ এসব প্রাণীর দেহে আশ্রয় নিয়ে পরে কোনভাবে মানুষের দেহে প্রবেশ করেছে এমন একটি সিদ্ধান্তে এসেছে। বিজ্ঞানীরা আরও পরীক্ষা করে দেখেছেন, ল্যাবে তৈরি জীবাণুর বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এ ভাইরাসের গঠনের কোন মিল নেই। মিল আছে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া সার্স, মার্স ফ্লুর ভাইরাসের গঠনের সঙ্গে। কিন্তু ট্রাম্প চীন ও ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনকে দোষী সাব্যস্ত করছে। চীনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড হেলথের জন্য প্রদেয় গ্রান্ট বন্ধ করেছে। এদিকে পশ্চিমা দেশগুলোতে পড়াশোনা করতে যাওয়া শিক্ষার্থীরা ফান্ড সমস্যায় পড়ছে। স্কলারশিপ বন্ধ হয়েছে অনেকের। ব্রিটেন আগে থেকেই এশিয়া, আফ্রিকার শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ, চাকরি করার সুযোগ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। এখন ইউরোপের দেশগুলো বাণিজ্য ঠিক রাখবে নাকি হ্রাস করবেÑ এর ওপর নির্ভরশীল আমাদের মতো উন্নয়নশীল জনবহুল দেশ, যেটির অর্থনৈতিক ভিত অনেকটা নির্ভর করে গার্মেন্ট রফতানির ওপর এবং বিদেশে শ্রমিক শ্রেণীর কাজ পাওয়ার সুযোগের ওপর। দেশগুলো যদি একে অপরের সঙ্গে পণ্য, শ্রমিক আদান-প্রদানে বিশ্বায়নের নীতি মেনে আরও একটু বেশি সহযোগিতাপূর্ণ বিশ্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলেই সব দেশের জনগণের জীবন যুদ্ধ সহজতর হবে। আমরা জানি, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ গার্মেন্ট বাজারে বাংলাদেশী গার্মেন্টকে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করতে হয়। কিন্তু, বাজারকেও মানবিক করে তোলার লক্ষ্যে দুই দেশÑ ক্রেতা ও বিক্রেতাকে শ্রম মূল্য ও একজন ব্যক্তির ‘ডিসেন্ট জীবিকা’ গ্রহণ করে ‘ডিসেন্ট’ জীবন যাপনের কোন বিকল্প নেই। এটি ক্রেতাদের ভাবনায়ও আনতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তির একটি ন্যূনতম জীবনমানের সূচক ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকে মানতে হবে। তাহলেই করোনাপরবর্তী সময়ে দুনিয়ার সব দেশ তাদের স্ব স্ব ক্ষতি পূরণ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে। এখন ত্রাণের প্যাকেজের একটি সৃজনশীল ব্যবহারের প্রসঙ্গে আসা যাক। এই প্রথমবার দেখলাম সম্ভবত খুলনাঞ্চলে- ত্রাণের প্যাকেজে চাল, ডাল, তেলের সঙ্গে আলু, বেগুন, মিষ্টিকুমড়া ইত্যাদির সমন্বয় ঘটানো হয়েছে, যা একদিকে ভোক্তা ত্রাণ গ্রহীতাদের সুষম খাদ্যের ব্যবস্থা করেছে। আবার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে কৃষকের খেতে পড়ে থাকা অবিক্রীত সবজি-শাক বিক্রির ফলে কৃষক তার উৎপাদিত কৃষিপণ্যের একটি বিক্রয়মূল্য লাভ করেছে। দেখে চমৎকৃত হয়েছি। অন্য সব ত্রাণদাতাদের এই রকম কৃষকের শাক-সবজিকেও ত্রাণের উপকরণে যুক্ত করতে আহ্বান জানাই। এভাবে আমরা উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়কে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারব এবং দুর্ভিক্ষাবস্থা এড়াতে পারব। আমরা চেষ্টা করছি গান-বাজনা-শিক্ষার টিউশনি করা কিছু পরিবারকে সাহায্য করার, যারা টিউশনি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সঙ্কটে পড়েছেন। একই সঙ্গে অন্যদেরও বলেছি, পাঠকদেরও বলছিÑ আমাদের তাঁত-টাঙ্গাইল শাড়ি, জামদানি ও বেনারসী শাড়ি তৈরিতে জড়িত অসংখ্য তাঁত শ্রমিক, সোনা-রুপার কারিগর, মিষ্টির কারিগর, মাটির-শোলার-বাঁশ-বেতের সামগ্রী তৈরির কারিগর এবং আদিবাসীদের প্রত্যেক এলাকার ত্রাণের তালিকায় যুক্ত করতে হবে। সরকারী ত্রাণের তালিকায় যেমন তাদের নাম থাকতে হবে, তেমনি ব্যক্তি উদ্যোগের ত্রাণেও তাদের নাম থাকতে হবে। কেননা, দু-তিন মাস সংসার চলার বেশি ত্রাণ একেবারে কেউ দিতে পারে না। সংবাদ সূত্রে একটি বড় ধরনের আশঙ্কাজনক দুঃসংবাদ জানতে পারলাম। বেশ ক’জন বাজার কিনে বাড়ি ফিরতে গেলে বেশ কিছু গু-া-হাইজ্যাকার প্রকৃতির যুবকের হাতে নিগৃহীত হয়, অনেকেরই বাজার তারা ছিনতাই করেছে। কজনকে চোখ রাঙ্গিয়ে ‘শুধু আপনারা ধনীরা খাবেন, আমরা খাব না, টাকা দেন’Ñ বলে অর্থ দাবি করেছে। কোন একজন ফুটপাথে বসে থাকা কর্মহীন নারী-পুরুষকে ত্রাণের চাল-ডাল-অন্য পণ্য দিতে গেলে তাদের তাড়া খেয়ে কর্মহীনরা ত্রাণ না নিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তাদের টানাহেঁচড়ায় ত্রাণের জিনিস রাজপথে ছড়িয়ে পড়ে। ঐ ব্যক্তিকে ত্রাণ না দিয়ে ফিরে যেতে হয়। পুলিশ-আর্মি সে সময় মোহাম্মদপুরে, ধানম-িতে, অর্থাৎ অকুস্থলে অনুপস্থিত ছিল। এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি এখনই বন্ধ করতে হবে। আমার গভীর সন্দেহ, আকস্মিকভাবে যুবক-তরুণরা যখন ত্রাণ কাজে নিযুক্ত, কৃষকের ধান কেটে দিচ্ছে, তখন দূর থেকে কেউ মুক্তিযুদ্ধের শত্রু, শেখ হাসিনা ও তার সরকার করোনা ও খাদ্যাভাবকে সফলভাবে মোকাবেলা করে এ সঙ্কটকালকে পরাজিত করুকÑ সে প্রক্রিয়ার একটি কাজÑ ত্রাণ প্রদান, সেটিকে ব্যক্তি মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে এ কাজ থেকে বিরত রেখে সঙ্কটটিকে গভীর করতে পরিকল্পিতভাবে এই গু-া-ছিনতাইকারীদের ব্যবহার করেছে, যা এখনই পুলিশ-সেনা বাহিনীকে বন্ধ করতে হবে। পেট্রোল বোমার পরিকল্পনাও দূরে বসে তৈরি হয়েছিলÑ তা ভুলে গেলে চলবে না। তাছাড়া, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি নিকট অতীতে ছাড়া, বার বার করেছেÑ সেটি জাতি জানে। এখনও এই সঙ্কটকালে তারা নীরব থাকবে, সেটা আশা করা যায় না। সরকার নিরাপত্তা বাহিনীকে দিয়ে অরাজকতাকারীদের সমূলে উৎখাত করুক, এটি সময়ের দাবি। লেখক : শিক্ষাবিদ
×