ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সৃষ্টি করেছে কর্মসংস্থান শিল্পায়ন

৫ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকায় সমৃদ্ধ দেশের অর্থনীতি

প্রকাশিত: ১১:০৩, ১ জানুয়ারি ২০২০

৫ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকায় সমৃদ্ধ দেশের অর্থনীতি

কাওসার রহমান ॥ বিদায়ী ২০১৯ সাল ৫ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক আয় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক আয় থেকে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে দেশের মানুষের শুধু আয়ই বাড়েনি, সৃষ্টি করেছে কর্মসংস্থান ও শিল্পায়ন। দেশের মেগা প্রকল্পসহ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রেখেছে। যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে সাহায়তা করবে। বাংলাদেশের এই বৈদেশিক আয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে রফতানি খাত। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখেছে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স। এছাড়া বৈদেশিক সাহায্য এবং সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রেমিটেন্স, রফতানি আয়, বিদেশী সাহায্য ও বিদেশী বিনিয়োগ সবমিলিয়ে ২০১৯ সালে মোট বৈদেশিক আয় হয়েছে ৬ হাজার ৭৭৪ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। নানা ঘটনা ও আনন্দ বেদনার সাক্ষী হয়ে গতকাল মঙ্গবার বিদায় নিয়েছে ইংরেজী ক্যালেন্ডার বর্ষ ২০১৯ সাল। কিন্তু বিদায়ের আগে গত এক বছর ধরে এই বছরটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্মকা-েড প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে গেছে। যদিও বছরের শুরুতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি স্বস্তিভাব বজায় থাকলেও বছরের শেষ দিকে এসে বিশ্ববাণিজ্যের শ্লথ গতির কারণে স্বস্তিভাব বজায় থাকেনি। চীন-যুক্তরাষ্ট্র শুল্কযুদ্ধ শুরুতে আমাদের রফতানি আয়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেললেও, শেষ দিকে এসে সেই প্রভাব ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ ভারতের অর্থনৈতিক মন্দাও আমাদের অর্থনীতিকে আঘাত করেছে। তবে চীন মার্কিন শুল্কযুদ্ধ সমাপ্তির ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পাশাপাশি নতুন বছরে বাংলাদেশের রফতানি আয়েও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে। এসব ঘটনার মধ্যেও ২০১৯ সাল প্রবাসী আয়ে আমাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখিয়েছে। গত বছর রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স বৃদ্ধির ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯ সালে এক লাফে প্রায় ২০০ কোটি ডলার প্রবাসী আয়ের বৃদ্ধি ঘটেছে। যদিও এই আয় বৃদ্ধিতে সরকারের দেয়া প্রণোদনা ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। বছর শেষে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচক এক হাজার ৮০০ কোটি (১৮ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। রেমিটেন্সে রেকর্ড সৃষ্টি হলেও রফতানি আয়ই বরাবরের মতো ২০১৯ সালেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-কে সচল রেখেছে। সবমিলিয়ে এ বছর ৩ হাজার ৮৯৭ কোটি ডলারের রফতানি আয় দেশে এসেছে। এর মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে তৈরি পোশাক খাত। যদিও বছরের শেষ দিকে এসে তৈরি পোশাক খাত চাপের মুখে পড়েছে। কমে যাচ্ছে রফতানি অর্ডার। তা সত্ত্বেও মোট রফতানি আয়ের ৮৩ শতাংশই আসছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ফলে শেষ পর্যন্ত চলমান ২০১৯-২০ অর্থবছরের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় কিনা তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। তা সত্ত্বেও রফতানি আয়ই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-কে প্রাণবন্ত করে রেখেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) হিসাবে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-নবেম্বর সময়ে এক হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। গড় হিসাবে ৬ মাসে এই রফতানির পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ৮৯৪ কোটি ডলার। আর জানুয়ারি-জুন সময়ে দেশে রফতানি আয় এসেছে ২ হাজার তিন ডলার। সবমিলিয়ে ২০১৯ সালে পুরো বছরে কম করে হলেও ৩ হাজার ৮৯৭ কোটি ডলার রফতানি আয় হয়েছে বলে ধরা যায়। যদিও চলতি বছরের জুলাই-নবেম্বর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রফতানি আয় কমেছে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। তবে চীন যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ অবসানের ইতিবাচক প্রভাব নতুন বছরে দেশের রফতানি আয়ে পড়তে পারে। এতে রফতানি আয় অর্থবছর শেষে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৫৩৫ কোটি ৮২ লাখ (৪০.৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করে। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছিল ৪ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পণ্য রফতানির মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি (৪৫.৫০ বিলিয়ন) ডলার। রফতানি আয়ের পরই বাংলাদেশের আর্থিক বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে বৈদেশিক সাহায্য। দাতাদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়ের বড় লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অর্থবছর শুরু হলেও প্রথম চার মাসে ছাড়ের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। জুলাই-অক্টোবর সময়ে বিদেশী ঋণ সহায়তার ১৪৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার ছাড় হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৪৫ কোটি ২৪ লাখ ডলার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালানাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থবছরের চার মাসে বিদেশী সাহায্য এসেছে ১৪৩ কোটি ডলার। গড় হিসাবে ছয় মাসে যা দাঁড়ায় ২১৪ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল প্রায় ৩১০ কোটি ডলারেরও বেশি। ফলে বিদয়ী ২০১৯ সালে মোট বিদেশী সাহায্য এসেছে প্রায় ৫২৪ কোটি ডলার। এ বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি শাখার সচিব আবুল মন্সুর মোঃ ফয়জুল্লাহ বলেছেন, বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দাতাদের কিছু শর্ত মেনে বাস্তায়ন করতে হয়। তাই শর্তের জালে অনেক সময় অর্থছাড় কিছু দিনের জন্য আটকে যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কাজ হয়ে গেছে কিন্তু অর্থছাড় হয়নি। তবে সময়ের সঙ্গে দাতাদের অর্থছাড়ও বেড়ে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বৈদিশক সহায়তার মোট অর্থ ছাড় হয়েছিল ৬২১ কোটি ৭ লাখ ডলার। তার সঙ্গে ২২৬ কোটি ৬২ লাখ ডলার বাড়িয়ে চলতি অর্থবছরের জন্য ৮৪৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ইআরডি। এডিপি বাস্তবায়নের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণের মধ্যে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৭ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের মাত্র ১০ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৮ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা বা প্রায় ১৪ শতাংশ। রফতানি আয় ও বৈদেশিক সাহায্য কমে গেলেও সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে ২০১৯ সালে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ১৫৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। এই বছরের একই সময়ে এসেছে ১৬৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। এ হিসাবে এফডিআই বেড়েছে ৫.৩৬ শতাংশ। আর সবমিলিয়ে ২০১৯ সালে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে প্রায় ৪৯৪ কোটি ডলার। যা দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নতুন বছরের এই প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। শিল্পায়নে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়লেও পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) প্রবাহের গতি গতবারের মতোই হতাশাজনক। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে মাত্র ৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে। গড় হিসাবে পুরো বছরে পুজি বাজারে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে প্রায় ৯ কোটি ডলার। বিদেশী বিনিয়োগ ও বিদেশী পোর্টফোলিও বিনিয়োগ নিয়ে ২০১৯ সালে সর্বমোট বিনিয়োগ এসেছে প্রায় ৫০৩ কোটি ডলার। মূলত ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় আশঙ্কায় বিদেশী পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারীরা দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ উৎসাহিত হচ্ছে না। তবে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমানোর কোন ‘সম্ভবনা নেই’। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, সবাই চেয়েছিল যে আমাদের কারেন্সি ডিভ্যালুয়েশন করা হোক। তাদের যুক্তি ছিলে কারেন্সি ডিভ্যালুয়েশন হলে রফতানি বাণিজ্য থেকে শুরু করে রেমিটেন্স অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু আমরা বলেছি, অন্য যেসব দেশ কারেন্সি ডিভ্যালুয়েশন করেছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে চাই না।’ উল্লেখ্য, গত নবেম্ব^রের শেষে মুদ্রাবাজার হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে ওঠে। আন্তঃব্যাংক লেনদেনেই (ব্যাংকগুলোর নিজেদের মধ্যে কেনাবেচা) ডলারের দর উঠে যায় ৮৫ টাকায়।
×