ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর আর্থ-সামাজিক চিন্তা-ভাবনা ও বাস্তবতা

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ৬ মার্চ ২০২০

 বঙ্গবন্ধুর আর্থ-সামাজিক চিন্তা-ভাবনা ও বাস্তবতা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব ও কীর্তিমান পুরুষ। আগামী ১৭ মার্চ শুরু হতে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। বঙ্গবন্ধুর জীবনকীর্তি মনে হয় আজ তাঁর দলের অনেক নেতা-নেত্রী তেমন জানে না। তাদের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি গ্রন্থ (যেটি এ বছর বেরিয়েছে সেটিসহ) অবশ্যই পাঠ্য হওয়া উচিত। আজকাল কারও কারও এমন ধারণা জন্মেছে যে, যার নেই কাজ সে নাকি বঙ্গবন্ধু বা জননেত্রী সম্পর্কে লেখালেখি করে থাকে। অথচ বাংলা প্রবাদ ‘অসির চেয়ে মসি’ অনেক শক্তিশালী। উঠতি তরুণ-তরুণীদের কেউ কেউ নানা ধরনের প্রলোভনে জড়িয়ে পড়েছে। এদের সম্পর্কে বারবার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বে¡ও তারা শুধরাচ্ছে না। বরং পুকুর, নালা দখল করে পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর করে ফেলছে। ভেঙ্গে দিলে আবারও দখল করছে। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির জনক মুজিব ছিলেন একজন চৌম্বকীয় নেতা। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের পাকিস্তানীদের কতৃত্ববাদী শাসন-শোষণ ও অন্যায় ঘটনাবলী এবং পাকিস্তানী প্রশাসনের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তান এ অঞ্চলকে উপনিবেশ হিসেবে গণ্য করেছিল এবং বাঙালীদের জিম্মি করে মুনাফা অর্জনকে সবচেয়ে বেশি লাভবান মনে করেছিল। মুজিবের দূরদর্শীসম্পন্ন নেতৃত্বগুণে বাঙালী আত্মমর্যাদা লাভে সক্ষম হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধু না হলে অর্জিত হতো না। তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বগুণে দেশ এগিয়ে চলেছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে তৃণমূল থেকে আরম্ভ করে মাঝারি পর্যায়ে কেউ কেউ যে নানা উছিলায় পরসম্পদ লুণ্ঠনে ব্যস্ত তা সমাজের অনেকের কাছেই ঠিক মানানসই মনে হচ্ছে না। আর দুর্নীতি দমন কমিশন এমন জরাগ্রস্ত যে, একজন কমিশনার ক্ষমতা দখলের আগে কি পরিমাণ ভূ-সম্পতি, অর্থসম্পদ তার আত্মীয়স্বজন এবং সাগরেদসহ দখল করেছে, তার হিসাব নিচ্ছে না। মানলাম সংসদ সদস্যদের ব্যাপারে দুদক সেলফ সেন্সরশিপ করে বসে আছে, অথচ জনমনে কি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সেটি হয়ত গোয়েন্দারা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে পারে। সেক্ষেত্রে ‘ঠগ বাঁচতে গাঁ উজাড়’ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দুর্বিনীত চুনোপুঁটিরা এমন কথাও বলে থাকে যে, পত্রিকায় লিখলে বরং আয়েশ করে আরও অর্থকড়ির মালিক হওয়া যায়। কিন্তু যে আদর্শে ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করেছি, শিক্ষক পিতা বলে গেছেন যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হতে- তা ধারণ করেই বেঁচে আছি। জ্ঞানের অন্বেষা করি বলে নিজের পৈত্রিক জিনিসও যখন লুণ্ঠন হওয়ার উপক্রম তখন কার কাছে বিচার চাইব। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদ অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজীর সঙ্গে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। ৭ মার্চ ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক ভাষণে মুজিব বাংলার জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন ঝুঁকি নিতে, পাকিস্তানীদের শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনমত গড়তে; দলমত নির্বিশেষে একাট্টা হয়ে মুক্তি সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ হতে; জাতীয় দুর্যোগে ভাগাভাগি করে সম্মিলিতভাবে এ দেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থ পাচার বন্ধ করতে; শান্তিপূর্ণ অথচ কঠোরভাবে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করে জনমত গড়ে তোলা এবং পাকিস্তানীরা যদি রক্ত চোষার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, তবে যেন প্রতিরোধ করা যায়। একই সঙ্গে সকল বাঙালীর জন্য শোষণমুক্ত পরিবেশের ঘোষণা ছিল। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের জেলে তখন মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে বাংলাদেশের সরকারের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। যখন তিনি ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ ফিরে আসেন, তখনও তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২-এর ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ থেকে মৃত্যুকালীন সময় পর্যন্ত মুজিব বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ছয় দফা ঘোষণা, যা বঙ্গবন্ধু লাহোরে ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে করেছিলেন, তা ছিল শান্তিপূর্ণভাবে বাঙালীদের আত্মমর্যাদা, স্বাধিকার এবং পৃথকভাবে দুটো রাষ্ট্রের পরিচালনার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু একজন পোড় খাওয়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। হঠাৎ করে তিনি ধূমকেতুর মতো উদয় হননি। বছরের পর বছর জেল খেটেছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করায়। তারপরও তাঁর ধ্যান-জ্ঞান ছিল বাঙালীর উন্নয়ন করা, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। কিছু কুলাঙ্গার আজকাল ব্যক্তিস্বার্থে হীন কাজ করে জনগণের চোখে কেবল ছোট করছে না, দলের ভাবমূর্তিও বিনষ্ট করছে। কেননা কোন ধোঁকাবাজের কারণে যদি কারোর সম্ভমহানি ঘটে, সম্পত্তি লুণ্ঠিত হয়- তাকে মানুষ বলে, পাকিস্তানী শোষকের বদলে বাঙালী শোষক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অথচ সরকার সুশৃঙ্খলভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। এদের দ্বারা যে পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেটি দুঃখজনক। জিয়াউর রহমান দেশজুড়ে অবাধ জুয়া, হাউজি খেলা, প্রায় অর্ধনগ্ন নৃত্য প্রদর্শন শুরু করেছিলেন। পরসম্পদ আত্মসাতের ব্যবস্থাও জিয়া করেছিলেন। অথচ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরেই বন্ধ করেছিলেন প্রকাশ্য মদ্যপান, ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। কেননা তিনি দেখেছিলেন ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে কত লোক সর্বস্বান্ত হয়েছে। আবার শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করেও অনেক লোকই সর্বস্বান্ত হয়েছে। এহেন হীন অবস্থা থেকে বাঙালীর উত্তরণের জন্য বঙ্গবন্ধু যে সমস্ত প্রয়াস নিয়েছিলেন, যেমন শিল্প উন্নয়নের জন্য দুটো ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্সিয়্যাল ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া প্রফেসর মোবাশ্বের আলী চট্টগ্রাম বেতারে সাক্ষাতকারে বলেছিলেন যে, মুজিব না থাকলে ভাষা আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সার্থকতা পেত না। বাঙালী স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হলে বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে পারত না। আসলে ছয় দফা দাবির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ‘অহিংস’ ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করেছিলেন এবং নিঃশর্তভাবে বাঙালীর আর্থিক অভাব-অনটন থেকে মুক্তির জন্য রক্তপাতহীন, শান্ত ও স্বায়ত্তশাসনের প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সাড়ে তিন বছর শাসনামলে তিনি শ্রেণীবদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তানী ও তার স্থানীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামস কেবল ত্রিশ লক্ষ মানুষ হত্যা এবং কয়েক লাখ নারী নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং দেশটিকে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যাতে পাকিস্তান কারাগার থেকে জীবিত অবস্থায় বের হতে না পারে ইয়াহিয়া এবং তার দোসররা সেদিন অবিরাম প্রয়াস গ্রহণ করেছিল। ট্রেন, সড়ক, নৌপথ, বিমানবন্দর ধ্বংসস্তূপ হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশে আবার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনতে নতুন করে সংবিধান রচনা করে মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। গত ২ মার্চ কুমিল্লার পৈত্রিক ভূমিতে গিয়ে অবাক হলাম। দেখলাম ভাষাসৈনিক ও প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক প্রফেসর মোবাশ্বের আলীর পৈত্রিক বসতভিটায় কোনরকম অনুমোদন ছাড়াই একটি টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছে। উদ্যোক্তা বলল, এটি কার জায়গা জানি না। স্থানীয় বাগিচাগাঁওয়ের কমিশনারকে ফোন করলে উল্টোপাল্টা বলল। এদের জন্যই দলের বদনাম হচ্ছে। অথচ ভূমি কর, পৌর কর সবই তো নিয়মিত শোধ করছি। আগামীতে হয়ত দেখব এ সমস্ত কমিশনার আবার দল বদল করেছে। কেননা, যার নামে ভাষাসৈনিক ও প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক প্রফেসর মোবাশ্বের আলীর জায়গায় টুর্নামেন্ট করেছে সে ইউসুফ জামাল বাবু ছিল বিএনপির ক্যাডার ও পরবর্তীতে ‘কাউয়া’ হয়ে আওয়ামী লীগে ঢুকেছিল। বাবুর বাবা সামাদ কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে পাকিস্তানী বাহিনীর দহরমমহরম ছিল। হায়রে দেশ! একজন/দু’জন ভূমিদস্যু যিনি সারা জীবন শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করেছেন, যার বাংলাদেশের সন্ধানে বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে তার বাস্তুভিটার ওপর লোভ পড়েছে স্থানীয় কমিশনারের। এরা কখনও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী হতে পারে না। নিয়ম আছে, একুশে পদকপ্রাপ্তরা মারা গেলে তাদের কবর স্থায়ী করার অনুমতি সিটি কর্পোরেশন দেবে। কিন্তু বিএনপি আমলে সাদেক হোসেন খোকা সেই অনুমতি দেয়নি। আমি ‘বঙ্গবন্ধু থেকে অবিসংবাদিত নেত্রী শেখ হাসিনা’ বইটি ২০১৭তে প্রকাশ করি। এ বছর ‘রাজনীতির উদ্যোক্তা : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান’ রচনা করেছি। আসলে আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, জননেত্রীর আদর্শে বিশ্বাসী তারা ‘কাউয়া’ শ্রেণী দ্বারা নিগৃহীত। নেত্রীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সে মাস্টার্স ইন এন্ট্রিপ্রিউনিয়রশিপ ইকোনমিক্স, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন এন্টারপ্রাইজ ডেভেলপমেন্ট, ব্যাচেলর অব এন্ট্রিপ্রিউডিউরিয়াল ইকোনমিক্স প্রোগ্রাম চালু করেছি। ব্যাংক-বীমা-এনজিও কিংবা যারা স্বশিক্ষায় উদ্যোক্তা হতে চান, তারা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন এন্টারপ্রাইজ ডেভেলপমেন্টে ভর্তি হতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরীক্ষায় পাস করে এ ডিগ্রী অর্জন করতে পারেন। ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ স্যার উদ্যোক্তা অর্থনীতি তৈরিতে উৎসাহ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে আসছেন। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি বর্তমান বাস্তবতায় উদ্যোক্তা শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রের অগণিত ঝামেলা সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে। আইনশৃঙ্খলার পুনর্প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযোদ্ধাদের এবং শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহতদের পুনর্বাসনে প্রয়াস নিয়েছিলেন। দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা ও ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন যোগানো এবং যারা অসহায় হয়ে পড়েছিল, দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছিল, তাদের বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করা। তিনি বিশ্বের সে সময়কার মিত্র দেশসমূহের কাছ থেকে অর্থসহ নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দেশ গড়তে চেয়েছিলেন। জাতিসংঘের সহায়তা ও ত্রাণসামগ্রীর সদ্ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর আদর্শ ছিল একজন বাঙালীও যেন অভুক্ত না থাকে। বঙ্গবন্ধুর যে ত্যাগ, তিনি পাকিস্তানী শাসনামলে ২৩ বছরের মধ্যে বারো বছর জেল খেটেছিলেন। তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার মূল উপাদান ছিল এ দেশের বাঙালীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। তিনি যে সংবিধান জাতিকে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর উপহার দিয়েছিলেন, সেখানে মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালীর উন্নয়ন কিভাবে সম্পন্ন করা যায়। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে পরিকল্পনা কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ১৯৭৩-৭৮ সালে ঘোষিত হয়। এ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য হ্রাস এবং মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির কথা বিবেচনায় আনা হয়েছিল। মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ৫.৫% হারে এবং মাথাপিছু আয় ২.৫% হারে বার্ষিক ভিত্তিতে বাড়ানোর কথা ছিল। তিনি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কুমিল্লা মডেলটি বাস্তবায়নের প্রয়াস রেখেছিলেন। এখনকার মতো তখনও সুযোগ সন্ধানীরা কুমিল্লা মডেলের টাকা-পয়সা আত্মসাত করে ফেলে। ফলে দেশের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর সদিচ্ছা স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বুদ্ধিজীবীদের একাংশ সময়ের বিবর্তনের নিজস্ব মডেল তৈরি করে নাম দিয়ে নোবেল পর্যন্ত পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন বলেই ১৯৭৫ সালের ২১ জুন রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯টি জেলাকে ভেঙ্গে ৬১টি জেলায় পরিণত করার ঘোষণা দেন। এই ৬১টি জেলায় তিনি গবর্নর নিয়োগ করেছিলেন। আসলে কিসে বাঙালীর হিত সাধন হবে সেটি ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল উদ্দেশ্য। বঙ্গবন্ধু বড় আশা নিয়ে বাকশাল, যা দ্বিতীয় বিপ্লবকে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছিলেন। বাকশাল তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছেÑ প্রশাসনিক, বিচার বিভাগীয় এবং আইন। বাঙালীর আর্থিক মুক্তি, সমাজে আইনশৃঙ্খলা পুনর্¯’াপন, তথাকথিত অতি বিপ্লবীদের বাড়াবাড়ি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছে দেয়াÑ সবই তিনি সাবলীলভাবে করেছেন। তিনি কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য। লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহারে বঙ্গবন্ধুর উগ্যোগ সাফল্যম-িত হচ্ছিল। কিন্তু যারা দুষ্কৃতকারী ও দুর্বিনীত তাদের দ্বারা দেশের ক্ষতি হচ্ছিল। নানা রকমের ডালপালা গুজবের রেশে দেশ ভরে গিয়েছিল। এরা যে ধরনের গোপন ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল তাতে মৌলবাদী শক্তি, যুদ্ধাপরাধী, তথাকথিত সুশীল সমাজের একাংশ, আমলা, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদদের একাংশ, এমনকি খোদ মন্ত্রিপরিষদের একাংশও যুক্ত হয়েছিল। মোশতাক একাই গডফাদার ছিল না। তার মতো অকৃতজ্ঞের সংখ্যা কম নয়। আবার তৃণমূল পর্যায়েও এখনকার মতো পরের সম্পত্তি আত্মসাতে লিপ্ত ছিল কিছু লোক। গোয়েন্দারা সে সময় সঠিক তথ্য বঙ্গবন্ধুকে জানালে দেশ ও জাতির মঙ্গল হতো। কিন্তু কুচক্রী মহল সীমাহীন অন্যায়-অপরাধ করে চলছিল। বঙ্গবন্ধুর নাম করে কেউ কেউ এবং কোন কোন প্রতিষ্ঠান সুবিধা নিতে চেষ্টা করেছে। তাঁর আমলে প্রণীত প্রথম বাজেটের মোট আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা (১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে) এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী ছিল ৫০১ কোটি টাকা। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আকার ছিল ৪ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে সঞ্চয় বিনিয়োগে ভারসাম্য আনয়নের প্রয়াস গ্রহণ করা হয়। গ্রামীণ অঞ্চলের জন্য সঞ্চয়ে সুদের হার বেশি ছিল এবং ঋণের সুদের হার কম ছিল। তিনি পেট্রোবাংলা প্রতিষ্ঠা করেন, যাতে ভূগর্ভস্থ গ্যাস-তেল ও খনিজসম্পদ সংগ্রহ করা যায়। তিনি পারমাণবিক শক্তি কমিশন, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিল, প্রগতি, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন কল্যাণকর প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। বিএডিসি এবং টিসিবির মতো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে কৃষি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ক্রয়- বিক্রয়ে তিনি যথেষ্ট সহায়তা করেন। অথচ জিয়াশাহী, এরশাদশাহী ও খালেদা এ দুটো প্রতিষ্ঠান শেষ করে দেয়। তিনি পাটকলের উন্নয়নে ভূমিকা রাখলেও কফিনে শেষ পেরেক দেয় খালেদা জিয়া ২০০২ সালে। খালেদার হঠকারী সিদ্ধান্তে আমাদের দেশের পাটকলে ধ্বংস নেমে আসে। এটি জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এখন সামনে এগুতে গিয়ে জননেত্রীকে কষ্ট করতে হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র গঠনের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সঙ্গে কার্যকর কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘে ৪১১ কোটি টাকা সরবরাহের প্রস্তাবনা ছিল এবং ভারত ২৫ কোটি মার্কিন ডলার (টঝউ) পুনর্বাসন সহায়তা ও ত্রাণ সাহায্য দিয়েছিল। তবে কেউ কেউ দলের ভেতরে এবং আমলাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বেচ্ছাচারী ও মিথ্যাচার করেছিল এবং গুজব রটিয়েছিল। সুবিধাপ্রাপ্ত অনেক নেতা-নেত্রী বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর মোশতাক ও জিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। আর কয়দিন পর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। এ উপলক্ষে দেশের মানুষের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস বইছে। এ সময় হঠাৎ করে পানির ও বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে জাতীয় বাজেট ঘোষণার সময় বাড়ানোর কথা বিবেচনা করা যেতে পারত। বঙ্গবন্ধুর নামে বেকারদের জন্য প্রত্যেক জেলায় ডিজিটালনির্ভর ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হোক। লেখক : ম্যাক্রোঁ ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট Pipulbd@gmil com
×