ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

পেঁয়াজ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে

প্রকাশিত: ১০:১৪, ১ নভেম্বর ২০১৯

 পেঁয়াজ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে

এম শাহজাহান ॥ দেশের প্রধান মসলাজাতীয় পণ্য পেঁয়াজ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। বর্তমানে ১৫ জেলায় পেঁয়াজের বাণিজ্যিক চাষ হয়ে থাকে। এছাড়া বাকি ৪৯ জেলায় পেঁয়াজের উৎপাদন নেই বললেই চলে। এসব জেলায় যাতে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানো যায় সে লক্ষ্যে সহজশর্তে কৃষি ঋণ চালু, বিনামূল্যে পেঁয়াজের বীজ সরবরাহ এবং কৃষিভর্তুকি বাড়ানো হবে। একই সঙ্গে পেঁয়াজের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে বেশকিছু পদ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। মসলাজাতীয় পণ্যটির বাজার স্থিতিশীল রাখতে ৭টি সুপারিশ দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদফতর। পেঁয়াজ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানে কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণায় যৌথভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করবে। জানা গেছে, বছরে ২৪ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে, বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ১৯ লাখ টন। অর্থাৎ ৫ লাখ টনের এই ঘাটতি পূরণ হচ্ছে আমদানিকৃত পেঁয়াজ দিয়ে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকেই ৯৫ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি হয়ে থাকে। কিন্তু এবার ভারত নিজ প্রয়োজনে রফতানি বন্ধ করে দিলে দেশে লাগামহীন হয়ে পড়ে পেঁয়াজের দাম। দফায় দফায় দাম বেড়ে খুচরা বাজারে এই পেঁয়াজ এখন ১৩০-১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির কারসাজির পেছনে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অস্থির হয়ে পড়ছে বাজার। এ অবস্থায় সঙ্কট দূরীকরণে মিসর ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। পাশাপাশি ভারতের রফতানি বন্ধের আদেশ প্রত্যাহারে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। একই সঙ্গে পেঁয়াজে উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলছে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী। শীঘ্রই পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে এই দুই মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে একটি রোডম্যাপ করা হবে। এছাড়া কৃষি বিপণন অধিদফর থেকে পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক রাখতে ৭টি সুপারিশ তুলে ধরেছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ঘাটতি থাকায় উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে, বছরের যে সময় পেঁয়াজের চাহিদা বৃদ্ধি পায় সে সময়কে চিহ্নিত করে পূর্ব থেকে প্রয়োজনীয় আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণ করা, ব্যবসায়ীরা যাতে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে মূল্যবৃদ্ধি করতে না পারে সে ব্যাপারে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার, এ্যান্টি হোল্ডিং এ্যাক্ট প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মজুদদারি ব্যবস্থা কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ এবং সাপ্লাই চেন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখতে হবে। কৃষি বিপণন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১৪ লাখ ২৩ হাজার মে.টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। গত আট বছরের ব্যবধানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২ লাখ ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে ২১ লাখ ৫৩ হাজার মে.টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। অর্থাৎ উৎপাদন বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। কিন্তু উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে পেঁয়াজের চাহিদাও বেড়েছে। ফলে ঘাটতি থাকছে। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে ভোক্তাকে। কৃষি বিপণন অধিদফতর বলছে, সাপ্লাই চেন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে ও আমদানি অব্যাহত থাকলে পেঁয়াজের মূল্য স্বাভাবিক অবস্থায় থাকবে। তবে আমদানির মাধ্যমে দেশের ঘাটতি পূরণ করা হলে বাজার পরিস্থিতি কখনও স্থিতিশীল থাকবে না। তাই বাজারমূল্য ও সরবরাহ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। সংস্থাটির পাশাপাশি বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে চাহিদাও বাড়ছে। তবে উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব হলে অদূর ভবিষ্যতে পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধি করে চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা সম্ভব বলে মনে করে কৃষি বিপণন অধিদফতর। জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই পেঁয়াজ চাষ হয়। তবে প্রধান প্রধান পেঁয়াজ উৎপাদনকৃত জেলা হলো-পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, কৃষ্টিয়া, রাজশাহী, ঝিনাইদহ, মাগুরা, মেহেরপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, গোপালগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, দিনাজপুর ও রংপুরে অধিক পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। স্থানীয় জাতের মধ্যে তাহেরপুরী, ফরিদপুরের ভাতি, ঝিটকা, কৈলাসনগর উল্লেখযোগ্য। আগাম রবি মৌসুমে এসব জাতের ফলন দ্বিগুণ হয় এবং কন্দের মানও উন্নত হয়। উদ্ভাবিত ও উল্লেখিত পেঁয়াজের জাত দুটি উত্তরবঙ্গ, কুষ্টিয়া, যশোর ও ফরিদপুর অঞ্চলে ব্যবসায়িকভাবে চাষ করার জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে। পেঁয়াজসহ ৯টি ফসল উৎপাদনে বিশেষ প্রণোদনা ॥ পেঁয়াজসহ ৯টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। তিনি সম্প্রতি সচিবালয়ে এই প্রণোদনা দেয়ার কথা জানান। ওই সময় কৃষিমন্ত্রী বলেন, পেঁয়াজসহ ৯টি পণ্য উৎপাদন বাড়াতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মধ্যে চলতি অর্থবছরে পরিবার প্রতি সর্বোচ্চ একবিঘা জমির জন্য বিনামূল্যে বীজ, রাসায়নিক সার ও পরিবহন খরচ দেয়া হবে। বাকি পণ্যগুলো হচ্ছে, গম ভুট্টা, সরিষা, মুগ তিল। এসব পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে প্রায় ৮১ কোটি টাকার বীজ, সার ও নগদ অর্থ প্রদান করা হবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কৃষিপণ্য বিশেষ করে মসলাজাতীয় পণ্য পেঁয়াজ, আদা ও রসুন উৎপাদনে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে সকল কৃষি ও বাণিজ্যিক ব্যাংককে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে এসব পণ্যের আমদানি শুল্ক শূন্য শতাংশ করা হয়েছে। এদিকে, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী বলেছেন, ভারত হঠাৎ করে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে আমাদের বিপদে ফেলেছে। তাই এ সমস্যা নিরসনে পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের ভাগ্য ভাল, মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের ল্যান্ড কানেকশন রয়েছে। তাই আমরা মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করছি। টেকনাফে ল্যান্ড করতে পেঁয়াজের আমদানি খরচ প্রতিকেজি পড়েছে ৭৫ টাকা। তাই পেঁয়াজের দাম কমছে না। এ সমস্যা সমাধান করতে হলে পেঁয়াজের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, পেঁয়াজের দাম না কমার জন্য কিছু অসাধু ব্যবসায়ীও দায়ী। সরকারের ১০টি মনিটরিং টিম কাজ করছে। কিন্তু মনিটরিং করে পেঁয়াজের দাম শতভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। কারণ এত জনবল নেই। তিনি জানান, মিসর থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। এতদূর থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে ব্যবসায়ীদের মাইন্ড সেটআপ করতেও একটু সময় লেগেছে। তাই ধীরে ধীরে পেঁয়াজের বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে। তবে এ সমস্যা সমাধান করতে হলে পেঁয়াজ উৎপাদনে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে।
×