ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৮:৩৪, ২১ এপ্রিল ২০২০

ঢাকার দিনরাত

মগজের ভেতর করোনা স্থায়ী আবাস গড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। এই চিন্তা (নাকি দুশ্চিন্তা) সরানোর কোন ব্যবস্থা আছে কি? দেশের তিনজন করোনা রোগীর একজনই ঢাকার। লেখার শুরুতে হালফিল তথ্য তুলে ধরছি। ঢাকা থেকে কোটি মানুষ দেশের বাড়ি চলে যাওয়ার পরও ঢাকার এই অবস্থা! করোনা আক্রান্তদের মধ্যে ৩২ শতাংশই ঢাকার বাসিন্দা। এরপরেই রয়েছে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার অবস্থান। ঢাকায় শনাক্ত হওয়া করোনা রোগীর সংখ্যার দিক থেকে এখন মোহাম্মদপুর শীর্ষে। এখানে ৩৪ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর বাইরে ওয়ারীতে ২৮ জন, মিটফোর্ড এলাকায় ২৬ জন, যাত্রাবাড়ীতে ২৫ জন, লালবাগ ও উত্তরায় ২৩ জন করে, ধানমণ্ডিতে ২১ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হিসাবে এ তথ্য উঠে এসেছে। শনিবার রাতে আইইডিসিআর তাদের ওয়েবসাইটে করোনা পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে। এই তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক করোনা রোগী ঢাকায় শনাক্ত হয়েছে। ঢাকা শহরে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন ৮৪৩ জন। আসা-যাওয়ার পথের ধারে উত্তরার বাসা থেকে নিউ ইস্কাটনে জনকণ্ঠ ভবনে যাওয়া এবং ফেরার সময়ে রাস্তার দু’পাশে তাকিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ একই ছবি দেখতে দেখতে ক্লান্ত ও বিমর্ষ হয়ে পড়ছি, এ কথা আজ স্বীকারে লজ্জা নেই। যাওয়ার পথে বৈশাখের কড়া রোদ্দুরের ভেতর চারদিক ভেসে যেতে দেখে ভাবি ইউরোপ আমেরিকার বড় শহরগুলোর মানুষ আমাদের ঢাকাবাসীর মতো এমন প্রাণস্ফূর্তিময় রোদ দেখে কী ঝলমলই না করে উঠত খুশিতে। ঢাকাসহ সারা দেশে ত্রাণপ্রত্যাশী মানুষ এই রোদের ভেতর বসে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই কষ্ট আমাদের ছুঁয়ে যায়। আমার বন্ধু বিশিষ্ট লেখক-গবেষক আহমাদ মাযহার আছেন নিউইয়র্কে। সদ্য তোলা ছবি তিনি পাঠিয়েছেন মেসেঞ্জারে। সফেদ শ্মশ্রুশোভিত মুখ, ফেব্রুয়ারির বইমেলায় দেখা মুখখানি কতই না শুকিয়ে গেছে। চোখের ভেতর চাপা ক্লান্তি আর এক ধরনের অসহায়তা অনিশ্চয়তার মিশেল দেখলাম বলেই বোধ হলো। আমার ছবিও যদি যুক্তরাষ্ট্র/ যুক্তরাজ্য বা জার্মানি-ফ্রান্সের কোন বন্ধু দেখেন তাহলে তারও এমনটা মনে হওয়া হয়ত অস্বাভাবিক হবে না- আমরা যতই সুস্থ ও প্রাণবন্ত থাকার চেষ্টা করি, ভেতরে ভেতরে আমাদের ক্ষরণ চলছে। সামনের দিনগুলো নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। তাই আমাদের মুখাবয়বে তার পরোক্ষ ছাপ তো পড়তেই পারে। কিন্তু প্রকাশ্য লেখায় সেই সব লুকানো চাই। কে কতটা সফল হবেন মনের ভেতরকার শঙ্কা আর মন্দ চিন্তাগুলোকে লুকিয়ে পাঠকের সামনে ভাল ভাল কথা সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করতে! এই করোনাকালে মানুষের মনে সাহস যোগানো হতে পারে ব্রত- এমন একটি বাক্য লিখে ফেললাম বন্ধু মাযহারের সদ্যলেখা গদ্যের পাঠ প্রতিক্রিয়ায়। আমরা সমবয়সী, এক কলেজে পড়েছি। পেশাগত বিচারে আমার মতোই সংগ্রামী জীবন তার। যদিও তিন বছর হলো মাযহার সপরিবারে ইমিগ্র্যান্ট হয়েছেন মার্কিন মুল্লুকে। ঝলমলে রোদ্দুরের কথা বলতে গিয়ে কথায় কথায় এতদূর চলে আসা। নিউইয়র্কের কালকের রোদ নিয়ে মাযহার কী লিখেছেন সেটি আমার কলামের পাঠকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিচ্ছি। আহমাদ মাযহার লিখেছেন : ‘সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম রৌদ্রের উজ্জ্বলতা! বাইরে তার উদ্ভাস আমার মনে জাগিয়ে দিল কী যেন একটা নির্ঝরপ্রাণনার উচ্ছলতা। করোনাবন্দীর কাল পার করতে বিচিত্র টুকরো টাকরা পড়ায় মনোনিবেশ করতে পারলাম না। বরং দু’-চার কথা লিখতে মন চাইল। রৌদ্রলোকের তীক্ষè তাড়নাতেই বুঝি বা ল্যাপটপের কী বোর্ডে আমার আঙ্গুুল পড়তে লাগল। তা ছাড়া অনেক সময় লক্ষ্য করেছি, কিছু একটা লিখতে গেলে ন্যূনতম যেটুকু মনোসংযোগ লাগে তা সর্বব্যাপী বিষণœতা থেকে মুক্তির পক্ষে উপকারী হয়ে উঠতে পারে! মনে হলো হয়ত বা লেখার সময়টুকুতে অন্তত করোনা সংবাদে ব্যথিয়ে ওঠা থেকে মুক্ত থাকতে পারব। রোদেলা দিনের উজ্জ্বলতা দেখে স্ত্রী বকুল বলছিল, ‘আহা রে একেকটা সুন্দর দিন পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ বাইরে যেতে পারছে না!’ কথাটা আমারও মনে হয়েছে। আমি যখন প্রথম নিউইয়র্কে এসেছি তখন ছিল মে মাস। খোলা জায়গায়, পার্কে মানুষের আনন্দময় বিচরণ চোখে পড়েছিল। মেয়েরা যেন বসন গায়ে রাখতেই চায় না এমন ফ্যাশন তাদের। ছেলেরা হাফহাতার টি-শার্ট আর হাফপ্যান্ট পরতে পারলেই যেন বেঁচে যায়। স্যান্ডো গেঞ্জি পরে চলাফেরা করতে কতজনকে দেখলাম রাস্তায়! কিন্তু শীতকালের সঙ্গে বৈপরীত্য দেখার অভিজ্ঞতা না থাকায় এর তাৎপর্যটা সেবার তেমনভাবে অনুভব করিনি। এক বছরের শীত-গ্রীষ্ম পরিক্রমায় ভাল ভাবে অনুভব করলাম শীতের ছয় মাস বদ্ধতার মধ্যে থেকে যেন মুক্তি পেয়ে উল্লাস করছে তাদের শরীর! আজ সকালের রৌদ্রকরোজ্জ্বলতা দেখে বকুলের আর্তি সে কথাই মনে করিয়ে দিল।’ মাস্ক পরা মানুষ আর ওষুধের দোকান ঠিক তাই। রাস্তায় যানবাহনের মানুষ হোক বা হেঁটে চলা কিংবা দাঁড়িয়ে থাকা মানুষই হোক, এখন মাস্কবিহীন কাউকে চোখে পড়ে না। গত তিন সপ্তাহে দেশের মানুষ এই মাস্ক পরা শিখে গেছে। করোনার দাপটের আগে পথে-ঘাটে দু’-চারজন মাস্ক পরিহিত মানুষ যে চোখে পড়ত না তা নয়। ধুলাবালি থেকে নিজেকে সুরক্ষার জন্য অনেকেই মাস্ক পরতেন। আমিও বইমেলায় যে ক’দিন গেছি, সারাক্ষণ মাস্ক পরেই থেকেছি। কিন্তু এখন কাউকেই চোখে পড়ছে না মাস্কবিহীন। ঢাকাবাসীর এ সচেতনতা উল্লেখ করার মতোই। আমার মতে বেশিরভাগ মানুষই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। নিজের ভালটা বোঝেন। প্রধানমন্ত্রী বার বার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদ দিচ্ছেন, মানুষের প্রতি আহ্বান রাখছেন। আমার তো মনে হয় মানুষ সে কথা শুনছেন। তার পরেও যে ইদানীং ঢাকা শহরে প্রাইভেট গাড়ি বেশি বেশি দেখছি, পাড়া-মহল্লায়ও মানুষ বেশি বের হচ্ছেন এসব দেখে মনে হচ্ছে ঘনবসতি ঢাকায় কোন পরিবারের একজন ব্যক্তিও যদি দুয়েকদিন পর পর জরুরী প্রয়োজনে, যেমন খাবার বা ওষুধ কেনার জন্য বের হন, তা হলেও বহু মানুষকে রাস্তায় বা ঘরের বাইরে দেখা যাবে। যদি বাসার দোরগোড়ায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যেত, তা হলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ বের হতো না। আমাদের এলাকাবাসী তো মনে হয় অতিসচেতন। একদিন অফিসে যাওয়ার পথে প্রধান সড়কে ওঠার আগে অতিরিক্ত গাড়ির ভিড় দেখে আমাদের গাড়ির চালক সাত নম্বর সেক্টরে ঢুকে পড়লেন। তারপর এ রাস্তা সে রাস্তা গোলকধাঁধার মতো আমরা ঘুরতেই থাকলাম। বেরুনোর সব পথ বন্ধ, সব গেট লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। যে গেট দিয়ে আমরা সেক্টরের ভেতরে প্রবেশ করেছিলাম একমাত্র সেটিই খোলা। ফলে আবার সেই ওয়ান ওয়ে টিকেটের মতো একমাত্র প্রবেশ ও নির্গমন ফটকে এসে তারপর কিছুটা পথ পেরিয়ে প্রধান সড়কে উঠতে হয়েছিল। প্রধান সড়কে গার্মেন্টস কর্মীরা অবরোধ করে রেখেছিলেন। সংবাদপত্র লেখা দেখেও তারা ছেড়ে দিতে পনেরো মিনিট সময় নিলেন। দেখলাম তারা যে বেতন পাচ্ছেন না সে জন্য একমাত্র প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কাউকেই তারা ছাড় দিতে রাজি নন। আগে সংবাদপত্র লেখা গাড়ি দেখলে চটজলদি অবরোধকারীরা যাওয়ার সুযোগ করে দিতেন। আজকাল সেই সৌজন্যটুকুও কেন তারা করছেন না, বড় ভাবনার বিষয়। অফিস থেকে ফেরার সময়ে একমাত্র ওষুধের দোকান ছাড়া কোন দোকান খোলা দেখতে পাই না। এটা থেকেও বোঝা যায় অন্য দোকানের লোকজন সরকারের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন। কেউ নিয়ম ভাঙছেন না। এক সপ্তাহ হলো ওষুধের দোকানগুলোও অতিরিক্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা নিয়েছে। বড় দোকান হলে ভেতরে ফিতা দিয়ে প্রবেশ সীমিত করেছে। আর ছোট দোকানের লোহার জালিকা টানানো থাকছে। তার বাইরে থেকে ক্রেতাকে ওষুধ সংগ্রহ করতে হবে। রাস্তায় মসজিদের সামনে দিনমান দু’-চারটে ভ্রাম্যমাণ ফলের দোকান চোখে পড়ত। এখন তাও পড়ে না। সব মিলিয়ে ঢাকার পথঘাট আগের চেয়ে অনেক বেশি সুনসান, মৃতপ্রায়। যানজট মিস করতে হবে, এ কথা কোনদিন ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। এখন অতিরিক্ত যান আর গিজগিজ করা মানুষকে খুব মিস করি অফিসে যাওয়া-আসার পথে। মশার দৌরাত্ম্য ঘর-দোর-জানালা সব বন্ধ থাকার পরেও কিভাবে এত শত শত মশা ঘরের ভেতর চলে আসে রাতের বেলা! আমি জানি না পাঠক, আপনার ঘরের কি অবস্থা? তবে ঢাকায় যে মশা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে এবং সিটি কর্পোরেশন অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে- এতে কোন সন্দেহ নেই। একবার ডেঙ্গু শুরু হলে কি সামাল দেয়া যাবে? মশার কয়েল- স্প্রে- চাইনিজ ব্যাট- সব রকম অস্ত্রই আমরা ব্যবহার করে চলেছি মশার বিরুদ্ধে। কিন্তু রেহাই মিলছে না। সত্যি সত্যি এবার মশা মারতে কামান দাগা লাগবে। ভাই মেয়র, ফগার মেশিনগুলো দফতর থেকে বের করার নির্দেশ জারি করেন। মশার জন্য না যায় শান্তিমতো বই পড়া কিংবা টিভি দেখা। মশার জন্যই এই বাধ্যতামূলক ঘরে থাকাটা অনেকের কাছেই যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। টিভিতে তারাবি পবিত্র হজ্বের সময় খুৎবা সরাসরি আমরা দেখি এবং শুনি দেশে বসে, যেটি সম্প্রচারের ব্যবস্থা নেয় সৌদি আরব সরকার। টিভিতে বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত প্রচারিত হয় সরাসরি দেশের একাধিক বেসরকারি টিভি চ্যানেলের উদ্যোগে। এতে ইজতেমা ময়দানে যারা উপস্থিত হতে পারেন না তেমন কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষ ঘরে বসে সেই মোনাজাতে অংশ নিতে পারেন। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে ইতোমধ্যে মসজিদে না গিয়ে ঘরে থেকে নামাজ আদায় করছেন লাখো মুসুল্লি। তাই আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে বায়তুল মোকাররম থেকে তারাবির নামাজ যদি বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়, তাহলে সেটি অনুসরণ করে এবং খতিবের বা ইমামের পঠন শুনে ঘরে বসেই রোজাদাররা তারাবির নামাজ আদায়ের সুন্দর সুযোগ কাজে লাগাতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট মহল বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। ১৯ এপ্রিল ২০২০ [email protected]
×