ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

কঠোর অবস্থানে সরকার

পাওনা আদায়ে গ্রামীণ ফোন-রবির লাইসেন্স বাতিলের হুমকি

প্রকাশিত: ০৯:৫৫, ৩১ আগস্ট ২০১৯

 পাওনা আদায়ে গ্রামীণ ফোন-রবির লাইসেন্স বাতিলের হুমকি

ফিরোজ মান্না ॥ গ্রামীণফোন-রবির পাওনা আদায় পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। মোবাইলফোন অপারেটরদের কাছে পাওনা টাকা চাইছে মন্ত্রণালয়, আর অপারেটররা চাইছে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান। কিন্তু মন্ত্রণালয় পাওনা আদায় বিষয়ে অনড় অবস্থানে মন্ত্রণালয়। তাদের সঙ্গে কথা আগে টাকা দিতে হবে, এরপর আলোচনা। পাওনা টাকা না যদি পাওয়া যায় তাহলে লাইসেন্সও বাতিল হতে পারে। ব্যবসা করতে হলে দেশের আইন মেনেই করতে হবে। লাইসেন্স নেয়ার সময় এসব শর্ত মেনেই অপারেটররা লাইসেন্স নিয়েছে। মন্ত্রণালয় বলছে এক্ষেত্রে কোন ছাড় নয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এ তথ্য জানিয়েছেন। বিটিআরসি জানায়, তাদের নিরীক্ষা (অডিট) অনুযায়ী, গ্রামীণফোনের কাছে পাওনা ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এরমধ্যে বিটিআরসির পাওনা ৮ হাজার ৪৯৪ কোটি এক লাখ টাকা ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ৪ হাজার ৮৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে (সিইও) চিঠি দেয়া হয়েছে। নিয়োগকৃত অডিট ফার্মের অডিট রিপোর্টের ভিত্তিতে এই টাকা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু চার মাসেও তারা টাকা পরিশোধ করেনি। মূল পাওনা ছিল প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। সুদ আসলে এখন বিশাল অঙ্কের দাঁড়িয়েছে। বিটিআরসির পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য গ্রামীণফোনকে ১০ দিন সময় দেয়া হয়েছিল। এর আগে বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, আইন অনুযায়ী এ বিষয়ে সালিশের (আরবিট্রেশন) কোন সুযোগ নেই। পাওনা আদায় না হওয়া পর্যন্ত ব্যান্ডউইথ সীমিতই থাকবে। যে দেশে তারা ব্যবসা করছেন সেই দেশের আইন না মানলে কাউকে বাড়তি সুযোগ দেয়া হবে না। গ্রামীণফোনের কাছে নিরীক্ষা আপত্তির দাবির ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং আরেক মোবাইল ফোন অপারেটর রবির কাছে তাদের পাওনা ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এটা সরকারের টাকা। সরকারকে এই টাকা পরিশোধ করতে হবে। অথচ কয়েক দফা সময় দেয়ার পরও তারা টাকা পরিশোধ করেনি। এ কারণে গত ৪ জুলাই গ্রামীণফোনের ব্যান্ডউইথ ক্যাপাসিটি ৩০ শতাংশ এবং রবির ১৫ শতাংশ সীমিত করতে ইন্টারনেট গেটেওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বিটিআরসি। এখনও এই দুই অপারেটরের ব্যান্ডউইথ কমই রয়ে গেছে। এদিকে অপারেটররা জানিয়েছে, মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসির নানামুখী চাপে দিন দিন মোবাইল ফোনের ব্যবসা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার চাপে নষ্ট হচ্ছে ব্যবসার পরিবেশ। বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এমনকি দেশের সবচেয়ে বড় দুই কোম্পানির সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে অডিটের অর্থ আদায়ের বদলে লাইসেন্স বাতিলের কথা বলা হচ্ছে। টেলিযোগাযোগ খাতে এমন সঙ্কটাপন্ন অবস্থা এর আগে দেশে আর হয়নি। মোবাইল অপারেটরগুলো এখন মূলত ত্রিমুখী চাপের মধ্যে রয়েছে। তাদের দাবি অতিরিক্ত ট্যাক্স ও তরঙ্গের উচ্চমূল্য, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের অভাব ও নিয়ন্ত্রক কমিশনের চাপে তারা দিশেহারা। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে গ্রামীণফোন ও রবির কাছে বিটিআরসির অডিটকৃত পাওনার চাপ। এই অর্থ আদায়ে আলোচনার পথ না বিটিআরসি লাইসেন্স বাতিলের করে দেয়ার কথা ভাবছে। মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসির অবস্থান জানতে এমটবের (এ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল অপারেটরস অব বাংলাদেশ) মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম ফরহাদ (অব) বলেন, দেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখতে হলে অবশ্যই ব্যবসার পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে না পারলে সেবা আসবে কোথা থেকে? তাছাড়া সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন সার্থক করতে মোবাইল অপারেটরগুলোর টিকে থাকা জরুরী। এজন্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আর আলোচনার ভিত্তিতেই সেই পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস। শুধু শেয়ার বাজার নয়, সরকার যে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করে তাতে মোবাইল অপারেটরগুলোই শীর্ষে অবস্থান করছে। মোট দেশজ আয়ের (জিডিপি) ৬ শতাংশেরও বেশি দেয় মোবাইল অপারেটররা। তারপরেও বাজারে টিকে থাকতে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যেতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। একমাত্র গ্রামীণফোন ছাড়া আর সব কোম্পানিই বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে। এ বছর বাজেটে সিম ট্যাক্স, সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। অলাভজনক কোম্পানির ন্যূনতম কর শূন্য দশমিক ৭৫ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ২ শতাংশ যা মূল রাজস্বের ওপর ধার্য করা হয়। এতে কোম্পানিগুলো আরও রুগ্ন হয়ে পড়বে। অপারেটররা বলেছে, বিটিআরসির দাবি অস্বীকার করে এসেছে। তারা বলছে অডিটের হিসাবে সমস্যা আছে। তাছাড়া যে নীতি মেনে তরঙ্গের ওপর এতদিন বিটিআরসি যে হারে অর্থ আদায় করে এসেছে সেই হিসাব অস্বীকার করে হুট করে নতুন করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করা নীতিগ্রাহ্য নয়। গ্রামীণফোন ও রবির কোন পণ্য ক্রয়, আমদানি, প্যাকেজ ইত্যাদিতে নতুন করে কোন এনওসি দেয়া হচ্ছে না। হ্যান্ডসেট বিক্রি বা রোমিংয়ের ক্ষেত্রে অপারেটররা যে অর্থ আদায় করে গ্রাহকদের কাছে তার অতি সামান্যই পায় অপারেটররা, মূল অর্থ পায় রোমিংর ক্ষেত্রে বিদেশী অপারেটররা আর হ্যান্ডসেটের ক্ষেত্রে সরবরাহকারীরা। কিন্তু অডিট এই পুরো অর্থের ওপর অপারেটরদের কাছে রাজস্ব আদায় করতে চাইছে। আবার ওই পাওনা অর্থের ওপর সুদসহ অর্থ আদায়ের দাবি করা হয়েছে। এমনকি আদালতে বিচারাধীন অর্থ নিয়েও অডিট পাওনা হিসাব করেছে। শেয়ার বাজারে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনও সম্প্রতি এই অডিটের সংবাদ প্রচারের পরে কোম্পানির শেয়ার ১৩ হাজার কোটি টাকা কমে গেছে। এতে পক্ষান্তরে দেশের ক্ষুদ্র শেয়ার হোল্ডাররাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সূত্র জানিয়েছে, ব্যবসার পরিবেশ ভাল না থাকা ও লোকসানের ভারে জর্জরিত হওয়ার কারণে ইতিমধ্যেই দেশ থেকে কয়েকটি অপারেটর চলেও গিয়েছে বা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। সবচেয়ে পুরনো কোম্পানি সিটিসেলের সেবাদান বন্ধ, আবুধাবী কেন্দ্রিক ওয়ারিদ টেলিকম বিক্রি হয়ে যায় ভারতের এয়ারটেলের কাছে, এয়ারটেল ব্যবসা টানতে না পেরে রবির সঙ্গে একীভূত হয়। রবির আরেক অংশীদার জাপানের এনটিটি ডোকোমো তাদের শেয়ার তিন ভাগের একভাগে নামিয়ে এনেছে। এভাবেই চলছে মোবাইল সেক্টরটি। শুধু মোবাইল অপারেটরদের ক্ষেত্রেই নয়, যথাযথ নীতি গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় এর আগে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের অর্থে গড়ে ওঠা ফিক্সড লাইন সেবাদাতা পিএসটিএন কোম্পানিগুলোও ব্যবসা করতে পারেনি। ব্যবসা করতে পারেনি দুই ওয়াইম্যাক্স কোম্পানিও। রবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহতাব উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে বিনিয়োগকারীরা এদেশ থেকে তাদের ব্যবসা তুলে নেয়ার কথা বিবেচনা করতে পারে। বিতর্কিত নিরীক্ষা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দাবিকৃত অর্থ আদায়ে নিয়ন্ত্রক কমিশন আমাদের লাইসেন্স বাতিলের কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে এ সমস্যা সমাধানে সহায়ক নয় বলে আমরা মনে করি। এ সমস্যার সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান হচ্ছে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করা। গ্রাহক স্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে লাইসেন্স বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তা এ দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করায় বাংলাদেশ বিশ্ব বাজারে যে সুনাম অর্জন করেছিল তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
×