ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

মুজিববর্ষের সূচনালগ্নে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ৭ জানুয়ারি ২০২০

মুজিববর্ষের সূচনালগ্নে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা

২০১৯ সাল শেষ হয়ে গেল। ২০২০ সালকে শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানিয়ে বরণ করার উৎসব আর আয়োজনে মুখরিত সারাদেশ । ২০২০-এর তাৎপর্য এবং প্রাসঙ্গিকতা আরও একটি অনন্য বিষয়ের কারণে বহুল আলোচিত এবং বিভিন্ন কর্মপ্রকল্পে সাজানো। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম নেন জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই বছরটা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষেরও এক মাহেন্দ্রক্ষণ। সঙ্গত কারণে নতুন বছর শুরুর শুভলগ্নে মুজিববর্ষকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনায় বছরব্যাপী নানা আয়োজন আর অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হবে, যা মুজিববর্ষ উদযাপনের কর্মপ্রবাহকে আরও গতিশীল করবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনাই শুধু নয়, তার বহু কাক্সিক্ষত স্বপ্নের বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রাকেও নিবিড়ভাবে সন্নিবেশিত করা হবে। বছরজুড়ে চলবে সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির সঙ্গে টেকসই উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছার কর্মউৎসব। ১ জানুয়ারি উদ্বোধন করা হয় প্রতিবছরের মতো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা। বর্ণাঢ্য এ মেলার উদ্বোধক ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এই মেলা দিয়েই সূচনা করা হয় মুজিববর্ষের দ্বার উন্মোচন। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা মানে সারা বছরের পণ্য উৎপাদনের উৎসবই শুধু নয় দেশ-বিদেশে সরবরাহের অন্যতম সফল কর্মোদ্যোতনাও। রফতানি বাণিজ্যে পড়ে এর সম্ভাবনাময়, কাক্সিক্ষত প্রভাব, যা সামগ্রিক অর্থনীতির বলয়কে সমৃদ্ধ আর সুসংহত করে। উৎপাদনশীলতায়ও রাখে যুগান্তকারী অবদান, যা সরকার পরিকল্পিত টেকসই উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট পথপরিক্রমা। নতুন ও আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে মুজিববর্ষের উৎসব আর আয়োজন হবে প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ সূচকের সময়োপযোগী আনুষঙ্গিক কর্মসূচী পালনের দীপ্ত অঙ্গীকার। সেভাবে মুজিববর্ষ সরকার প্রদত্ত টেকসই উন্নয়নের বিভিন্ন খাতকে এগিয়ে নেয়ার এক অবিস্মরণীয় কর্মযোগের সফল সংযোজন। টেকসই উন্নয়নের বিভিন্ন ধাপকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ২০৩০ সালের মধ্যে তা বাস্তবায়নের যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, সেখানে গণমাধ্যম শুধু সংশ্লিষ্ট সূচকেই নয় সাধারণ মানুষের মধ্যে আকাক্সিক্ষত সচেতনতা তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যা হবে নতুন বছরের নিয়ামক কর্মশক্তি এবং সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশনা। টেকসই উন্নয়ন প্রত্যয়টি ইউএনডিপি সর্বসাধারণের মধ্যে সম্প্রসারিত করতে তার বিভিন্ন কার্যপ্রবাহকে প্রতিনিয়তই গতিশীল করছে যা উন্নয়নকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। ইউএনডিপির মাধ্যমে প্রকল্প এলেও তা মূলত জীবনমান উন্নয়ন করবে দেশের অতিসাধারণ জনগোষ্ঠী থেকে সব মানুষের। এতে একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও চাহিদা সংবলিত নিয়ামক বিষয়ের গুরুত্বই সমধিক। মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো অধিকারগুলো দেশ ও জনস্বার্থে যথার্থভাবে বাস্তব কর্মসূচীর মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া। সংবাদমাধ্যম মূলত সাধারণ মানুষের কথা বলে। তাদের প্রতিদিনের প্রাপ্ত অধিকার নিয়ে সুসংবদ্ধ প্রতিবেদন তৈরি করে। জনগণের নিত্য সমস্যাকে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হয়। শুধু তাই নয় উত্তরণের পথনির্দেশনা দিয়ে সমাধানের সম্ভাবনাকেও সংশ্লিষ্টদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে দেরি করে না। দেশের সামগ্রিক জনতা আর সংবাদমাধ্যম এক ও অবিচ্ছিন্ন সুতায় গাঁথা। সেই মহৎ ও বৃহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ এবং ইউএনডিপি এক সমন্বিত প্রকল্পে গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য টেকসই উন্নয়ন সহায়ক একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা বের করার উদ্যোগ নেয়। ইতোমধ্যে তারা এই ছোট বইটির একটি খসড়াও গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে উপস্থাপন করে। যাতে সংবাদ পাঠের মাধ্যমে জনগণ শুধু প্রতিদিনের খবরই জানবে না, তার চেয়েও বেশি তাদের অধিকার, সমৃদ্ধি অর্জনের পথে এগিয়ে যাওয়ার ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। শুধু পাঠকই নয়, সংবাদমাধ্যম কর্মীকেও সচেতন দায়বদ্ধতায় টেকসই উন্নয়ন সহায়ক প্রতিবেদন প্রস্তুত করে সর্বসাধারণে সাড়া জাগাতে নির্ণায়কের ভূমিকা রাখবে। এখানে ১৭টি সূচককে উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান ধারায় নির্ধারক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধা মুক্তি, সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ, গুণগত শিক্ষা, জেন্ডার সমতা, নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন, সাশ্রয়ী ও দূষণমুক্ত জ্বালানি, শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্প উদ্ভাবন ও অবকাঠামো, অসমতা হ্রাস, টেকসই নগর ও সমাজ, জলবায়ু কার্যক্রম, শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান আর এসবের মধ্যে প্রতিটি মানুষের সচেতন অংশদারিত্ব। লক্ষ্য করলে বুঝতে অসুবিধা হবে না, সূচকগুলো কোন সার্বভৌম দেশের নাগরিকের মৌলিক অধিকার, প্রতিদিনের চাহিদা, সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন গঠনে আবশ্যিক কর্মযোগ, নারী-পুরুষ, অর্থবিত্ত আর বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে যথার্থ সমন্বয় সাধন, নিরাপত্তা বলয়ের আনুষ্ঠানিক নিশ্চয়তা, ন্যায়নিষ্ঠার সফল প্রয়োগে প্রয়োজন যা প্রত্যেক মানুষকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ নিরাপত্তা বলয় দিতে নিয়তই কাজ করে যাবে। তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল স্বাধীন ভূখ- অতি সহজেই উন্নত জীবন আর নিরাপত্তা বলয়কে অর্জন করতে পারে না। একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থেকে শুরু করে তা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সর্ববিধ কর্মসূচীকে আমলে নিতে হয়। তেমন একটি রূপরেখা ইউএনডিপিও তাদের খসড়া প্রস্তাবনায় নির্ধারণ করেছে। সেখানে দেখানো হয় চ্যালেঞ্জিং এই লক্ষ্যমাত্রাকে এগিয়ে নিতে গেলে সতর্ক এবং যথার্থ কর্মসূচীকে সাংবাদিকদের সর্বক্ষণিক নজরদারিতে নিয়ে আসা এক ধরনের দায়বদ্ধতা। ক্ষুদ্র এই দেশটি অধিক জনসংখ্যার ভারে এখনও অনেক মৌলিক সমস্যাকে অতিক্রম করতে হিমশিম খাচ্ছে। তার পরও এগিয়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট পথযাত্রাকে আয়ত্তে আনতে প্রতিনিয়তই কর্মপ্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে ইউএনডিপি নির্ধারিত সূচকে সামনে চলার গতিপ্রবাহকে বিবেচনায় রেখেছে। বাংলাদেশের কোন একটি বিশেষ অঞ্চল সারাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে না। অঞ্চলগত পার্থক্যের কারণে প্রতিদিনের জীবনযাত্রাও হয় ভিন্ন। অর্জন, অধিকার এবং চাহিদার ক্ষেত্রেও আসে বৈচিত্র্য। ফলে দারিদ্র্য বিমোচনে ২০১৯ সালে যে প্রতিবেদন আসে সেখানে রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী এবং দিনাজপুর এখনও দারিদ্র্যসীমাকে সেভাবে অতিক্রম করতে পারেনি। কিছু জায়গায় এর অধোগতিও দৃশ্যমান হয়েছে। বরিশালের মতো জায়গায় নিম্নবিত্তের সংখ্যা কমেছে। আবার ঢাকা, চট্টগ্রাম আর সিলেট উঠে এসেছে অনেকটা অপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায়। এমন ক্ষেত্রে ইউএনডিপি অঞ্চলগত সরাসরি জরিপের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের সূচকগুলোকে নির্ধারণ করার পরামর্শ দেয়। এমন দায়িত্ব বর্তায় মফস্বল সংবাদদাতাদের ওপর। সুতরাং তথ্য-উপাত্তের সুষ্ঠু সমন্বয়ে প্রতিবেদন হবে গবেষণামূলক, যা নির্দিষ্ট অঞ্চলের অধিবাসীদের যথার্থভাবে সচেতন ও দায়বদ্ধ হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। উন্নয়নের প্রয়োজনীয় সূচকগুলো গবেষণার আওতায় আনতে গেলে অর্থায়ন যেমন একটি আবশ্যিক পর্যায়, একইভাবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় দায়-দায়িত্বকে আমলে নিতে হবে। কাজগুলো সহজ নয়, সময় সাপেক্ষ এবং অংশীদারিত্বেও থাকবে বাধাবিপত্তি। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়নের কোন সূচকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আমলে নিতে হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক যা উন্নয়নের আরও খাতকে সরাসরি প্রভাবিত করে। বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে টেকসই উন্নয়নকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে সময়োপযোগী অনেক কর্মপ্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে খাদ্য, আশ্রয়, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাত বেশি গুরুত্ব দিয়ে সেখানে উন্নয়নের ধারাকে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। আমার শহর-আমার গ্রাম- এমন বার্তায় নগর আর প্রত্যন্ত অঞ্চলের ফারাক কমাতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়াও অঞ্চলভিত্তিক অর্থনৈতিক জোন তৈরির মহাপরিকল্পনাকে এগিয়ে নিতে সম্প্রসারিত কর্মপ্রবাহও দৃশ্যমান হচ্ছে, যা প্রতিদিনের সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনেও সফলভাবে উঠে আসছে। পাশাপাশি নানামাত্রিক বিপন্ন আর বিপর্যয়ের চিত্রও সংবাদমাধ্যমের পরিবেশকে ভারাক্রান্ত করছে। উন্নয়নের অবধারিত গতিধারায় বিপরীত অপশক্তিও তার অশুভ পাঁয়তারা নিয়ে সক্রিয় থাকতে সচেষ্ট হয়। তেমন সর্বনাশা বিপর্যয়ও গণমাধ্যমকে সচকিত করে যথার্থ সংবাদ পরিবেশনে মনোসংযোগ করিয়ে নেয়, যা দেশ ও জনগণের কল্যাণকে বিবেচনায় রেখে ক্রান্তিকাল অতিক্রমের পথও বাতলে দেয়। এক্ষেত্রে সমাজের বিজ্ঞজন, বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকদের দায়িত্বও থাকে অপরিসীম। যারা সুষ্ঠু পথনির্দেশনায় সামাজিক অধোগতিকে রোধ করার পরামর্শ দিতে পারেন, সেখানেও গণমাধ্যমের ভূমিকা নজরকাড়া। গণমাধ্যম কোন নির্দিষ্ট জায়গায় ঘটে যাওয়া ঘটনাকে সারাদেশে প্রচার করতে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তার তুলনা নেই। তবে যথার্থ সংবাদ পরিবেশনই মূল উদ্দেশ্য হতে হবে সাংবাদিকদের। প্রিন্ট অথবা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, যাই হোক না কেন। প্রিন্ট মিডিয়ার অংশত সুযোগ থাকে সংবাদ এদিকওদিক করার, যা যান্ত্রিক গণমাধ্যমে করা মুশকিল। কারণ টেলিভিশন কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি ঘটনা দেখানোর যে সুবিধা থাকে তাতে ভুলভ্রান্তি হওয়া কঠিন। তার ওপর নির্দিষ্ট গণমাধ্যম কর্মীর আদর্শিক চেতনা, দেশপ্রেম, ন্যায়-অন্যায় বোধ এবং কর্তব্যনিষ্ঠতাও বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। এমনসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে ইউএনডিপি যে ক্ষুদ্র পুস্তিকা প্রকাশ করতে যাচ্ছে সেখানে সুষ্ঠু ও গঠনমূলক সংবাদ পরিবেশনের সূক্ষ্ম কাঠামো নির্দেশিত হয়েছে, যা নিরীক্ষামূলক সংবাদ পরিবেশনকে উৎসাহিত করে সত্য এবং তথ্যভিত্তিক ঘটনা বিশ্লেষণকে অর্থবহ ও সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। আর এরই মধ্য দিয়ে আমরা ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রায় টেকসই উন্নয়নকে ক্রমান্বয়ে অর্জন করতে সক্ষম হব। আগামী দশ বছর দেশকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে বহুমাত্রিক কর্মযোগে নিরন্তর এগিয়ে যাওয়াই যথার্থ পথ। লেখক : সাংবাদিক
×