ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

২২ আগস্ট শুরু করতে আগ্রহী মিয়ানমার

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে যে কোন সময় ॥ পররাষ্ট্র সচিব

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ১৯ আগস্ট ২০১৯

 রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে যে কোন সময় ॥ পররাষ্ট্র সচিব

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু এবং এর দিনক্ষণের বিষয়টি রবিবার পর্যন্ত পরিষ্কার হয়নি। পুরো বিষয়টি রয়েছে ঘুরপাকে। আগামী ২২ আগস্ট থেকে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে আগ্রহী বলে দেশীয় ও বিশ্ব গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত হলেও বিষয়টি এখনও সন্দেহের দোলাচলে রয়েছে। তবে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক রবিবার বলেছেন, যে কোনদিন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। অপরদিকে, রবিবার কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত প্রত্যাবাসন টাস্কফোর্সের সভায় অংশ নিয়ে জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যেসব বিষয় প্রয়োজন তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সরকারী নির্দেশনা বৈঠকে গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা নাগরিকত্ব প্রাপ্তিসহ মর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী, অন্যথায় নয়। এদিকে, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী আগামী ২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার থেকে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম যদি শুরু হয় প্রথম ধাপে মিয়ানমার প্রেরিত ছাড়পত্র অনুসারে প্রথম ধাপে ৩ হাজার ৫৪০ রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফেরত যাবে। তবে শুরুর দিনে ঘুমধুমের ট্রানজিট পয়েন্ট মৈত্রীসেতু দিয়ে দেড়শ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার গ্রহণ করবে বলে সে দেশের গণমাধ্যমে তথ্য বেরিয়েছে। বাকিগুলোকে পর্যায়ক্রমে নেয়া হবে। তবে প্রত্যাবাসন শুরুর ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কোন সূত্রই রবিবার পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোন ঘোষণা দেয়নি। শুধু তাই নয়, দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেক কর্মকর্তা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলেও মতব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি আশ্রিত ক্যাম্পগুলোতেও রবিবার পর্যন্ত কোন প্রস্তুতি কার্যক্রম চোখে পড়েনি। তবে মিয়ানমার পক্ষ বিশ্ব গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, তারা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে প্রস্তুতি নিয়েছে। রবিবার কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত প্রত্যাবাসন ইস্যুতে টাস্কফোর্সের এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কক্সবাজার শহর এলাকায় শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের এ বৈঠকে আরআরসি কমিশনার আবুল কালাম, বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার নুরুল আলম নেজামী, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন, পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন, অতিরিক্ত আরআরসি শামসুদ্দোজা নয়ন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এসএম সরোয়ার কামালসহ সেনা প্রতিনিধি, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা বিভাগের প্রতিনিধি, বিজিবি প্রতিনিধি, টেকনাঢ ইউএনও এবং জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে জানানো হয়েছে, টাস্কফোর্সের বৈঠকে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। মিয়ানমার সরকার পক্ষে নাকি ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। টাস্কফোর্সের বৈঠকে অংশগ্রহণকারী কক্সবাজারজেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন জানিয়েছেন, প্রত্যাবাসন শুরু করতে প্রশাসন প্রস্তুতি কাজ সম্পন্ন করেছে। বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার নুরুল আলম নেজামী জানিয়েছেন, এখন চলছে শেষ পর্যায়ের কার্যক্রম। সবকিছু ঠিক থাকলে কার্যক্রম প্রক্রিয়া আরও বৃদ্ধি করা হবে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোঃ আবুল কালাম জানিয়েছেন, বিদেশী গণমাধ্যমে তথ্য বেরিয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ৩ হাজার ৫৪০ রোহিঙ্গার জন্য ছাড়পত্র দিয়েছে। তার মতে, শুধু ছাড়পত্র দিলে তো হবে না, প্রত্যাবাসনের সঙ্গে নানা বিষয় জড়িত। যেমন যাদের ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে তারা যেতে চায় কিনা, সেখানে যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে কিনা এ ধরনের নানা প্রশ্ন জড়িত রয়েছে। এদিকে, সরেজমিনে খবর নিয়ে জানা গেছে, উখিয়া টেকনাফের ৩০ ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অনেকে নিজ দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী। কিন্তু সশস্ত্র দুটিসহ তিনটি গ্রুপের ভয়ভীতিতে আগ্রহীরা কেউ মুখ খুলতে পারছে না। এদের অনেকে রবিবার জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপে বলেছেন, ভিনদেশে ক্যাম্পে থাকার চেয়ে নিজদেশের বাড়ি ঘরে থাকা শ্রেয়। নিজ ভিটে বাড়িতে স্বাধীনভাবে থাকা যায়। এদেশে যতই ফ্রি খাওয়া বা ত্রাণ পাওয়া যাক না কেন, নিজেদের পরাধীন মনে হয়। ফিরে যেতে আগ্রহীরা আল ইয়াকিন ও আরএসও নামধারী সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের কারণে মুখ খোলার সাহস করছে না। প্রত্যাবাসনের আগে কথাটা শোনামাত্র সন্ত্রাসীরা এসে অত্যাচার নিপীড়ন চালায়, এমনকি ইতোমধ্যে কেউ কেউ হত্যার শিকার হয়ে তাদের লাশও গুম হয়ে গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পক্ষে জানানো হয়েছে, তারা একদিন না একদিন নিজ দেশে ফিরে যাবেন। আবার ফিরে গেলে ওপারে মগ সন্ত্রাসীদের ভয়। এপারে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ভয়। ফলে কেউ কেউ সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে। এসব রোহিঙ্গাদের মতে, প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে হলে সবার আগে আল ইয়াকিন ও আরএসও নামধারী সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করতে হবে। গ্রেফতার করতে হবে বিভিন্ন স্থানে ঘাপটি মেরে থাকা রোহিঙ্গা জঙ্গীদের। যারা নিজ দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী তাদের সমুদয় নিরাপত্তা দিলে তারা ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে দিন দিন সাহসী হয়ে উঠবে বলেও রোহিঙ্গাদের সূত্রে জানানো হয়েছে। প্রশাসন সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার যৌথ সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতোপূর্বে ৪৮৫ পরিবারের ২ হজার ৬০ রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করার প্রস্তুতি নিয়েছিল। সে সময় অর্থাৎ ২০১৮ সালের ১৫ নবেম্বর রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে মিয়ানমার সীমান্তের ঢেঁকিবুনিয়া পয়েন্টে সে দেশের একজন মন্ত্রীও এসেছিলেন। বাংলাদেশ পক্ষ রোহিঙ্গাদের ওপারে ফেরত পাঠাতে ট্রানজিট ক্যাম্পে পৌঁছে দিতে একাধিক যানবাহনও পাঠিয়েছিল। কিন্তু রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে না বলে আওয়াজ তুললে সে সময় ভ-ুল হয়ে যায়। অবশ্য এ না বোধক মনোভাবের নেপথ্যে বিদেশী একাধিক এনজিওর ষড়যন্ত্র ও রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের ভীতি সঞ্চারের বিষয়টি জড়িত রয়েছে। স্থানীয়দের বিভিন্ন সূত্রে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে এই বলে যে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা এখনও নিয়মিত আশ্রয় শিবিরগুলোতে যাতায়াত করছে। তারা চায় না আশ্রিতরা ফিরে যাক। অপরদিকে, বালুখালী ক্যাম্পের কয়েক রোহিঙ্গা জানিয়েছে, তারা চায় প্রত্যাবাসন শুরু হোক। তবে তার আগে নাগরিকত্ব দিতে হবে। হঠাৎ করে প্রত্যাবাসনের কথা তুললে তারা ওভাবে ফিরে যাবে না। পররাষ্ট্র সচিব যা বলেছেন ॥ রবিবার ঢাকায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এবং স্ট্রাটেজিক স্টাডিজে আয়োজিত রোহিঙ্গা বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক জানান দিয়েছেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যে কোন সময় শুরু হতে পারে। তিনি আরও জানিয়েছেন, পর্দার অন্তরালে অনেক কিছু হচ্ছে, চেষ্টা হচ্ছে। তবে সবচেষ্টা সফল হবে এমন নয়। বাংলাদেশের পক্ষে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে যাতে তারা নিজ দেশে ফিরে যায়। তিনি আরও বলেন, এটা শুধু বাংলাদেশের না, রোহিঙ্গাদেরও প্রধান উদ্দেশ্য। যদি তারা ফিরে না যায় তবে সে দেশে শুধু জমির অধিকার নয়, তারা তাদের সব অধিকার হারাবে। শহীদুল হক আরও জানান, প্রত্যাবাসন বাংলাদেশের কাছে সবসময় একটি অগ্রাধিকারের বিষয়। এ বিষয়টিতে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। অনেকে রোহিঙ্গা সঙ্কটকে বাংলাদেশ বনাম রোহিঙ্গা সমস্যা বলে বর্ণনা করে থাকেন। কিন্তু বিষয়টি তেমন নয়। প্রকৃতপক্ষে এটি মিয়ানমার এবং তাদের লোকদের মধ্যে সমস্যা। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আগামী অধিবেশনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মতব্যক্ত করে শহীদুল হক জানান, সমস্যার সমাধান সহজ নয়। উল্লেখ্য, রাখাইন রাজ্যে ত্রিশটি নিরাপত্তা চৌকিতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে বলে প্রচার করার পর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট গভীর রাত থেকে রাখাইন জুড়ে চলে সেনা অভিযান। অত্যাচার নির্যাতনের মুখে টিকতে না পেরে প্রাণ বাঁচাতে ওপারের সীমান্ত এলাকায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় গ্রহণ করে। বাংলাদেশ সরকার পক্ষে মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়া হয় এবং যথাযথ সম্মানের সঙ্গে ত্রাণ সহায়তা দিয়ে তাদের আশ্রয় দেয়া হয়। বর্তমানে উখিয়া টেকনাফের ত্রিশ শিবিরে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। জাতিসংঘের হিসাবে যে সংখ্যা ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫৭ জন। এসব রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও টেকনাফের কেরনতলীতে ইতোপূর্বে দুটি প্রত্যাবাসন ঘাট নির্মাণ করা হয়েছে। ঘুমধুমে বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সড়ক ও কেরনতলী পয়েন্টে প্যারাবনের ভেতর দিয়ে লম্বা কাঠের জেটি স্থাপন করা হয়েছে। প্রত্যাবাসন ঘাটে ৩৩ সেমিপাকা টিনের ঘর থাকার পরও শৌচাগার তৈরি করা হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য আনসার মোতায়েন রয়েছে। এ দুঘাট দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। উল্লেখ করা যেতে পারে, গেল বছরের ১৫ নবেম্বর দুই দেশের সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত ানুযায়ী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর কথা ছিল। সে সময়ও মিয়ানমার পক্ষ তড়িঘড়ি করেই দিনক্ষণ ধার্য করেছিল। কিন্তু ওপারে রাখাইন রাজ্যে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে রাজি নয় বলে সাফ জানিয়ে দিলে তা ভ-ুল হয়ে যায়। বর্তমানেও নতুন কর শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, আগামী ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন শুরুর কথা জানান দিয়েছে মিয়ানমার পক্ষ। বাংলাদেশ সরকারও সে অনুযায়ী প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যারা যাবে অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে কি নিয়ে যাব। আমাদের নাগরিকত্ব কোথায়। নিজ দেশে ফিরে গেলে থাকব কোথায়। আগের বাড়ি ঘরের কোন হদিস নেই। সবই মিশে গেছে বুলডোজারের মাটির চাপায়। রাখার ব্যবস্থা হয়েছে সেনা নিরাপত্তায় একাধিক ক্যাম্পে। আমাদের দেয়া কোন দফা নিয়ে এখনও মিয়ানমার রফা করেনি। তাই প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে এখনও অনিশ্চয়তার আবর্তে রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
×