ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

দায় ও দায়িত্ব

ঝুলন্ত তারে জ্বলন্ত জঞ্জাল

প্রকাশিত: ১০:৩০, ৬ মার্চ ২০২০

 ঝুলন্ত তারে জ্বলন্ত জঞ্জাল

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীর ফকিরাপুলের গলিতে প্রবেশ করা মাত্রই স্বাগত জানাবে মাথার ওপর নুয়ে থাকা ঝুলন্ত তার। হায় রে তার। যেন তারের শহর। তারের গলি। তারের মেলা। ফুটপাথ ও রাস্তা ঘেঁষে বিদ্যুতের খুঁটি বা ল্যাম্পপোস্টে তার ঝুলতে দেখা যায়। তারের মেলা এত বেশি। তাই সেখানে বাসা বেঁধেছে কাক। তারের জঞ্জাল কাকের জন্য নিরাপদ আশ্রয় হলেও এই তার গোটা শহরের সৌন্দর্যকে ম্লান করেছে। তেমনি বাড়াচ্ছে নিরাপত্তা ঝুঁকিও। যদিও তার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সরকারী পর্যায়ে আছে নানা আলোচনা, সমালোচনা। বিহিত করারও প্রস্তুতি। কিন্তু এর বাস্তবায়ন দেখা মিলছে না। ফকিরাপুল, আরামবাগ, মতিঝিলসহ আশপাশের সব ঘিঞ্জি এলাকাতে এরকম চিত্র দেখা গেছে। মনে হয় গোটা নাগরিক জীবন ঘেরা তারে। বিশে^র উন্নত শহরগুলো যখন তারবিহীন কার্যক্রম পরিচালনায় যুগের পর যুগ অতিক্রম করছে, তখন আমাদের প্রস্তুতি পর্বই শেষ হচ্ছে না। ঢাকার বিভিন্ন অলিগলি থেকে শুরু করে মূল সড়কের চিত্র প্রায় একই রকমের। সব খানেই তার আর তার। যদিও ভিআইপি ও ভিভিআইপি সড়কগুলোতে এ রকম দৃশ্য আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। প্রশ্ন হলো, মাটির ওপর এত কিসের তার? এর জবাবইবা কি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনুমোদনহীন তারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। যে যার ইচ্ছেমতো বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনায় তার ঝুলিয়ে দিচ্ছেন। এ নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। একের পর এক তারে নগরীর সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। এ নিয়ে মাথা ঘামানোরও কেউ নেই। এটা কেমন কথা। এজন্য আছে নগর কর্তৃপক্ষ। আছে বিদ্যুত বিভাগ, পুলিশ, মোবাইল কোর্টসহ পরিবেশ অধিদফতর। কারো চোখেই কি এরকম অরাজকতা পড়ে না। হয়ত পড়ে। হাজারো সমস্যার ভিড়ে এই সমস্যা সমাধানের তালিকায় নিশ্চয়ই অনেক পরে। যে কারণে হাত দেয়া হয় না। সবুজবাগের বাসাবো, আহাম্মদবাগ, মায়াকানন, বৌ বাজার, ঠাকুরপাড়া, বালুরমাঠ, কদমতলাসহ আশপাশের এলাকায় দেখা গেছে বিদ্যুতের তারের পাশাপাশি হরেক রকম তার ঝুলছে। স্থানীয় ডিশ ব্যবসায়ীরা একের পর এক তারের জঞ্জাল সৃষ্টি করছেন ইচ্ছেমতো। রাস্তার লাইন থেকে বাসার ভেতর পর্যন্ত কোন রকম এন্টেনা ছাড়াই তার দিয়ে ডিশ সংযোগ দেয়া হচ্ছে। বহুতল ভবনগুলোতে এরকম সংযোগ নগরীকে অসুন্দর করে তুলছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সেবার মান নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে তেমনি রয়েছে ইচ্ছেমতো ডিশের মাসিক বিল আদায়। যখন তখন ডিশ বিল বাড়িয়ে দেয়া হয়। গ্রাম এলাকায় ডিশ বিল মাসে ২০০টাকা নেয়া হলেও এসব এলাকায় দিতে হয় ৪০০টাকা। এলাকাভেদে আরও বেশি। সেই সঙ্গে সাধারণ গ্রাহকদের সঙ্গে বিল উত্তোলনকারীদের অসৌজন্যমূলক আচরণ তো আছেই। এসব এলাকায় ডিশ লাইনের বাইরে অন্তত ২০ প্রতিষ্ঠান রয়েছে ইন্টারনেট বাণিজ্যে। তারাও ইচ্ছেমতো তার টানানোর কাজে নিয়োজিত। যেন নিজের শহর। নিজের ইচ্ছেতেই সবকিছু হয়, হচ্ছে। ঢাকায় মাথার ওপর খুঁটিতে ঝুলে থাকা বিদ্যুতের তার, ইন্টারনেট ও ডিশ ক্যাবলের তারের জঞ্জাল সরাতে সরকার দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এক দশক ধরে এজন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা ও উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়। যদিও কিছু এলাকায় এরই মধ্যে বিদ্যুতের তার মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তবে ক্যাবল টিভি ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সহযোগিতা না পাওয়ায় এসব সেবা সংস্থার তারের জঞ্জাল এখনও মাটির নিচে নেয়া সম্ভব হয়নি। অথচ তারের জঞ্জাল সরাতে উচ্চ আদালত ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নির্দেশ দিয়েছেন। চলতি বছর থেকে রাজধানীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তারের জঞ্জাল পাতালে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরুর কথা আছে। এর মধ্যে প্রথমবারের মতো দেশের সিলেটে মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুত সরবরাহ কার্যক্রম চালু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সিলেট নগরের টেলিফোন, ইন্টারনেট, ক্যাবল লাইনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সব তার ভূগর্ভে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়াও পর্যায়ক্রমে ঢাকা ছাড়া নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও কেরানীগঞ্জসহ দেশের অন্যান্য শহরে মাথার ওপর ঝুলে থাকা তার মাটির নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি আরও জানান, শীঘ্রই ক্যাবল অপারেটর ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠকে বসবেন এবং তাদের এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেয়া হবে। এর পরও যদি তারা কথা না শোনেন সেক্ষেত্রে সরকার ঝুলন্ত তার অপসারণের ক্ষেত্রে ছাড় দেবে না। জানা যায়, বিদ্যুত বিতরণকারী সংস্থা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) এরই মধ্যে ঢাকার ধানমন্ডি ও গুলশান এলাকার ঝুলন্ত তার মাটির নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে। রাজধানীর কোন্ কোন্ এলাকায় আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবলিং করা যায় তার জন্য প্রতিবেদন দিতে বিদ্যুত মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্টদের একটি প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয় গত বছরের অক্টোবরে। তার সরানোর জন্য বিদ্যুত মন্ত্রণালয়ের কাছে বিদ্যুত বিভাগ থেকে এরই মধ্যে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। জানা যায়, ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ মাটির নিচে এক হাজার ৫০০ কিমি বিদ্যুত বিতরণ লাইন নির্মাণ করার নক্সা তৈরি করেছে। বর্তমানে ডেসকো গুলশান, বনানী ও মিরপুরে বিদ্যুত সরবরাহ করছে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ৩৩৮ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক লাইন মাটির নিচে। আর ডিপিডিসির সরবরাহকৃত বিদ্যুতের মধ্যে উলন থেকে ধানমন্ডির পরীবাগ পর্যন্ত ১৩২/৩৩ কেভি একটি বৈদ্যুতিক লাইন মাটির নিচে। ডিপিডিসির পরিকল্পনা রয়েছে তারা ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরের বিদ্যুতের খুঁটি সরিয়ে মাটির নিচে ক্যাবল লাইন নিয়ে যাবে। আর ডেসকো কর্তৃপক্ষ ঢাকার অভিজাত এলাকা খুঁটি ও তারমুক্ত করার জন্য কাজ করছে। এ ছাড়া পূর্বাচলেও মাটির নিচে বিদ্যুতের লাইন নির্মাণের কাজ চলছে। উত্তরা ও বারিধারা অংশের জন্যও প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায়। আবার হাতিরঝিলেরও বিতরণ লাইন ভূগর্ভস্থ লাইনে রূপান্তর করার পরিকল্পনা রয়েছে। ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোঃ শহীদ সারওয়ার বলেন, বিদ্যুতের লাইন মাটির নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় ডেসকোর ১৩২ কেভি বৈদ্যুতিক লাইন এরই মধ্যে মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু ক্যাবল অপারেটর ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবেই বিদ্যুতের খুঁটি ব্যবহার করে তাদের তার ঝুলিয়ে রেখেছে। তারা এ ব্যাপারে আমাদের সহযোগিতা করছে না। আমরা বিভিন্ন সময় এই অবৈধ তার কেটে দিলেও তারা আবার লাইন লাগিয়ে দিচ্ছেন। ঢাকার বিদ্যুতের খুঁটি থেকে তারের জঞ্জাল সরাতে চীনের অর্থায়নে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ডিপিডিসি। ২০২৫ সালের মধ্যে রাজধানীর সব এলাকার বিদ্যুতের তার মাটির নিচে চলে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। তবে তারের জঞ্জাল থেকে ঢাকাকে মুক্ত করতে ২০০৯ সালে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শাহবাগ থেকে উত্তরা পর্যন্ত সড়কের পাশে বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে অন্য সব সেবার তার সরানোর কাজ শুরু হয়েছিল তখনই। কিন্তু সে সময় খুব সামান্য পরিমাণ তার অপসারণ করা হয়েছিল। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মাথার ওপর কোন ঝুলন্ত তার থাকবে না, ঝড়ে রাস্তায় পড়ে থাকা বৈদ্যুতিক তারের স্পৃর্শে কোন মানুষের মৃত্যু হবে না। দেশের জনগণকে এমন একটি পরিবেশ উপহার দিতে সরকারের পক্ষ থেকে এক দশক ধরে চেষ্টা চললেও তা এখনও খাতা-কলমেই রয়ে গেছে। তবে সৌভাগ্যের বিষয়, রাস্তাঘাটের সব তার মাটির নিচে নিয়ে ঝুঁকিমুক্ত শহর হওয়ার পথে প্রথম যাত্রা শুরু করল সিলেট। চলতি বছরের শুরুতে শহরের হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার এলাকার সড়কের ওপর থাকা বিদ্যুতের খুঁটি সরিয়ে মাটির নিচ দিয়ে সংযোগ চালু করা হয়। চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে গত নবেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে এক হাজার ২০০টিরও বেশি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে ২০ জনের প্রাণহানি হয়। সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। এসব অগ্নিকান্ডের বেশিরভাগই হয়েছে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে; যার জন্য অনেকাংশেই দায়ী বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ঝুলন্ত ক্যাবলের জঞ্জাল। ফায়ার সার্ভিস ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে একটি জরিপ চালায়। জরিপে নগরের ৪২টি এলাকাকে অগ্নিকান্ডের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। নগরবিদরা মনে করেন, রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সব বিভাগীয় শহরকেই দ্রুত তারের জঞ্জালমুক্ত করা জরুরী। তা না হলে অগ্নিকান্ডের আশঙ্কার পাশাপাশি মানুষের অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুঝুঁকি থেকেই যাবে। তাছাড়া পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ে তুলতে ঝুলন্ত তার অপসারণের বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তারা।
×