ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

শহীদ জননী শাহানারা নিজে কাঁদলেন, কাঁদালেন সবাইকে

প্রকাশিত: ১১:১৭, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

শহীদ জননী শাহানারা নিজে কাঁদলেন, কাঁদালেন সবাইকে

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ ১৫ আগস্ট ভয়াল কালরাতের শহীদ পরিবার ও নির্যাতিতদের নিয়ে শনিবার বরিশালে হলো এক ব্যতিক্রমধর্মী শোকাবহ আগস্ট স্মরণে দোয়া ও স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠান। দীর্ঘ ৪৪ বছর পরে প্রথমবারের মতো বরিশাল জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বেলা এগারোটায় ১৫ আগস্টের শহীদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ সকল শহীদের রুহের মাগফেরাত কামনায় দোয়া-মোনাজাত ও শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্যদিয়ে স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ১৫ আগস্ট কালরাতের নীরব সাক্ষী শহীদ শিশু সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতের হতভাগ্য পিতা ও বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে সাবেক চীফ হুইপ এবং পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটির মন্ত্রী পদমার্যায় আহবায়ক আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি। প্রধান আলোচক ছিলেন ওই ভয়াল কালরাতে ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত বুলেটবিদ্ধ শহীদ জননী, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর সহধর্মিণী শাহানারা বেগম। মুখ্য আলোচক ছিলেন শহীদ সুকান্ত বাবুর ছোট ভাই বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের জনপ্রিয় মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। ব্যতিক্রমধর্মী স্মৃতিচারণ ও আলোচনা অনুষ্ঠানে গেস্ট অব অনার ছিলেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম এমপি, বিশেষ অতিথি বরিশাল-৩ আসনের এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপু, বরিশাল-৬ আসনের এমপি নাসরিন জাহান রতœা আমিন, সংরক্ষিত আসনের এমপি সৈয়দা রুবিনা আক্তার মিরা, বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার ইয়ামিন চৌধুরী, বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি শফিকুল ইসলাম ও বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান। জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল ও সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর। সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা ডাঃ খ.ম জিল্লুর রহমান ও মহিউদ্দিন মানিক বীরপ্রতীক। অনুষ্ঠানে ১৫ আগস্টের নির্মম ও হৃদয়বিদারক ঘটনার চিত্র তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নেবৌ মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা, বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ও শহীদ জননী শাহানারা বেগম। প্রধান আলোচকের বক্তব্যে ১৫ আগস্টের সেই লোমহর্ষক বর্ণনা দিতে গিয়ে শাহানারা বেগম নিজে কাঁদলেন, কাঁদালেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষকে কাঁদিয়েছেন। তিনি বলেন, সেদিনের সেই স্মৃতি আজও আমাকে কাঁদায়। এক মুহূর্তের জন্য সেদিনের নির্মম হত্যাকা-ের কথা আমি ভুলতে পারি না। ১৫ আগস্টের ও নির্মম হত্যাকা-ের সময় আমার শরীরেও ঘাতকদের ছোড়া তিনটি গুলি লাগে, যা আমি এখনও শরীরে বহন করে চলছি। ঘাতকদের গুলিতে আমার শিশুসন্তান সুকান্ত বাবু শহীদ হলেও আমার কোলে থাকা আজকের বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ প্রাণে বেঁচে যায়। আমার শরীরে গুলি লাগার পর আমি রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকায় ঘাতকরা মনে করেছিল আমি মারা গেছি। কিন্তু আপনাদের দোয়ায় আমি আজও বেঁচে আছি। বেঁচে আছে আমার সন্তান সাদিক আব্দুল্লাহও। এসব কথা বলার এক পর্যায়ে তিনি (শাহানারা বেগম) কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দীর্ঘ বক্তব্য থামিয়ে আবেগাপ্লুত শাহানারা বেগম আবার বক্তব্য শুরু করেন। আবার কাঁদেন। তার কান্না থামছিলই না। তার কান্না দেখে উপস্থিত সবার চোখ থেকেও জল গড়াতে শুরু করে। উপস্থিত কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। শোকস্তব্ধ অনুষ্ঠানস্থল নগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যানজুড়ে তখন পিনপতন নীরবতা। একইভাবে ১৫ আগস্ট ভয়াল কালরাতের বর্ণনা দিতে দিয়ে কেঁদে ফেলেন ওই রাতে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের বাড়িতে উপস্থিত ক্রিসেন্ট ব্যান্ড গ্রুপের অন্যতম সদস্য ডাঃ খ.ম জিল্লুর রহমান ও মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন মানিক বীরপ্রতীক। এই স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান ঘিরে বরিশাল বঙ্গবন্ধু উদ্যানে মানুষের ঢল নামে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ, দলীয় নেতাকর্মী, বিভিন্ন উপজেলার চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলরসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ভাদ্রের তালপাকা খরতাপ উপেক্ষা করে তারা ১৫ আগস্টের ওই স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠান ও ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা শোনেন। দীর্ঘ ৪৪ বছর পর বরিশালে এই প্রথমবারের মতো ব্যতিক্রমী ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করায় উপস্থিত সর্বস্তরের মানুষ বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমানকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
×