ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

ইতালির নিরক্ষরের সন্তানদের পত্র

প্রকাশিত: ০৮:৫৮, ১৯ মার্চ ২০২০

ইতালির নিরক্ষরের সন্তানদের পত্র

বইটির নাম- ‘আপনাকে বলছি স্যার, বারবিয়ানা স্কুল থেকে’। আশ্চর্য, সেই ’৯৩ সালে একটি বিদেশী সংস্থার আগ্রহে, প্রত্যন্ত দরিদ্র নিরক্ষরের সন্তানদের জন্য তৃণমূলে ‘শিশুর বিকাশ, শিক্ষা’, নিয়ে আমার ব্যক্তিগত গভীর ইচ্ছার কারণে সরকারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে যে কার্যক্রমটি শুরু করেছিলাম, সেটির সূচনাতে আমি যে দুষ্টচক্রে দরিদ্র ও নিরক্ষরের সন্তানরা বন্দী থাকে, সেটির একটি শব্দচিত্র তৈরি করি, যেটি হুবহু মিলে যায় আজকের (অবশ্য ২০১২ সালের সংস্করণটিতে) ইতালির উত্তর পার্বত্য এলাকার দরিদ্র, নিরক্ষরের সন্তানদের মত ও মন্তব্যগুলোর সঙ্গে। সেগুলো তারা আমাদের মতো তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত শহুরে আচার-আচরণ, প্রধানত: ব্যবহৃত ভাষা ও পাঠ্যবিষয়ের প্রতি, এর অমানবিক মূল্যায়ন পদ্ধতি, পাস-ফেল নির্ধারণের পদ্ধতির প্রতি অনুগত, আমাদের মতো শিক্ষকদের প্রতি রচনা করেছে। আমরা মনে করি- আমার সন্তানকে যে যাই বলুক কোচিং দিয়ে, বাড়ির কাজ করিয়ে দিয়ে, গাইড বই, বাড়তি বই পড়িয়ে খুব ভাল একটি ‘ফল’ ধরিয়ে দেব, যাতে সে আমার চেয়েও উত্তম কোন চাকরিতে সহজেই ঢুকে পড়তে পারে! কিন্তু দরিদ্র ও নিরক্ষরের সন্তানদের অবস্থা আমাদের জানা দরকার, যা একেবারেই ভিন্ন রকম। কিন্তু আমি দুষ্টচক্রটিতে যে বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়েছি- প্রথমত, দরিদ্র ও নিরক্ষরের সন্তান পুষ্টিকর ও প্রয়োজনীয় খাবার পায় না। দ্বিতীয়ত, পরিবারের জন্য কাঠ-পাতা-পানি আনা, ছোট ভাই-বোন রাখার মতো বাড়তি কাজ তাদের করতে হয়। যার ফলে ‘পড়া’ বিষয়টি তাদের বাড়িতে অনুপস্থিত। তৃতীয়ত মা, বাবা নিরক্ষর হওয়ায় তারা সন্তানের শিক্ষা, বাড়ির কাজে মা-বাবার কোন রকম সহায়তা পায় না। চতুর্থত, অপুষ্টি থেকে প্রায়ই তারা নানা রোগে ভোগে। পঞ্চমত, স্কুলে অসুস্থতার কারণে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে। ষষ্ঠত, ফলে অনেক পাঠ তার না শেখা থেকে যায়। সপ্তমত, শিক্ষিতের সন্তানদের পাশে দিনে দিনে সে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে, মা-বাবার এমন অর্থ নেই যা ‘কোচিং’-এ ব্যয় করা যাবে। অষ্টমত, পাহাড় সমান অনায়ত্ত পাঠ, যা কঠিন তো বটেইÑ তাকে স্কুলের শিক্ষার প্রতি নিরুৎসাহিত করে তোলে। যেহেতু সে ফেল নম্বর পায়, বার বার ফেলের স্কোর তাকে স্কুলবিমুখ করে এবং পরিশেষে সে স্কুল থেকে ঝরে যায়। তার বাবা-মা বুঝে নেয় ‘লেখাপড়া’ আমাদের জন্য নয়! এখানে ‘পাস’, ‘ফেল’- এর করুণ পরিণতি নিয়ে লেখা সেই গল্পটার উল্লেখ করি। একজন জাপানী খ্যাতনামা গল্পকারের গল্পটার নাম সাড়ে ৩২ অর্থাৎ সাড়ে বত্রিশ। গল্পের চরিত্র স্বামী-স্ত্রী দু’জনই শিক্ষক। বাড়িতে শিক্ষার্থীদের খাতা দেখছে দু’জনে। একসময় স্বামী উঠে স্ত্রীর কেটে রাখা উপরের খাতাটি দেখে বলল, ‘এ তুমি কি নম্বর দিলে? পাস নম্বর থেকে আধা নম্বর কেটে রেখে ছেলেটাকে ফেল করিয়ে দিলে? বরং আধা নম্বর দিয়ে পাস করিয়ে দেয়া ভাল হতো।’ স্ত্রী কঠোর। বলল, ‘না, ওর পাস করার যোগ্যতা নেই, পাস তো দয়া করে করানো যায় না।’ কিছুক্ষণ পর শিক্ষক স্বামী আবারও ঐ লাল কালির সাড়ে ৩২ নম্বরটি দেখে দুঃখিত হয়ে বলল, ‘এটা ঠিক করলে না, এর ফল খারাপই হবে।’ গল্পের বক্তব্য এই ধরনেরই ছিল। পরদিন, স্কুলে সব শিক্ষার্থী পরীক্ষার খাতায় ফল পেল। তারপর দিন, সাড়ে ৩২ পাওয়া ছেলেটিকে অনুপস্থিত দেখা গেল। তারও পরদিন, তারও পরের পরের দিন, সেই সাড়ে ৩২ পাওয়া ছাত্রটিকে আর কোনদিন শ্রেণীকক্ষে দেখা গেল না। সে চিরকালের জন্য স্কুল থেকে হারিয়ে গেল। এ গল্প নতুন ঘটনা নয়, আমাদের দেশে তো বটেই। এই সাড়ে ৩২রা কেনই বা কি উৎসাহব্যঞ্জক আচরণ শিক্ষকের কাছে আশা করে শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত হবে? আমি যাদেরকে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ‘মাথা ব্যথা’ বলে গণ্য করি, প্রধান লক্ষ্য বলে বহুবার তাদের উপযোগী ভাষা ও গণিত বিষয়ের শিক্ষায় দীর্ঘসময় দিয়ে তাদেরকে যথেষ্ট অনুশীলনের সুযোগ দেয়ার প্রয়োজনের কথা বলেছি, যদিও সেটি কখনও বাস্তবায়িত হয়নি। দেখছি, ইতালির ঐ দরিদ্র-নিরক্ষরের ছেলেগুলো সেই কথাই বলছে- শিক্ষকদেরকে জানাচ্ছে- কেন, কোন্ ত্রুটির জন্য তারা পড়াশোনায় ঐ স্মার্ট, অগ্রসর ছেলেদের মতো দ্রুত শিখতে পারছে না। তাছাড়া, ওদের দু’পক্ষের বাড়ির মা, বাবার মুখের ভাষা যা তারা শিখেছে, তাতো বইতে নেই। সেটিও ওদের বাধা দিচ্ছে। অথচ ঐ পক্ষ বাড়িতে, মা-বাবার মুখে যে ভাষা শিখছে সেটিই বইয়ের ভাষা। আচ্ছা, গণিতে মূর্খ আমি ইতালির দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মতোই প্রশ্ন করছি- জ্যামিতি জিনিসটা কি? এটি শিখে, যা কখনও আমি শিখতে পারব না, দিনে দশ ঘণ্টা শেখালেও পারব না, সেটির কোণ, ডিগ্রী, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, উপপাদ্য, সম্পাদ্য- এগুলো ম্যাট্রিক পাস করার জন্য কি দরকার হয়? এদেরকে নিয়ে আমরা যারা বিজ্ঞানের প-িত পদার্থবিদ- জ্যোতির্বিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখা দূরে থাক, জ্যামিতি, এ্যালজেব্রা বই দুটি হাতে নিতেও ভয় পাই, তাছাড়া, ম্যাট্রিক পাস করে আমি, হয় হাতের কাজ, মানে, দর্জি, কাঠমিস্ত্রি, যতরকম সারাই কাজ আছে, অটোমোবাইল থেকে ফ্রিজ, টিভি, ইলেকট্রিক-কলের কাজ শিখে জীবন চালাব। সে যদি মানবিক, সামাজিক বিষয়গুলো নিশ্চিন্তে পড়ার পড়বে ও পাস করে, তাহলে তাদের কি কাজে লাগবে ঐ হতচ্ছাড়া বিষয় দুটো? (পারলে আমার স্মৃতিকথা পড়–ন, জানবেন অঙ্কের ভয় কাকে বলে?) ‘অঙ্ক, জ্যামিতি এ্যালজেব্রা ছাড়া আরও কত কিছু পড়ার, করার আছে, বুঝবেন। অবশ্য, এতক্ষণ ড. জাফর ইকবালকে চরম হতাশ ও আমাকে মড়ড়ফ ভড়ৎ হড়ঃযরহম ভাবার সুযোগ করে দিলাম। হায়! আমি, আমার রান্না ও ঘরঝাড়–-কাপড় কাঁচার কাজের দুই বুয়ার সন্তানদের আমার সন্তানদের মতো সুশিক্ষিত করার প্রাণান্ত চেষ্টায় যখন ওদেরকে কমদামী, স্থানীয় স্কুলের অবশ্যই কম দক্ষ শিক্ষকের কোচিং দিয়ে মনে মনে সন্তুষ্ট থাকতে দেখি, তখন আমার বুক ভেঙ্গে যায় এজন্য যে, শুদ্ধ বাক্য বোঝা, লেখা, পড়া, আর গণিতের পঞ্চম শ্রেণীর বইয়ের সব অঙ্ক শুদ্ধ ও সহজ নিয়মে শেখাতে ঐ শিক্ষকেরা পারবে না বলে বুঝতে পারি এবং ওদের স্বপ্নটা কত বাস্তব থেকে দূরে থেকে যাবে! মা-বাবার পেশাটার ওপরে যদি ওরা না উঠতে পারে তাহলে এ শিক্ষা নিয়ে ওদের কোনই লাভ হবে না। এটা বুঝে আমার অন্তরের অশ্রুসিক্ত ব্যথার উপশম হয় কি করে? ইতালির ছেলেরা কি সুন্দর উপমা দিয়েছে। বলছে- হাসপাতাল তো অসুস্থ রোগীদের জন্য তৈরি হয়েছে। সেখানে যদি সুস্থ সবলরা যায়, তাহলে হাসপাতাল কি হাসপাতাল থাকে? স্কুলগুলো এর শিক্ষাক্রম, পাঠ্যবিষয়, মূল্যায়ন ব্যবস্থা, শিক্ষকদের নাক উঁচু, ¯েœহ-আদরহীন আচরণ, তাদের প্রশিক্ষণ- দেখা যাচ্ছে নিরক্ষরের সন্তানেরা যারা বাস্তব ক্ষেত্রের বহু দক্ষতা জানে, বহু সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান করতে পারে, তাদের জন্য স্কুল কতটা অপ্রাসঙ্গিক! বাস্তবিক ঐ আধঘণ্টায় বাংলাই হোক বা অঙ্কই হোক শিখে ওঠা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। শিক্ষিতের সন্তানরা তো শিক্ষিত মা-বাবা, উচ্চমানের গৃহশিক্ষক, কোচিং নেয় বলে ঐ শিক্ষা অর্জন করতে পারে। তাহলে নিরক্ষরের সন্তানরা এইসব স্কুল থেকে কোন্ শিক্ষা গ্রহণ করবে? কথা হচ্ছে- প্রাথমিক স্কুলগুলোর সিংহভাগ শিক্ষার্থী যখন দরিদ্র ও নিরক্ষরের সন্তান, যাদেরকে বর্ণ ও ‘কার’ চিহ্ন, ক্রিয়াপদের কঠিন ব্যবহার শিখিয়ে তবে তাদেরকে ভাষায় শক্তপোক্ত ভিত তৈরি করে দেওয়াই শিক্ষা পরিকল্পনায় থাকে তখন তারা সেসব শেখার জন্য যথেষ্ট সময় পায় না। অথচ ওরেদরকে শেখানোই প্রধান লক্ষ্য। এই ভাষাই কিন্তু গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞানসহ সব বিষয় শেখার প্রধান উপাদান। এর পাশে হিসাব করার সহজ, সাধারণ উপায়গুলো জানতে অঙ্ক শিখতে হবে। আমি ঠিক জানি না, আমরা যে শৈশবে ‘সরল’ নামের এক জটিল অঙ্ক করতাম, প্রায়ই ভুল করতাম, পরে এক গৃহশিক্ষকের কাছে প্রথম জেনেছিলাম যে, এ অঙ্কে তৃতীয় ব্র্যাকেট, দ্বিতীয় ব্র্যাকেট, সবশেষে প্রথম ব্র্যাকেটের যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগগুলো করতে হবে, তারপর ফল পাওয়া যাবে! সত্যিই, তাঁর সাহায্যে ‘সরল’ নামক জটিল অঙ্ক আমার কাছে হঠাৎ সরল হয়ে উঠেছিল! যা হোক, ব্যাপারটা এখন যত সহজে বললাম, অবশ্যই তত সহজ ছিল না। তবে, আমার কন্যাদের পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত সব বিষয় যখন শেখাচ্ছিলাম তখন দেখলাম, অঙ্ক বইয়ে অনুশীলনীর আগে যে নিয়ম দেওয়া আছে, সে সব অনুসরণ করে প্রায় সব অঙ্ক করা যায়। তবে, ক্লাস সিক্স থেকে যে অঙ্ক শেখানো একটি বিশাল কঠিন কাজ হবে, সেজন্য অন্য কোন শিক্ষকের সাহায্য দরকার হবে, সে বিষয়ে আমি অন্য উচ্চ শিক্ষিত (এমএ, বিএ) দের মতই সমান সতর্ক ছিলাম। তবে, ঐ সময়টায় আমার পড়তে বাইরে যাওয়া, এদিকে গৃহশিক্ষকের দীর্ঘ অনুপস্থিতি ওদেরকে অঙ্কে মারাত্মক দুর্বল করে রাখল, অথচ বাংলা, ইংরেজীতে উচ্চ নম্বর তারা অর্জন করত। অবশ্য, আমি যেমন মধ্যম মানের, ওরাও তেমন হয়েছে, এতে বিস্ময়ের কিই বা আছে! আমার এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলাম এ জন্য যে, আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় প্রথম প্রজন্মের ছেলেমেয়ে আরও বছরদশেক যাবত প্রবেশ করবে। এরাই আমাদের শিক্ষার গুণ-মান নির্ধারণ করবে। সুতরাং ওদের সুশিক্ষা হবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। স্কুলগুলোর এমন কিছু সমস্যা হবে না, যদি শ্রেণীর প্রথম প্রজন্মের শিশুদের বাংলা দু’ঘণ্টা, অঙ্ক-দু’ঘণ্টা পড়ানো হয়। ইংরেজী আমি পড়েছি চতুর্থ শ্রেণী থেকে। ওরাও তাই পড়তে পারে। ওরা যদি প্রথম দু’বছরে বাংলা ও অঙ্ক ভালভাবে শেখে তাহলে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, ওরা মাধ্যমিক পাস করবে। এসএসসি পাস করবে ভালভাবে। ইতালির কিশোররা শিক্ষকদের ওদেরকে বার বার ফেল করানোর অনুযোগ করেছে। সত্যিই তো, ঐ যে সাড়ে ৩২ না দিয়ে ৩৩ দিলে ঐ কিশোর কখনও স্কুল ছাড়ত না। ঐ আধা নম্বর শিক্ষকের জন্য এমন কোন সুবিধা আনত না! তাই না? সত্যি বারবিয়ানার ছেলেদের পত্রের বইটি সব শিক্ষা পরিকল্পকের, শিক্ষকের পড়া উচিত। লেখক : শিক্ষাবিদ
×