ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

‘রক্ত দিয়ে রেখে গেলাম’ ॥ ৬ অক্টোবর, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ৬ অক্টোবর ২০১৯

 ‘রক্ত দিয়ে রেখে গেলাম’ ॥ ৬ অক্টোবর, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ৬ অক্টোবর দিনটি ছিল বুধবার। মুক্তিবাহিনী রাজশাহী জেলার সীমান্ত গ্রাম ঘোষপুরে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড গোলাবিনিময় হয়। এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর বহু সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিসেনারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য হস্তগত করে। রাতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে গেট প্রহরারত ৩ জন রাজাকার নিহত ও ২ জন আহত হয়। ৮নং সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনী পীরগাছায় পাকসেনাদের একটি দলকে এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে ২ জন পাকসৈন্য নিহত ও ২ জন রাজাকার আহত হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল গাড়িতে মাল বোঝাইরত পাকসেনাদের ওপর গ্রেনেডের সাহায্যে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর ৩ জন সৈন্য নিহত হয়। কুমিল্লা রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা গোপীনাথপুর, চান্দিনা, শালদানদী ও নয়নপুরে পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। রাত তিনটায় পাকসেনাদের একটি দল দুর্লভপুরের কাছে মুক্তিফৌজের এ্যামবুশে পরে যায়। এই এ্যামবুশে একজন ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের অফিসারসহ ১২ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা গোমতীর উত্তরে আবার তাদের আধিপত্য পুনরুদ্ধারের জন্য তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। পাকসেনাদের এই তৎপরতাকে বাধা দেবার জন্য ক্যাপ্টেন দিদারুল আলম দুটি প্লাটুন পানছড়ায় এবং মোহনপুরে পাঠান। এই প্লাটুনগুলো পাকসেনাদের চলাচলের রাস্তায় এ্যামবুশে পেতে অপেক্ষা করতে থাকে। মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি পাকিস্তানকে সকল প্রকার সাহায্য দান সম্পর্কিত প্রস্তাব অনুমোদন করেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোজার্স পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলীকে সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে উল্লেখ করেন। তিনি হানাদারদের হাত থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারীদের আবারও হানাদারদের হাতে ছেড়ে দেবার সুপারিশ করেন। চীনা কনসাল জেনারেল সিয়াও চিউজই বলেন, চীনের সরকার এবং জনগণ বৈদেশিক হামলা এবং অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্য দেশের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সব সময়ই পাকিস্তানকে সমর্থন জানাবে। জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল শিক্ষামন্ত্রী আব্বাস আলী খানের সঙ্গে দেখা করেন। মন্ত্রী জমিয়ত নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ও দেশ পুনর্গঠনের আহ্বান জানান। স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারিত মহাদেব সাহা রচিত ‘রক্ত দিয়ে রেখে গেলাম’ কথিকায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বছরের অর্ধভাগ পেরিয়ে গেল। গত ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছয়মাস পূর্ণ হয়েছে। একটি জাতির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে ছয়মাস সময় তেমন কিছুই নয়। কিন্তু আমাদের কাছে এই ছয়মাস সময়ের ব্যাখ্যা অনেক বেশি, অনেক ভিন্নভাবে মূল্যবান। কেননা যে সামরিক একনায়কের ধারণা ছিল মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সব ঠা-া হয়ে যাবে, সেখানে ছয়মাস প্রতিনিয়ত সংগ্রামমুখর একটি জাতির গৌরবোজ্জ্বল অস্তিত্ব আমাকে নিঃসন্দেহে সগর্বিত জবাব দেবার অধিকার দেয়, আমি গর্ববোধ করি। আমরা গর্ববোধ করি, আমরা যুদ্ধ করেছি। আমরা গর্ববোধ করি আমাদের বাঁচার সংগ্রামে। কারণ... আমরা সবাই যুদ্ধ করে বেঁচে আছি কিংবা বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করছি। আমাদের ভবিষ্যত অস্তিত্বকে নিশ্চিত ও নিরাপদ করার জন্য যুদ্ধ করছি-এ আমার অহংকার ও এ আমার সম্মান। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের অস্তিত্বকে আমরা নিরাপদ না করে পারি না, আমরা সে জন্য যুদ্ধ করছি। ২৮ মার্চ ঢাকা থেকে বেরিয়ে চলেছি গ্রামের দিকে। ঢাকা থেকে দীর্ঘপথ। যানবাহন নেই। কখনও হেঁটে, কখনও নৌকায়, এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে চলেছি। আমার একজন সহযাত্রী বন্ধু নিজের হ্যান্ডব্যাগের মধ্যে পুরে অতি সন্তর্পণে একটি রেডিও সেট নিয়ে এসেছিলেন। ফরিদপুরের দিকে পদ্মায় আমরা নৌকা নিয়ে চলেছি। রেডিও সেটটি হাতে নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে হঠাৎ শুনলাম, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া বলছি। সহসা বুকের মধ্যে লাল রক্ত যেনো ফিনকি দিয়ে উঠল। স্থানকাল ভুলে আমরা কজন সহযাত্রী আনন্দে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলাম, চিৎকার করে উঠলাম আমরা বেঁচে আছি, আমরা বাঁচবো। হয়তো পদ্মার বক্ষ থেকে আমাদের সেদিনের সেই উল্লাসধ্বনি ক্ষণিকেই বাতাসে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু রক্তের মধ্যে সেদিন যে প্রবল উত্তাপ অনুভব করেছিলাম তা আজো মুছে যায়নি। জানি না, যুদ্ধের জন্য কখনও এমন হয় কিনা। এতদিন নিজের মানসিকতা সম্পর্কে যতটুকু সচেতন হয়েছি, তাতেও জানি যে নিরাপদ নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের স্বপক্ষেই আমাদের মানসিক প্রস্তুতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেদিন যুদ্ধের সংবাদে, আমাদের প্রতিরোধ সংগ্রামের ঘোষণায় পবিত্র আনন্দে ফেটে পড়েছিলাম। দীর্ঘ শীতরাত্রির নিরুত্তাপ নিঃশব্দ অন্ধকারের পর এই যেন প্রথম আমাদের রক্তের মধ্যে দারুণ উত্তাপ বোধ করেছিলাম। যুদ্ধ কোন মানুষকে এমন জীবিত করে তোলে এর আগে কখনও এমন ভাবতে পারিনি। পঁচিশে মার্চের সেই ভয়ঙ্কর দুঃসহ অন্ধকার ২৬, ২৭ ও আটাশের দিবালোকেও ছিল এরও বেশি স্পষ্ট, সমাচ্ছন্ন। আর বহু হাতড়িয়েও সে অন্ধকার থেকে আলোর সন্ধান পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল, নিজের সবকিছু নিয়ে সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা ও এলোমেলো ভাষারাজি নিয়ে ক্রমাগত যেন কোথায় তলিয়ে যাচ্ছি; কোথায় তা জানিনে, তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম যে, ভয়ানক অস্বাভাবিক অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। দীর্ঘ পাঁচদিন পর এই আমাদের প্রথম ভোর হলো। জানি না ইতিহাসে কারও জীবনে কখনও দীর্ঘ পাঁচ শেষ হয়েছিল পুরো পাঁচদিন পরে। পুরো পাঁচদিন পর এই প্রথম বুঝলাম, ভোর হচ্ছে, আলো আসছে। অথচ আমরা তখন কোন বন্দী শিবিরে ছিলাম না, ছিলাম না দেয়াল ঘেরা কারান্তরালে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যখন প্রথম শুনলাম আমরা যুদ্ধ করছি, বিশ্বাস করুন, আমার সব অনুভূতি দিয়ে তখনই কেবল অনুভব করলাম যে, দীর্ঘ পাঁচদিন পর ভোর হলো। তখন কেবল বোধ করলাম যে আমি বেঁচে আছি। নিজের পায়ে হাত দিলাম, রক্তের উত্তাপ নিলাম। দেখলাম আমি মরিনি। আমি তাই জানি না আর কোন মানুষের যুদ্ধের সংবাদ এমন শিহরণ এনেছে কি-না। কিন্তু আমি জানি, আমরা সেদিন অস্ত্র হাতে পথে না নামলে আমরা মরে যেতাম, এই মুক্তিযুদ্ধ গড়ে তুলে মাথা উচু করে না দাঁড়াতে পারলে আমরা মরে যেতাম। অথবা বেঁচে থাকতাম কিন্তু সে দুই-ই মৃত্যু। কারণ আমরা জানি, এ আমাদের বেঁচে থাকার যুদ্ধ, আমাদের অস্তিত্বের যুদ্ধ। আমাদের তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেন হানাদার দস্যুদের অধিকৃত অঞ্চলে ঢুকে তাদের ওপর মরণ আঘাত হেনে। তারা যুদ্ধ করেন, এক-একটি অঞ্চল মুক্ত করেন হানাদার দস্যুদের পাপপঙ্কিল অধিকার থেকে। সেখানে উড়িয়ে দেন বাংলাদেশের ভালবাসার বিজয় পতাকা। সেখানে খুলে দিয়ে আসেন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের আগামী সুখ-স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ জীবনের সোনালি স্বপ্ন, ওরা তাই যুদ্ধ করে; যুদ্ধ করে বাঁচে, যুদ্ধ করে মরে, মরেও বেঁচে থাকে। আমরা বেঁচেও মরে ছিলাম, তাই আমরা যুদ্ধ করছি- আমরা মরেও বেঁচে থাকব। তাই আমরা রক্ত দিচ্ছি, আমরা রক্ত দিয়ে রেখে গেলাম আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের দুর্জয় স্বপ্নের ফুল। ফ্রন্টে আমাদের মুক্তিসেনারা অবিরাম যুদ্ধ করছে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য; ঘরে আমাদের জায়া-জননী, ভগ্নিরা যুদ্ধ করছে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য, শরণার্থী শিবিরে লাখ লাখ নির্যাতিত মানুষ প্রতিনিয়ত জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে বেঁচে থাকার জন্য, আমাদের অস্তিত্বের জন্য। হানাদার আক্রমণকারীর অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী, তার যুদ্ধ সাময়িক কিন্তু আমরা যারা বাঁচার জন্য যুদ্ধ করছি- এ যুদ্ধের শেষ নেই। আনন্দ বাজার পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, গত ১ অক্টোবর সন্ধ্যার দিকে খুলনা সেক্টরের সাতক্ষীরার অধীনে উকশায় পাকসেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রচন্ড কামানের লড়াই হয়। ঘন ঘন কামানের শব্দ ভারতীয় সীমান্ত এলাকা থেকেও শোনা যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সূত্রে প্রাপ্ত বিশদ বিবরণে জানা যায় যে, এক ব্রিগেড খানসেনা ২৩টি ট্রাকে করে সাতক্ষীরা থেকে উক্ত মহকুমার কালীগঞ্জ থানার অন্তর্গত উকশায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হয়। ভারি কামান থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও তাদের মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে তার উপযুক্ত জবাব দেয়। মুহুর্মুহু কামানের গোলার শব্দে ভারতীয় সীমান্ত এলাকাও কেঁপে উঠতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে পাকসেনারা উকশার কিছু দূরে পিছিয়ে যায় এবং সেখানে অবস্থান নেয়। অন্য এক সংবাদে জানা গেছে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার শ্যাম নগরের কাছে এক স্থানে একটি পাকিস্তানী গানবোট মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ঘাঁটির ওপর গোলাবর্ষণ করলে উভয় পক্ষে প্রচন্ড গুলি বিনিময়ের পর পাক গানবোট পশ্চাদপসারণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের হিসাবে দেখা গেছে যে, গত দুমাসে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে খুলনা সেক্টরে বিভিন্ন স্থানে লড়াইয়ে ৫০০ পাকসেনা ও ২০০ রাজাকার নিহত হয়েছে। তাছাড়া ৬০০ রাইফেল দখল করা হয়েছে। ও ৬০ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ৮ জন পাঞ্জাবী পুলিশ নিহত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা খানসেনাদের ২টি লঞ্চ ও ১টি গানবোট ধ্বংস করেছে ও ১টি লঞ্চ হস্তগত করেছে। মুজিবনগরে আগত খুলনা সেক্টরের বরিশালে লড়াইরত মুক্তিযোদ্ধাদের জনৈক মুখপাত্রের কাছ থেকে জানা গেছে যে, বরিশালের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে দোয়ারিকা, রহমতপুর, উজিরপুর, হাবিবপুর, বানারিপারা, মুলাদি প্রভৃতি স্থানে খন্ড খন্ড ভাবে গেরিলা লড়াই চলেছে। ‘সংগ্রামী বাংলা’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ২২ জন অফিসার ও ৪০০০-এর বেশি সৈন্য, রাজাকার ও বদর বাহিনীর লোক নিহত হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে প্রায় আড়াই হাজার কমান্ডো আক্রমণে উক্ত শত্রুসেনাদের হত্যা করেছে। নৌকমান্ডো সাব লেফটেন্যান্ট মোহাম্মাদ রহমতুল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিফৌজ আশাশুনি অপারেশন পরিচালনা করেন এখানে ২৫ জন রাজাকার নিহত ও আহত হয়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×