ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

এবার ওদের পালা

প্রকাশিত: ০৯:০৯, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

এবার ওদের পালা

‘বাবা কান্দেনা, আমি তোমার জন্য আগামী ঈদে খেলনা নিয়া আসমু।’ বিমানের সান্ধ্যকালীন ফ্লাইটে কলকাতা যাচ্ছি। ওখান থেকে গন্তব্য নয়া দিল্লী। সকালে দিল্লীতে একটা লিভার কনফারেন্সে আমি স্পীকার। ইদানীং কলকাতা কিংবা নয়া দিল্লীর ফ্লাইটে চড়লেই প্রচুর প্রবাসীর দেখা মেলে। এই সেক্টরে বিশেষ করে ইতিহাদে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়াটা বোধকরি ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। অন্যের কথায় কান পাততে নেই। সেটা শিষ্টাচারের ব্যত্যয়। তাও কান পেতে শুনেছি। বলা যায় শুনতে বাধ্য হয়েছি। হৃদয় সিক্ত হয়েছে বুঝতে পেরে যে আরও একজন মাকে তার নয়নের মণিকে দেশে রেখে রুটি-রুজির সন্ধানে মধ্যপ্রাচ্যে যাত্রা করতে হচ্ছে। এমনি কত হাজারো নাম না জানা প্রবাসী হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আর রক্ত ঘাম করা ত্যাগের উপরে দাঁড়িয়েই ক্রমশ্য দৃষ্টিমান আগামীর বাংলাদেশ। কলকাতা এয়ারপোর্টে ট্রানজিট প্রায় তিন ঘণ্টার। মাত্র ল্যাপটপটা খুলে বসেছি। আগামী কালকের লেকচারটা বানানো বাকি। সহসা দৃশ্যপটে আগমন অমিতের। বয়সের হিসেবে আমার অর্ধেক। একটা স্টার্টআপ কোম্পানির হর্তা-কর্তা। বুকিং ডটকমের আদলে বাংলাদেশের জন্য একটা অনলাইন হোটেল বুকিং পোর্টাল নিয়ে আপাতত কাজ করছে। টানা দু’ঘণ্টা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে গেলাম আমাদের প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়ের স্টার্ট অ্যাপ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের গল্প। শ্রমিকের রক্ত ঘামে আজকের যে বাংলাদেশ তাকে আগামী দিনে আমেরিকা-জাপানের কাতারে নিয়ে যে দাঁড় করাবে এসব তরুণ তুর্কিরাই এ নিয়ে আমার আর কোন সংশয় নেই। আমি সেই বাংলাদেশ দেখে যেতে পারবো কি-না জানিনা, কিন্তু আমার সুকন্যা-সুর্য্যর ভবিষ্যত নিয়ে নিশ্চিন্ত আমি। একটা সুখী-সুখী ভাব নিয়ে নয়া দিল্লীর প্লেনে চাপলাম। কিন্তু মনের কোথায় যেন একটা খটকা থেকেই যাচ্ছে। কদিন আগেই কক্সবাজার থেকে ঘুরে এসেছি আরেক দফা। জায়গাটা আমার খুবই প্রিয়। সুযোগ পেলেই ছুটে যাই, বঙ্গপোসাগরে ডুব দিয়ে নিজের যত জড়া-গ্লানি দূর করে, সাগরের বিশালত্বে বিলীন হয়ে নতুন উত্তেজনায়, নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। সাম্প্রতিক আমার ঘন ঘন কক্সবাজার যাতায়াতের অন্যতম ছুতার নাম ‘রোহিঙ্গা’। কুতুপালং আর বালুখালির রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরগুলোয় আমার কয়েকবারই যাওয়া হয়েছে। যাওয়া হয়েছে যেমন রোহিঙ্গা গণহত্যা তদন্তে গঠিত নাগরিক কমিশনের সাথে, তেমনি যাওয়া হয়েছে রিসার্চার হিসেবে রোহিঙ্গাদের মাঝে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের প্রার্দুভাব খুঁজতে ব্লাড সেম্পল কালেকশনের জন্যেও। গিয়েছি যেমন গবেষকের জুতা পায়ে, গিয়েছি তেমনি আর দশজন কৌতুহলি বাঙালীর চপ্পল পড়েও। আমি কোন রোহিঙ্গা বিশারদ নই। কিন্তু গত দু’বছরে ওদের আগমন আর ক্রমবিবর্তনের অনেকখানি স্বাক্ষী আমি। আমি চোখের সামনে উজাড় হতে দেখেছি বিস্তীর্ণ বনভূমি। কেটে সমান হতে দেখেছি পাহাড়ের পর পাহাড়। একের পর এক বন্ধ হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্রমসম্প্রসারণশীল প্রশাসনযন্ত্রকে জায়গা ছেড়ে দেয়ার বাধ্যবাধকতায়। ঝরতে দেখেছি স্থানীয় তরুণদের কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনজিওর চাকরির হাতছানিতে। দেখেছি এমনি আরও অনেক কিছুই। যেমন দেখেছি বেকার হতে স্থানীয় দিনমজুর আর খেটে খাওয়া মানুষদের সস্তা রোহিঙ্গা শ্রমিকদের জন্য জায়গা ছাড়তে গিয়ে, তেমনি দেখেছি বড়-দামী সব গাড়ি হাঁকিয়ে কক্সবাজার দাবড়ে বেড়ানো এনজিওর বড় সাহেবদের দাবরানিতে জিনিসপত্রের দাম তরতড়িয়ে বাড়তে। নিজের চোখে দেখেছি রোহিঙ্গা শিবিরের বাজারে-দোকানে দেদার বিক্রি হতে মোবাইল থেকে শুরু করে হরেক রকম ভোগ্যপণ্য। সকাল সাতটায় ঝুলতে দেখেছি মস্ত সব গরুর রান, ঢাকার বাজারেও অমন গরুর মাংস সহজে মেলা ভার। পাশাপাশি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে দেখেছি রোহিঙ্গাদের সংখ্যা। প্রায় দশ শতাংশ হারে বাড়তে বাড়তে এদেশে দু’বছর আগে আশ্রয় নেয়া দশ লাখ রোহিঙ্গা বেড়ে এখন সম্ভবত বারো লাখ ছুঁয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় সাড়ে তিন লাখ নারীর মধ্যে প্রায় পঁচাত্তর হাজারই গর্ববতী। এখনই ওরা সংখ্যায় উখিয়া আর টেকনাফের জনসংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি। আর যদি তারা এভাবে বাড়তে থাকে আগামী সাত-দশ বছরে যে তারা কক্সবাজারের পঁচিশ লাখ বাঙালীকে ছাড়িয়ে যাবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের যে বাংলাদেশ ষোলো কোটি মানুষকে খাইয়ে-পরিয়ে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে তো রেখেছেই, রফতানি করছে উদ্বৃত্ত খাবারও, পদ্মা সেতু-মেট্রোরেল-রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র-বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মতো একের পর এক চমক দিয়ে যে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে রোল মডেল, সেই বাংলাদেশের জন্য দশ-পনেরো লাখ রোহিঙ্গা কি খুব বড় কোন চ্যালেঞ্জ। সম্ভবত নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তাই বলেছেন। বলেছেন ষোলো কোটি মানুষকে যখন খাওয়াচ্ছেন, আর দশ লাখকেও পারবেন। আমার খচ-খচানিটা সেখানে না। আমার চিন্তাটা অন্য কারণে। কারা এই রোহিঙ্গা? আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত, আধুনিক চিন্তা-চেতনা বিবর্জিত আর আধুনিকতা থেকে যোজন যোজন দূরত্বের বাসিন্দা এই দশ লাখ রোহিঙ্গার কাছে কুতুপালং আর বালুখালির আশ্রয় শিবিরই আরদ্ধ। ওখানে ওদের জীবনমান দেখে আপনার-আমার হৃদয় আর্দ্র হতে পারে, কিন্তু জেনে রাখুন এটাই ওদের কাছে ফেলে আসা জীবনের তুলনায় অনেক বেশি ভাল কিছু। এই জীবনটা ওদের চিন্তারও অতীত। ওরা আর একাত্তরে ভারতে যাওয়া বাঙালী শরণার্থীরা এক নয়। সেদিনের বাঙালীরা ভারতে পা রাখার আগে থেকে নিজ দেশে ফিরে আসতে মুখিয়ে ছিল। কিন্তু এরা থাকতে এসেছে, ফিরে যেতে নয়। এদের কোন ‘বঙ্গবন্ধু’ নেই, নেই কোন আওয়ামী লীগও। এদের শিবিরের অলিগলিতে ছড়িয়ে আছে আরসার জিহাদী দাওয়াত আর তাতে ঘি ঢালছে মধ্যপ্রাচ্যের অন্ধ অর্থায়ন। উপড়ি আছে জামায়াত ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ একদল এনজিওর তৎপরতাও। কৃষি উপকরণের নামে রোহিঙ্গাদের এনজিওর সরবরাহ করা ধারাল সব অস্ত্র তো উদ্ধার হলো এই সেদিনই। তার ওপর আছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও। এই ক’দিন আগে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে রোহিঙ্গাদের মাঝে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে আমার গবেষণা নিবন্ধ। জেনে অবাক হবেন প্রতি দুই কোটি বাংলাদেশীর মাঝে আছে যতজন সি ভাইরাসের রোগী ঠিক সেই পরিমাণ সি ভাইরাস আক্রান্ত রোহিঙ্গা ছড়িয়ে আছে কুতুপালং আর বালুখালিতে আর ছড়িয়ে দিচ্ছে ঘাতক এই ভাইরাস ক্যাম্প আর কক্সবাজারের সীমানা পেরিয়ে সারাদেশে। এই বাংলাদেশ ওদের জন্য নয়। বঙ্গবন্ধু এনে দেয়া স্বাধীনতার ওপর দাঁড়িয়ে জননেত্রী এ দেশেকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে আনছেন কোন জেহাদী জনগোষ্ঠীর ধর্মান্ধতার পালে হাওয়া দেয়ার জন্য না। এ কথা জানেন সবাই। বোঝেনও ঠিকঠাক। জেনেও জানতে-বুঝতে চান না শুধু তারাই যাদের ঘর-সংসার চলে রোহিঙ্গাদের বিক্রি করে। আর সেই সব ভিনদেশী যাদের মাসের পর মাস কাটে কক্সবাজারের তারকাখচিত হোটেল রুমে আর উইকএন্ড বঙ্গোপসাগরে সমুদ্র¯œান করে। সমস্যাটার সমাধান যে কোথায় তা কে জানে কি জানি! কেউ বলেন ডিপ্লোমেসির কথা। বেজিংকে ধরে, ওয়াশিংটনে ধরনা দিয়ে আর নয়াদিল্লীর মাথায় হাত বুলিয়ে নেপিদোকে রাজি করাতে চান তারা। সে চেষ্টাটা আছে শুরু থেকেই। আরেক দল আবার আছেন উগ্রপন্থী। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ তাদের। আমার দেশ যখন সাত ছাড়িয়ে আট শতাংশ প্রবৃদ্ধির দ্বারপ্রান্তে, তখন দেশের সর্বনাশ করার জন্য এর চেয়ে ভাল প্রস্তাব বোধকরি আর কিছু হতে পারে না। না পারে- এর চেয়ে আন্তবিধ্বংসী প্রস্তাবও আছে। সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে, রোহিঙ্গাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়ার যুুক্তি দেয়ার মতো লোকও এদেশে আছে। মূর্খ ওরা, পড়েনি ইতিহাস। এভাবে তুলে দেয়া বন্দুকের নল উল্টো দিকে ঘুরতে বাধ্য। ইতিহাস এর সাক্ষ্য দেয়। নিকট ইতিহাসেই এমনটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে মার্কিনীরা আফগানিস্তানের পর্বতে আর সিরিয়ার মরুভূমিতে। আজ আমরা রোহিঙ্গাদের অস্ত্র সজ্জিত করলে কাল ওদের বন্দুকের নল অবধারিতভাবেই আমাদের দিকে ঘুরবে। যতই দিন গড়াচ্ছে, রোহিঙ্গা সমস্যা বহুমাত্রিকতা যেন পরিষ্কার হচ্ছে তেমনি একইভাবে বাড়াছে রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমে ফেরত পাঠানো যৌক্তিকতা আর তাগিদ। সমাধানের রাস্তা খুঁজবেন বিশেষজ্ঞরা। আমাদের প্রত্যাশা শুধু ফিরে যাক ওরা, ফিরে যাক মিয়ানমারে। প্রয়োজনে এ জন্য মিয়ানমারের সিভিল সোসাইটির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো যেতে পারে যাতে নেপিদো নিজ দেশে চাপে পরে। যে কাজ সরকার পারে না, যে কথা বলতে পারে না সরকার, তার অনেক কিছুই করতে পারে সিভিল সোসাইটি। বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারত আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিভিল সোসাইটি হরহামেশাই এমন ভূমিকা পালন করে। সাহায্য নেয়া যেতে পারে আমাদের বৌদ্ধ কমিউনিটিরও। নির্মূল কমিটির সভাপতি শাররিয়ার কবির সম্প্রতি একটি সাক্ষাতকারে এমনি পরামর্শ দিয়েছেন। আমাদের বৌদ্ধ ধর্মগুরু সুদ্ধানন্দ মহাথেরোর সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকেন মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচি। মনেপ্রাণে শতভাগ বাংলাদেশী এই শ্রদ্ধেয় বৌদ্ধভিক্ষুকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। প্রয়োজনে তার সাহায্য নিতে সমস্যা থাকার কথা না। আমি নিশ্চিত জানি তিনি এবং তার মতন এমনি অনেক বৌদ্ধধর্মীয় নেতাই এ কাজে আমাদের সাহায্য করবেন। ভাবা যেতে পারে থার্ড পার্টি সেটেলমেন্টের কথাও। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই তো শ্রমশক্তির জন্য অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল। কৃষি কাজের জন্য লোক প্রয়োজন আফ্রিকার দেশে দেশে। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় নেপালে আশ্রয় নেয়া দেড় লাখ ভুটানী শরণার্থীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে স্থানান্তর করা যদি সম্ভব হয়ে থাকে তা হলে আজ কেন নয়? আমার এই লেখা পড়ে অখুশি হতে পারেন কেউ কেউ। মনে করতে পারেন রোহিঙ্গাদের প্রতি আমার মানবিকতায় ঘাটতি আছে। ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। আমরা আমাদের জায়গায় ঠিকই আছি। আমরা শরণার্থীদের ভূমধ্যসাগরে ডুবিয়ে মারিনি। আমরা ঘূর্ণিঝড়দুর্গত মানুষের জন্য বন্ধ করে দেইনি আমাদের সীমানাও। আমরা আমাদের কাজটুকু ঠিকঠাক মতোই করেছি। এবার ওদের পালা। লেখক : সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
×