ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাট ও পাটকল

প্রকাশিত: ০৯:১৩, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯

পাট ও পাটকল

মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ১১ দফা দাবি আদায়ে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর শ্রমিকদের ধর্মঘট, অবরোধ এমনকি আমরণ অনশনের কর্মসূচী প্রশমনের লক্ষণ তেমন দেখা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে একাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর খবরও আছে, যা অনাকাক্সিক্ষত। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী খুলনা-৩ অঞ্চলের সংসদ সদস্যের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত আপাতত অনশন কর্মসূচী স্থগিত করা হয়েছে। ইত্যবসরে শ্রমিকদের মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ বকেয়া পরিশোধের লক্ষ্যে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের একাধিক বৈঠকের কথা রয়েছে। এর ফলের ওপর নির্ভর করছে পরবর্তী কর্মসূচী। তবে এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাটকল শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া-বকেয়া মিটিয়ে দেয়াসহ বিদ্যমান যাবতীয় সমস্যার সমাধানে আন্তরিক ও সচেষ্ট। রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারী ২২টি পাটকল কেন অব্যাহত লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না তার কারণ অনুসন্ধান জরুরী ও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পাটের সুদিন আবার ফিরে এসেছে। এমনকি দেশেও বেসরকারী পাটকলগুলো ভাল করছে। পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে রফতানি আয়ও বাড়ছে। অথচ সরকারী পাটকলগুলো ক্রমাগত লোকসান দিচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাটকলগুলোর লোকসান হয়েছে ৪৬৬ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লোকসানের পরিমাণ ৩৯৫ কোটি টাকা। ফলে স্বভাবতই পাটকল শ্রমিকদের বেতন বকেয়া পড়েছে কয়েক সপ্তাহের। অন্যদিকে কর্মচারীরা বেতন পান না কয়েক মাস ধরে। বাংলাদেশ পাটকল শ্রমিক লীগের ১১ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে বকেয়া মজুরি, মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন, বরখাস্ত শ্রমিকদের পুনর্বাসন, পাট মৌসুমে পাট কেনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ, উৎপাদন বাড়ানোসহ মিলগুলোর সংস্কার ও আধুনিকায়ন। পাটকল শ্রমিক নেতৃবৃন্দের মতে, সরকারী পাটকলের লোকসানের অন্যতম কারণ কাঁচাপাট কেনায় চরম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। মিল কর্তৃপক্ষ পাট কেনে দেরিতে এবং বেশি দামে। এছাড়াও সরকারী পাটকলের উৎপাদন ক্ষমতা কম, উৎপাদনে খরচ বেশি, যন্ত্রপাতি পুরনো ও মজুরি বেশি। তদুপরি চট ও চটের বস্তা ছাড়া আর কিছু তৈরি করতে পারে না সরকারী পাটকলগুলো। জগদ্দল পুরনো অবকাঠামোর এই আমলাতান্ত্রিক বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে সরকারী পাটকলগুলোর ভবিষ্যত নেই বললেই চলে। পাটকলের লোকসান কমাতে অভ্যন্তরীণ খাদ্য ও আনুষঙ্গিক দ্রব্য পরিবহনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পাটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই বস্তাও সরকারী পাটকলগুলো সরবরাহ করতে পারে না। এক্ষেত্রে তারা বেসরকারী পাটকলগুলোকে অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বাস্তবে স্বর্ণযুগ ফিরে এসেছে সোনালি আঁশ পাটের। বর্তমানে পাট থেকে তৈরি হচ্ছে ২৩৫ রকমের আকর্ষণীয় ও মূল্যবান পণ্য। সবচেয়ে বড় কথা, পাট থেকে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব পচনশীল পলিথিন। বর্তমানে যে প্লাস্টিক পলিথিন দেশে ও বিদেশে যথেচ্ছ ব্যবহৃত হচ্ছে তা প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য সমূহ ক্ষতিকর। সে অবস্থায় বিকল্প হিসেবে পাটের পলিথিন ব্যবহারের অত্যুজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বিশ্বব্যাপী। বিশ্ববাজারে পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে ৫০০ বিলিয়ন পিসের। এর ১০ শতাংশ বাজার দখল করতে পারলে বছরে আয় করা সম্ভব ৫০ হাজার কোটি টাকা। পাট খাতের বৈশ্বিক রফতানি আয়ের ৭২ শতাংশ এখন বাংলাদেশের দখলে। সে অবস্থায় সরকারী পাটকলে লোকসান হবে কেন? ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষণা দিয়েছে যে, চলতি বছরের মধ্যে সদস্যভুক্ত সব দেশ পণ্যের মোড়কসহ বহনের জন্য সব ব্যাগে প্লাস্টিক ও কৃত্রিম আঁশজাত উপজাত দ্রব্যের ব্যবহার বন্ধ করবে। বাংলাদেশ জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা পাটের জন্মরহস্যের (জেনোম) তথ্য দিয়ে উদ্ভাবন করেছেন নতুন জাতের পাটবীজ, যা থেকে প্রায় তুলার সুতার মতো স্বচ্ছ আঁশ উৎপাদন করা সম্ভব হবে অচিরেই। এই সুতা দিয়ে উন্নতমানের জামদানিসদৃশ কাপড় উৎপাদন করা সম্ভব। পাটের এই অমিত সম্ভাবনাকে বহুমুখী ও সর্বতোভাবে কাজে লাগাতে হবে সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী দলসহ মাঠপর্যায়ে কৃষকদের। আর তা হলেই কেবল ফিরে আসতে পারে একদা বাংলা থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া পাটের স্বর্ণালী গৌরব। তদুপরি পাটকল শ্রমিকদের সুদিন।
×