ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মতিলাল দেব রায়

জাতীয় সম্মেলনে জাতীয় প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ০৮:৫০, ২০ ডিসেম্বর ২০১৯

 জাতীয় সম্মেলনে জাতীয় প্রত্যাশা

২০-২১ ডিসেম্বর ২০১৯ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যার জন্য বাংলাদেশের জনসাধারণ এবার একটু বেশি উৎসাহী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে, তার অনেক কারণ বিদ্যমান। অন্যবারের চেয়ে আওয়ামী লীগের এবারের জাতীয় সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, তার ওপর নির্ভর করবে আগামী দিনের রাজনীতি। দেশের উন্নয়নের/অগ্রগতির রাজনীতি, উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আদর্শ ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা। তাই সম্মেলন হচ্ছে আওয়ামী লীগের সকল শ্রেণীর কর্মীর জন্য একটি অগ্নি পরীক্ষা। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী নেতাদের আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য, মূল নীতি, অঙ্গীকার ইত্যাদি গঠনতন্ত্রে উল্লিখিত বিষয়গুলো একটু ভাল করে পড়ে এলে সকলের অবস্থান কোথায়, তা নিজেরাই মূল্যায়ন করতে পারবেন। একটি বৃহত্তর দলে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিটি উপজেলায় অসংখ্য কর্মী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি আওয়ামী লীগের আদর্শ বাস্তবায়নে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে গ্রামে-গঞ্জে তালগাছের মতো দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কোন লোভলালসা কোন ভয়ভীতি তাদের এই আদর্শ থেকে টলাতে পারেনি। তাদের নৈতিক প্রভাবের কারণে জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকে। যার প্রমাণ আমরা সকল জাতীয় নির্বাচনের সময় নিজ চোখে দেখেছি। স্বাধীনতার পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, রাজনীতির বিভিন্ন সমীকরণ দেশের গ্রামীণ মানুষ দেখতে দেখতে একেকজন প্রায় রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। তাঁরা বুঝতে পারেন কোন দল এবং কাকে ভোট দিতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে ইতোমধ্যে অনেক নেতৃতের বিকাশ ঘটেছে। একটি উপজেলায় আওয়ামী লীগ সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন অনেক নিবেদিত প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির নেতার সৃষ্টি হয়েছে, যা খুবই আশাব্যঞ্জক। এদের নেতৃত্বকে কোন অবস্থায় খাটো করে দেখার মতো নয়। তবে উপজেলাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিকেন্দ্রিকরণ প্রয়োজন। জাতীয় সম্মেলনে উপজেলা আওায়ামী লীগের কমিটির কাঠামো পরিবর্তন করে এখন থেকে নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সভাপতি একজনের পরিবর্তে ৩ জন, সহ-সভাপতি ৬ জন, সম্পাদক ৪ জন, যুগ্ম সম্পাদক ৫ জন করে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করলে তাদের মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশ হবে এবং দলীয় কার্যক্রমে নিজেকে আরও সম্পৃক্ত করবে। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে যদি একজন ব্যক্তিকেই সংসদ সদস্য হিসেবে দল কর্তৃক মনোনয়ন দেয়া হয় তাহলে একই সংসদীয় এলাকায় দেশের সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন বহু কর্মী দীর্ঘ সময় ধরে নিরলস সততার সঙ্গে দলীয় আদর্শের চর্চা এবং জনমত ধরে রাখার দায়িত্ব পালন করে দলের পতাকা ও আদর্শ ধারণ করে থাকেন, তাহলে তাদের আর বাকি জীবনে নেতৃত্বে আসার সম্ভাবনা কোথায়? তাই অনেক সংসদীয় আসনে দলীয় মনোনীত সংসদের প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নিজেরা প্রার্থী হয়েছেন। তাদের যদিও বলা হয়ে থাকে তারা বিদ্রোহী প্রার্থী, কিন্তু বাস্তবে তারা বিদ্রোহী প্রার্থী নন। তারাও আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত কর্মী। তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে বিধায় তারা নিজে থেকেই প্রার্থী হয়ে গেছেন। তাদের দলে কোণঠাসা করে রাখা ঠিক হবে না। তাদের অংশগ্রহণসহ সকলের মধ্যে নেতৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ খুবই প্রয়োজন। বিষয়টি নীতি নির্ধারণকারীদের ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করছি। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে উল্লেখ আছে আওয়ামী লীগের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে- একটি গণমুখী, স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক দক্ষ জনপ্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং সুশাসন নিশ্চিত করা। তৃণমূল পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার সকল স্তরে জনগণের অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলা। ইতোমধ্যে দেশব্যাপী শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে- শুধু আওয়ামী লীগ, যুব লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্র লীগের মধ্যেই শুদ্ধি অভিযান সীমাবদ্ধ রয়েছে, নিজের ঘর শুদ্ধ করে অন্যের ঘর শুদ্ধ করাও প্রয়োজন। তার কারণ অন্যান্য রাজনৈতিক দলেও অনেক কালো টাকার মালিক আছেন। অনেক আর্থিক দুর্নীতিবাজ আছেন, যাদের সম্পর্কে দেশবাসী বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জানতে পারে। সুতরাং তাদেরও একইসঙ্গে শুদ্ধি অভিযানে অন্তর্ভুক্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া দরকার। না হলে সামাজিক ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একটি গণমুখী স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক দক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তোলা এবং সুশাসন নিশ্চিত করাই হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাই অঙ্গীকার অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে নির্দোষ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয়। দলের শুদ্ধি অভিযানে এবং প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান সমান্তরাল চলবে। কারণ দলে শুদ্ধি অভিযান না করলে প্রশাসনও শুদ্ধ হবে না। তাছাড়া যাদের ওপর দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া এবং দেশী-বিদেশী অর্থে চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব, সেই দায়িত্ব স্বচ্ছতার সঙ্গে পালনের জন্যও শুদ্ধি অভিযান প্রয়োজন। এই সকল প্রকল্পের অধিকাংশ ডোনার এজেন্সি বিদেশী সংস্থা। তাই এসবের সঠিক বাস্তবায়নে কোন সমস্যা হলে পরবর্তী প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা পেতে জটিলতা সৃষ্টি হবে। দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জি কে শামিমের মালিকানাধীন ফার্মকে ৫৬টি প্রকল্পের কাজ দেয়া হয়েছে। দুর্নীতি ধরা পড়ায় জি কে শামিম গ্রেফতার হয়েছেন। তাই তার ফার্ম কাজ করতে পারছে না। তাতে এই প্রকল্পগুলোর কাজ আপাতত বন্ধ রয়েছে। কোটি কোটি টাকার প্রকল্পে টেন্ডার পাওয়া ফার্ম বা তৃতীয়পক্ষের কোন সমস্যার কারণে যদি কাজের ধারাবাহিকতা বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে এই কাজ অন্য কোন পার্টিকে করার দায়িত্ব দেয়ার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা প্রকল্পের চুক্তিতে উল্লেখ থাকার কথা ছিল। যদি না থাকে পরবর্তীতে যেন রাখা হয়, সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান স্বাভাবিক গতিতে অব্যাহত থাকুক এবং সঙ্গে সঙ্গে কিছু সংস্কার কার্যক্রমও চালু করা উচিত, যা ঘটনাপ্রবাহে আলোচনায় সামনে এসেছে। যেমন, প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ, প্রকল্প মনিটরিং, বাস্তবায়ন, প্রকল্প প্রণয়ন, প্রকল্পের শুরু থেকে অভীষ্ট জনসাধারণকে জড়িতকরণ, প্রকল্প অনুমোদনের পূর্বে পুননিরীক্ষা ও মূল্যায়ন করা- ইত্যাদি বিষয়গুলোতে যে অস্পষ্টতা রয়েছে, তা খুঁজে বের করে এবং প্রকল্পে অনিয়ম ও আর্থিক অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান আবারও এই জাতীয় সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেতাদের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে, যা দেশবাসী গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। ঢাকা কেন্দ্রিক যে সকল নেতা বিগত দিনে তাদের সঠিক দায়িত্ব পালনে সফল হতে পারেননি, এবং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাদের দলের ক্লিন ইমেজ ধরে রাখার স্বার্থে অব্যাহতি দিতে হবে। সঠিক সিদ্ধান্ত, যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে এমন সদস্য, শুল্কমুক্ত গাড়ি কিনে যারা বিক্রি করেছেন এমন সংসদ সদস্য, যাদের নৈতিকতা নিয়ে কথা উঠেছে, যারা মাদকাসক্ত তাদের থেকে দলকে মুক্ত করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের জন্য মুজিববর্ষ চলবে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত তাই এই সময় কোনরকম অস্থিরতা সৃষ্টি হয় এমন কোন কাজ করা যাবে নাÑ সেদিকে তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা বিনষ্ট হয়, এমন কোন কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ রাখাই হবে সমীচীন। জনগণের মধ্যে প্রাণ চাঞ্চল্য ধরে রাখার জন্য একটি বাড়ি একটি খামার, একটি পরিবারে একটি সদস্যের চাকরি, বয়স্ক ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বিধবা ভাতা, বয়স্কদের পেনশন ইত্যাদি সেবাসমূহের সঠিক এবং সময়মতো বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এতে কোন মধ্যস্বত্বভোগী কেউ প্রবেশ করছে কিনা, তা খুঁজে বের করতে হবে। কোনরকম অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে, তা কঠোরহস্তে দমন করতে হবে। বয়স্কদের বয়সের ধুয়া তুলে নেতৃত্ব থেকে দূরে রাখা হবে একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত। কারণ বয়স্কদের অস্বীকার করা মানে নিজেদেরকেই অস্বীকার করার সমান। বয়স্কদের অভিজ্ঞতার ভা-ার নুতনদের সঠিক পথ দেখাতে পারবে। তাদের নীতি নির্ধারণী কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি করলে তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো যাবে। মনে রাখবেন আজকের যুবক আগামীতে বয়স্ক হবেন-এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তাই বয়স্ক হলেই একজন নিষ্ক্রিয় হয়ে যান না, তার সৃজনশীলতা বরং বেড়ে যায়। দেশের বাইরে অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ অনেক দেশেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ বিভিন্ন স্টেটেও কমিটি রয়েছে। তাদের কোন প্রতিনিধি দেশের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা, তাও বিবেচনায় আনা দরকার। কারণ ঢাকা থেকে বিদেশের কমিটিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাছাড়া বিদেশে সংগঠিত কমিটির কার্যক্রম এবং বিদেশে তাদের সংগঠনের কার্যক্রমের পরিধি কতটুকু সীমাবদ্ধ ইত্যাদি বিষয়গুলো গঠনতন্ত্রে যোগ করা যায় কিনা, তাও চিন্তায় রাখতে হবে। তাদেরও গঠনতন্ত্রের আওয়তায় আনা দরকার। পরিশেষে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ বয়স, ইত্যাদি নির্বিশেষে একটি বৈষম্যহীন গ্রহণযোগ্য আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটি উপহার দিয়ে জাতির ইতিহাসে স্থান করে নেয়ার জন্য বর্তমান নেতাদের কাছে বিনীত আবেদন রাখছি। লেখক : নিউইয়র্ক নিবাসী
×