ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রণাঙ্গনে নৌ-কমান্ডো

প্রকাশিত: ০৯:০১, ৪ আগস্ট ২০১৯

রণাঙ্গনে নৌ-কমান্ডো

১৯৭১ সালের ৪ আগস্ট দিনটি ছিল বুধবার। এদিন মুক্তি সংগ্রামের পূর্ব সেক্টর প্রেস এ্যান্ড লিয়াজোঁ অফিসার সুলতান মাহমুদের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, মুক্তিফৌজ কুমিল্লার চটেশ্বরে অবস্থিত পাকবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে আক্রমণ করে সেখানে ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টা দীর্ঘস্থায়ী একটি খণ্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিফৌজ পাকবাহিনীর ৫ জনকে হত্যা করে এবং ২ জনকে আহত করতে সমর্থ হন। মুক্তিবাহিনী মর্টারসহ ব্যাপক হামলা চালায় রায়পুরের পাকশিবিরে। ২০ পাকসেনা এবং ৭ রাজাকার ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। একই এলাকায় গোমতী নদীর তীরবর্তী কুমিল্লার পূর্বাঞ্চলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হরিমঙ্গল ব্রিজে মুক্তিফৌজ ৩ পাকসেনা এবং শ্রীমান্তপুরে আরও ২ পাকসেনাকে খতম করে। কোটেশ্বরে অবস্থিত পাকবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে আক্রমণ করে সেখানে ৩ ঘণ্টা দীর্ঘস্থায়ী একটি খণ্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৫ জন নিহত। ৭নং সেক্টরে পাকহানাদার বাহিনী নদীপথে তাহেরপুরের দিকে অগ্রসর হলে হাবিলদার শফিকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এ্যামবুশ করে। এ সংঘর্ষে ১৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। সিলেটে মুক্তিবাহিনী বড়লেখা-বিয়ানীবাজার সড়কপথে চানগ্রাম বাজারের কাছে পাকবাহিনীর একটি টহলদার দলকে এ্যামবুশ করে। প্রায় এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর ৭ জন পাকসেনা পালিয়ে যায় এবং পাকসেনা ল্যান্সনায়েক মামুন আনসারী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। জামালপুরে মুক্তিবাহিনী পাকহানাদার বাহিনীর শক্ত ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর বিপুল অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও জানমালের ক্ষতি হয়। শেরপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধে একটি রক্তস্নাত অধ্যায়। এদিন নালিতাবাড়ি উপজেলার তন্মর গ্রামে পাক বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন ৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা। এরা হলেন নূর মোহাম্মদ, আনার আলী, কলিমউদ্দিন, জামাল, লালমিয়া মাঝি, জমিরুদ্দিন ও জবান আলী ফকির। কুমিল্লার উত্তর সাব সেক্টরে মুক্তিসেনাদের ঝটিকা আক্রমণে হরিমঙ্গল ও রাজপুরে শত্রু অবস্থানে মর্টার আক্রমণে যথাক্রমে ৮ জন ও ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। চট্টগ্রাম সেক্টরের করেরহাট, ফেনীতে মুক্তিফৌজ ও পাকসেনাদের মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। ৫ ঘণ্টা যুদ্ধে ৩৭ জন পাকসেনা ও ৫০ জন রাজাকার নিহত হয়। আক্রমণের চরম পর্যায়ে তারা একজন ক্যাপ্টেন, ২ জন জে সি ও হত্যা করে ও একজন মেজরের মাথাকেটে ফেলে তার মাথা বেইজে নিয়ে আসে। এক সময় শত্রুরা আত্মসমর্পণে প্রস্তুত ছিল কিন্তু কিছুক্ষণের ভিতরে সেখানে শত্রুদের আরও ২ প্লাটুন সেনা এসে হাজির হয়-কিন্তু তারা বেইজ থেকে সরে যায়। তখন তারা এদিকে সেদিকে পালাতে থাকে। গ্রামবাসীরা তাদের আক্রমণ করে। খুলনার তেরখাদায় রাজাকার, পাঞ্জাবী পুলিশ ও পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তিফৌজের যুদ্ধ হয়। প্রায় ৫৭ জন লোককে পাকবাহিনী হত্যা করে। এদিন ঢাকায় সামরিক শাসক ১৬২নং সামরিক আদেশ জারি করে। এই আদেশ বলে নতুন করে ৬নং সামরিক সেক্টর গঠন করা হয়। গাইবান্ধায় খন্দকার আজিজুর রহমান ও রইসউদ্দীনকে যথাক্রমে আহ্বায়ক ও সম্পাদক করে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট শান্তিকমিটি পুনর্গঠিত হয়। কুষ্টিয়া সদর মহকুমার কুমারখালী থানার পাল্টি গ্রামে রাজাকারদের গুলিতে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান টিভি সাক্ষাতকারে বলেন, বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করা হবে। ... জেনারেল ইয়াহিয়া বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালাচ্ছে বলে যে প্রচারণা চলছে তা জঘন্য মিথ্যা। সেখানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ক্ষুদ্র সংখ্যক সশস্ত্র বিদ্রোহী সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করে। তাদের উৎখাত করার জন্য সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিদ্রোহীদের দমন করতে অনেক সময় দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হয়। পৃথিবীতে এ রকম অনেক নজির আছে। ভারতের বাইরে সবচেয়ে বড় দল বেঁধে ‘ডিফেকশন’ (পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগের ঘটনা) হয় ওয়াশিংটন ডিসিতে। সেখানে একযোগে ১৪ জন কূটনীতিক ও স্টাফ একসঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। এই দলটির নেতৃত্ব দেন সৈয়দ আনোয়ারুল করীম। তিনি জাতিসংঘে পাকিস্তানের উপ-প্রধান প্রতিনিধি ও মিনিস্টার। দলে ছিলেন এনায়েত করীম। তিনি ছিলেন মিনিস্টার, ওয়াশিংটনস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের উপ-মিশন প্রধান। কাউন্সিলর শাহ এমএস কিবরিয়া, অর্থনৈতিক কাউন্সিলর আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিক্ষাবিষয়ক কাউন্সিলর সৈয়দ আবুল রশীদ মতীন উদ্দিন, দ্বিতীয় সচিব আতাউর রহমান চৌধুরী ও তৃতীয় সচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। তিনজন স্থানীয়ভিত্তিক কর্মকর্তা শরফুল আলম, শেখ রুস্তম আলী ও আবদুর রাজ্জাক খানও ছিলেন। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্তিসেনারা আজ শ্রীহট্ট রণাঙ্গনে কালচেরা টি এস্টেটের কাছে ৫০ জন পাকসেনাকে হত্যা ও ২ জনকে গ্রেফতার করেছে। মুক্তিফৌজ পাক বাহিনীর কাছ থেকে একটি মেশিন গান, একটি এল এম জি, ৬ টি রাইফেল, ১৮ হাজার কার্তুজ এবং বিপুল পরিমাণ খাদ্য দ্রব্য কেড়ে নিয়েছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিট কুমিল্লা অঞ্চলের শালদা নদীতে ৭টি দেশী নৌকায় অগ্রসররত পাকবাহিনীর গতিরোধ করে। এর ফলে ৯০ জন পাকসেনা নদীতে ডুবে মারা যায়। ২৮ জুলাই থেকে শুরু করে ৪ দিনে কুমিল্লার মন্দাভাগে ১০০ জনের বেশি পাকসেনা নিহত হয়েছে। ৩১ জুলাই গেরিলা বাহিনী কুমিল্লা জেলায় ২০ জন পাকসেনাকে খতম করেছে। ২৯ জুলাই নোয়াখালী জেলায় মুক্তিবাহিনী ও রাজাকারদের মধ্যে এক সশস্ত্র সংঘর্ষে ৮ জন রাজাকার নিহত হয়। এদের কাছ থেকে ২টি রাইফেল ছিনিয়ে নেয়া হয়। সকালে কুমিল্লার আখাউড়া রণাঙ্গনের কাছে সিঙ্গেরঝিল অঞ্চলে ১২ জন পাকসেনা নিহত ও মুক্তিবাহিনী ১২টি রাইফেল ও কিছু গোলাবারুদ ছিনিয়ে নেয়। গেরিলা বাহিনী কুমিল্লা জেলায় ২৫টি বিদ্যুত সরবরাহ যন্ত্র বিকল করে দেয়ায় সমগ্র জেলা ও ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট অন্ধকারাচ্ছন হয়ে যায়। সকালে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার মুজিব নগর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে কানিফ নগরে মুক্তিফৌজ ও পাকসেনাদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৭ জন নিহত হয়েছে। শ্রীহট্ট ফ্রন্টের সালুটিগড় বিমান ঘাঁটির কাছে গত ৩১ জুলাই মুক্তিফৌজ একটি মালবাহী বিমান গুলি করে ভূপাতিত করে। আমেরিকা কর্তৃক প্রদত্ত সি ১৩০ বিমানটি পাকিস্তান বিমান ঘাঁটি থেকে আকাশে উড়বার পর ২০০ ফুটের মধ্য দিয়ে যাবার সময় মুক্তিফৌজের কবলে পড়ে। অপর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির দাবিতে মঙ্গলবার গোটা পশ্চিমবঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়েছে। আজকের এই ছাত্র ধর্মঘটের উদ্যোগ দক্ষিণ-বাম সবকটি ছাত্র সংগঠনের। ছাত্র ধর্মঘটের পর ছয়টি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগঠন রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে একটি ছাত্র জমায়েত ডাকেন। সভার পর ছাত্ররা মিছিল করে রাজভবনের সামনে যায়। ছাত্র প্রতিনিধিরা রাজ্যপালের উদ্দেশ্যে একটি স্মারকলিপি দিয়ে চলে আসে। স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি-স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে ভারত সরকারের স্বীকৃতি দিতে হবে। ঢাকা থেকে সদ্য আগত এক শিল্পী এ সংবাদ দিয়ে বলেন ঢাকা নগরী এখন কাঁপছে। তিনি জানান হাঁটা পথে সবাই চলছে। লঞ্চগুলো দেখলে মনে হয় বুঝি জলে ডুবে যাবে তবু সৎ নাগরিকরা মুক্তি বাহিনীর আহ্বানে শহর ছেড়ে গ্রামে চলছে। ঢাকা বিমানবন্দরের তৎপরতা এখন স্তিমিত। দল বেঁধে সেনারা হাঁটে। সেটাও ভীতসন্ত্রস্ত ভাব। স্কুল-কলেজের দ্বার একটাও খোলেনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রাজাকার বাহিনীর ট্রেনিং ফিল্ড। বিকেলের পর রাজপথে সেনারা বের হয় না। মুক্তিবাহিনী ক্রমশ সাহসিকতার সঙ্গে ঢাকায় ভীষণ চাপ দিচ্ছে। ফলে সাধারণ নাগরিকরা আরও সক্রিয় হয়ে উঠছে। সম্প্রতি টেঙ্কু আব্দুর রহমানকে মুক্তি বাহিনীর ভয়ে ঢাকার প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দেয়া হয়নি। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×