ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাঠ্যপুস্তক উৎসব

প্রকাশিত: ০৭:৫৫, ৩ জানুয়ারি ২০২০

পাঠ্যপুস্তক উৎসব

নতুন বছরের প্রথম দিনেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কয়েক কোটি কচিকাঁচা শিশু শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে ঝকঝকে-তকতকে নতুন পাঠ্যবই তুলে দেয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে বর্তমান জনবান্ধব সরকারের অন্যতম একটি অর্জন, যা প্রশংসিত হয়েছে ইউনেস্কো, জাতিসংঘ কর্তৃক। বিশ্বের অন্য কোন দেশে অন্য কোথাও এ রকম একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। শিক্ষা জীবনের শুরুতেই একজন শিশু শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই প্রাপ্তির বিষয়টি প্রায় একটি স্বপ্নের মতো। আশৈশব লালিত যে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে সে প্রবেশের অবারিত সুযোগ পেয়ে থাকে শিক্ষা জীবনে অনুপ্রবেশের। কয়েক কোটি শিশুর এই অনাবিল আনন্দ মা-বাবাসহ সমগ্র দেশবাসীকে আভিভূত ও আনন্দিত করে তোলে নিশ্চয়ই। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রতিবারের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোবন করেন মঙ্গলবার শিশুদের হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে। সরকার ২০২০ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চার কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৪ কপি বই ছেপেছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১০ কোটি ৫৪ লাখ দুই হাজার ৩৭৫ কপি এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৪ কোটি ৭৭ লাখ ৪২ হাজার ১৭৯ কপি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয় বিনামূল্যে। এর বাইরেও কিছু বই ছাপা হয়ে থাকে প্রাক-প্রাথমিক স্তরের জন্য। এতে সরকারের ব্যয় হয়েছে এক হাজার ১১ কোটি টাকার বেশি। নিঃসন্দেহে বিশাল অঙ্কের সুবিশাল একটি কর্মকান্ড। প্রায় চার শ’ প্রতিষ্ঠান এসব বই মুদ্রণ ও সরবরাহের কাজে জড়িত। এটি বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি ধারাবাহিক সাফল্য, যা বাস্তবায়িত হচ্ছে ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে। তবে যা দুঃখজনক তা হলো, প্রায় প্রতি বছরই পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, সরবরাহ ও বিতরণ নিয়ে নানা অভিযোগ ওঠে, যার অনেকাংশই অসত্য নয়। উদাহরণস্বরূপ কাগজের কথা বলা যায়। এত বিপুলসংখ্যক বইয়ের কাগজ কিনে দেয় এনসিটিবি, ৩৪০টি লটের বই মুদ্রণের কাগজ। তবে এক শ্রেণীর অসাধু মুদ্রাকর তথা ছাপাখানার মালিক সরকারের ভাল মানের কাগজ খোলাবাজারে বেশি দামে বিক্রি করে নিম্নমানের কাগজ কিনে বই ছাপে। ফলে স্বভাবতই ছবিসহ মুদ্রণ সৌকর্যের বিনাশ ঘটে। এর পাশাপাশি নিম্নমানের ছাপা, বানান বিভ্রাট, অস্পষ্ট ছবি, দুর্বল বাঁধাই এমনকি ফর্মার হেরফের তো আছেই। এনসিটিবির পরিদর্শক টিম সরেজমিন পরিদর্শন করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে লিখিত ও মৌখিকভাবে সতর্ক করে দিলেও শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত ফল কি হয়, তা অনিশ্চিত। প্রশ্ন হলো, প্রতিবছরই তা হবে কেন? দেশে প্রতিবছর পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মুদ্রণ ও সরবরাহ নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়ে থাকে, তার ভয়াবহ ও আশঙ্কাজনক চিত্র মেলে টিআইবির প্রতিবেদনে। উল্লেখ্য, এই কাজটির দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি। প্রতিষ্ঠানটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়টি সুবিদিত। ইতোপূর্বে মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কট্টর মতাদর্শ ও পরামর্শে পাঠ্যপুস্তকের মর্জিমাফিক পরিবর্তনসহ ভুল মুদ্রণের অভিযোগও উঠেছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে। ব্যাপক আর্থিক অনিয়মসহ দুর্নীতির অভিযোগ তো আছেই। রয়েছে বিপুল আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে সহায়ক পাঠ্যপুস্তক ও গাইড বইয়ের রমরমা ব্যবসা-বাণিজ্য। গোটা বিষয়টি পড়ে গেছে সিন্ডিকেটের খপ্পরে এবং এর নেতৃত্বে রয়েছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবশালীরা। সত্যি বলতে কি এনসিটিবির এই বিষয়টি এক রকম ওপেনসিক্রেট, যা নিয়ে প্রতি বছরই বিস্তর লেখালেখি হলেও প্রায় কোন প্রতিকারই মেলে না। সে অবস্থায় সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট, সতর্ক ও উদ্যোগী হতে হবে এনসিটিবিকে।
×