ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ আরাফাত ময়দানে হজের দিন

প্রকাশিত: ০৯:০৪, ২ আগস্ট ২০১৯

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ আরাফাত ময়দানে হজের দিন

পবিত্র হজের প্রধান অনুশাসন পালন করা হয় ৯ যিলহজ আরাফা দিবসে আরাফাত ময়দানে অবস্থানের মধ্য দিয়ে। আরাফা মক্কার কাবা শরীফ থেকে প্রায় ৯ মাইল পূর্বে অবস্থিত। জোহর ওয়াক্তের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এই অবস্থান করতে হয় ইহরাম বাধা অবস্থায়। প্রিয় নবী (স)-এর একটা বিখ্যাত হাদিস আছে যে, আরাফা দিবসে আরাফাতে অবস্থান অর্থাৎ উকুফে আরাফাই হচ্ছে হজ। উল্লেখ্য, হজের ফরজ হচ্ছে তিনটি আর তা হচ্ছে ইহরাম বাধা, ৯ যিলহজ উকুফে আরাফা এবং ১০ যিলহজ মুযদালিফায় রাতযাপন করে দিবসে মিনায় এসে বড় শয়তানের কঙ্কর মারার পর কোরবানি শেষে মাথা মুন্ডন ও গোসল করে ইহরামমুক্ত হয়ে ওই দিন বা পরের দিন মিনা থেকে মক্কা মুকাররমা এসে কাবা শরীফ তওয়াফ করা। একে বলা হয় তওয়াফে ইফাদা অর্থাৎ ফিরতি তওয়াফ। একে তওয়াফে জিয়ারতও বলা হয়। ওই দিনই মিনায় ফিরে আসতে হয়। মিনাতে ১১ তারিখে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ার পর প্রথমে ছোট শয়তানকে একটি একটি করে সাতটি কঙ্কর মারার পর ওখান থেকে প্রায় ৫০ মিটার এগিয়ে গিয়ে মেজ শয়তানকে ওই একই নিয়মে পাথর মেরে ১৫০ মিটার মতো এগিয়ে গিয়ে বড় শয়তানকে কঙ্কর মেরে পেছন দিকে না তাকিয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে আসতে হয়। ওই একই নিয়মে ১২ তারিখেও তিন শয়তানকে কঙ্কর মেরে সূর্যাস্তের পূর্বেই মক্কা মুকাররমা চলে আসতে হয়। মক্কা শরীফ থেকে চলে আসার পূর্বে কাবা শরীফ তওয়াফ করতে হয়। একে বিদায়ী তওয়াফ বলে। মূলত ৯ যিলহজ্জ আরাফাত ময়দানে সূর্যাস্তের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত উকুফ বা অবস্থানের মধ্য দিয়ে হজের মুখ্য অনুষ্ঠান পালিত হয়। হজ অনুষ্ঠানের সূচনা হয় ৮ যিলহজ মক্কা মুকাররমা থেকে ইহরাম বাধা অবস্থায় মিনা আগমন করার মধ্য দিয়ে। আর সমাপ্তি ঘটে মিনা থেকে মক্কা মুকাররমায় ১২ যিলহজ সূর্যাস্তের পূর্বেই সামনের মধ্য দিয়ে। ৯ যিলহজ সকালে মিনা থেকে আরাফাতে যেতে হয় এবং জোহর ও আসরের সালাত জোহরের ওয়াক্তে ইমামের পেছনে আদায় করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করার মধ্য দিয়ে হজের মূল উদ্দেশ্যের পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটে। লাখ লাখ মানুষ একই পোশাকে, একই উচ্চারণে একই অনুভব আপ্লুত হয়ে আরাফাতের ময়দানকে সে যে কি এক অদৃশ্যের অবতারণা করে তা ভুলবার নয়। সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরাফাত থেকে তখন হাজীগণ যখন মুযদালিফার উদ্দেশে রওনা দেন তখন তারা সদ্য জন্মগ্রহণকারী শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যান। আরও বলা হয়েছে আরাফাতে একজন হাজীর হজ কবুল হলেই সমস্ত হাজীর হজ কবুল হয়ে যায়। হাদিস শরীফে আছে যে, আলহাজ ইয়াওমাল আরাফা-আরাফা দিবসই হচ্ছে হজ অর্থাৎ আরাফাতে অবস্থান করাটাই হচ্ছে হজ। হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও মা হাওয়া আলাইহাস সালাম জান্নাত থেকে পৃথিবীতে এসে প্রায় সাড়ে ৩শ’ বছর ধরে আল্লাহর নিষেধ সত্ত্বেও নিষিদ্ধ ফল একেবারেই ভুলক্রমে ফেলার কারণে সেই ভুল ক্ষমা করে দেয়ার জন্য ‘রব্বানা জালামনা-আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফিরলানা ওয়াতারহামনা লানা কুনান্না মিনাল খাসিরিন’Ñ এই দোয়া পড়ে রাতদিন অবিরত কাঁদতে থাকেন। একদিন দশই মহরম আল্লাহ জাল্লাশানুহু প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (স)-এর উসিলায় তাদের তওবা কবুল করলে তারা যে স্থানে এসে দীর্ঘদিন পর মিলিত হন সেই বিশাল প্রান্তরই আরাফাত ময়দান। আরাফাত শব্দের অর্থ পরস্পর পরিচিত হওয়া। জানা যায় যে, এই আরাফাত ময়দানকে প্রয়োজনমাফিক বিস্তীর্ণ করে এখানেই হাশরের ময়দান হবে। আল্লাহ জাল্লা শানুহুর মহান আরশকে এখানেই স্থাপন করা হবে এবং এখানেই আল্লাহ জাল্লা শানুহু সবার বিচার করবেন। তিনদিকে পাহাড় ঘেরা ময়দান এই আরাফাত। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে এই বিশাল খোলা ময়দানে প্রচুর নিমগাছ লাগানো হয় যা কয়েক বছরের মধ্যে বেড়ে ওঠে। উল্লেখ্য, এই ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দেই বর্তমান লেখক প্রথম হজ পালন করেন। তারপর বহুবার হজ করেছেন। এখন আরাফাত ময়দান এক ছায়াঘন বিস্তীর্ণ এলাকা। এই ময়দান দৈর্ঘ্যে প্রায় ৬ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ৬ কিলোমিটার। মক্কা মুকাররম থেকে আরাফাত ১৫ কিলোমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত। আরাফাত ময়দানের এক প্রান্তে একটি ২০০ ফুট উঁচু পাহাড় আছে। পূর্বকালে এই পাহাড় আরাফাত পাহাড় নামে পরিচিত ছিল। পরে এর নামকরণ হয় জাবালে রহমত অর্থাৎ রহমত পর্বত। এই ময়দানের পশ্চিম প্রান্তে নামিরা নামক স্থানে পূর্বকালে একটি মসজিদ ছিল। সেই মসজিদ স্থাপন করেছিলেন হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম। কিন্তু কালক্রমে সেই মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলীন হয়ে যায়। উল্লেখ্য, মক্কার হাশেমী বংশের ওপর এসব রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব থাকলেও তাঁরা এবং কোরাইশ বংশের অন্যরা আভিজাত্য বজায় রাখার অজুহাতে হজের সময় আরাফাতে না এসে মুযদালিফায় এসে অবস্থান করত। মক্কা মুকাররমার বাইরের চলাফেরা হজের দিবসে আরাফাতে এসে সূর্য ডুবে গেলে মুযদালিফায় এসে রাতযাপন করত। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আভিজাত্যের বড়াই উৎখাত করে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ যিলহজ শুক্রবার মিনা থেকে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার হজ পালনরত সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে আরাফাত ময়দানে এলেন এবং হযরত ইব্রাহিম আলায়হিস সালামের মসজিদ যেখানে ছিল সেখানে কালো কম্বলের তাঁবু স্থাপন করলেন এবং সূর্য একটু পশ্চিমে চলে গেলে কাসওয়া নামক উস্ট্রির পিঠে সওয়ার হয়ে খুতবা দিতে দিতে জাবালে রহমতের দিকে এগোতে লাগলেন। খুতবাতে তিনি যে সব বাণী রাখছিলেন তা জোরে জোরে বেশ কয়েকজন সাহাবি উচ্চারণ করে অন্যদের কাছে পৌঁছিয়ে দিচ্ছিলেন। এমনিভাবে তিনি জাবালে রহমতের চূড়াতে এসে দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশে বললেন আল্লাহ যদি কিয়ামতের দিন আমার সম্পর্কে তোমাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন তাহলে তোমরা কি সাক্ষ্য দেবে? এই কথা শুনে সেই ১ লাখ ৪০ হাজার সাহাবি সমস্বরে বলে উঠলেন : হে আল্লাহর রসূল। আমরা সাক্ষ্য দেব যে, আল্লাহ আপনার নিকট যে দায়িত্ব প্রদান করেছেন আপনি তা যথাযথভাবে পালন করেছেন। কথা শুনে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আবেগতাড়িত কণ্ঠে উপরের দিকে শাহাদত অঙ্গুলি তুলে বললেন হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। এরপর জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে বললেন, আল বিদা, আল বিদা, এমন সময় নাজিল হলো, আল ইওয়ামা আকমাতুল লাকুম দীনাকুম, ওয়া আতমামতু আলায়কুম নিমাতি ওয়া রাদীতুলাকুমুল ইসলামা দীনা- আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করলাম, আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি সম্পন্ন করলাম এবং তোমাদের দীন ইসলামকে সানন্দে অনুমোদন দান করলাম। (সূরা মায়িদা : আয়াত-৩)। সেই দিনকার সেই খুতবায় তিনি প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে যে কথাগুলো বলেছিলেন তা মানবতাকে যুগে যুগে উজ্জীবিত করে আসছে। তিনি তার সেই ভাষণে সমগ্র মানব জাতিকে সম্বোধন করে বলেছিলেন কোন অনারবের ওপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোন আরবের ওপর কোন অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোন কালোর ওপর কোন সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোন সাদার ওপর কোন কালোর শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সবাই আদম থেকে আর আদম মাটি থেকে। উল্লেখ্য, ইব্রাহিম মসজিদ যেখানে ছিল সেখানে বিশাল মসজিদ নির্মিত হয়েছে যার নাম মসজিদে নামিরাত। কুরআন মজিদে ৯ যিলহজ দিবসে আরাফাত ময়দানে উকুফ সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে আরাফাত ত্যাগ করে মুযদালিফায় খাবার নির্দেশ রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : - যখন তওয়াফের জন্য ফিরে আসবে আরাফাত থেকে, তখন মাশআরুল হারাম (মুযদালিফায় অবস্থিত পাহাড়)-এর নিকট পৌঁছে আল্লাহর যিকর করবে এবং তিনি যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন ঠিক সেই ভাবেই তাকে স্মরণ করবে। (সূরা বাকারা আয়াত-১৯৮) হজ বিশ্ব মানবতার ঐক্যের প্রতীক যা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন ৯ জিলহজ আরাফাত ময়দানে। এ এক অনন্য মিলন ব্যবস্থা যা আল্লাহ জাল্লা শানুহু নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে- এই গৃহে সেই সব মানুষের হজ করা অবশ্য কর্তব্য যাদের সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে। (সূরা আল ইমরান আয়াত-৯৭) এখানে বলা প্রয়োজন যে জীবনে একবারই হজ করা ফরজ, তবে বার বার যাদের হজ করার সামর্থ্য আছে সে হজ করাটা নফল ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম একবারই হজ করেন যা, হাজ্জাতুল বিদা, বা বিদায় হজ, হাজ্জাতুল ইসলাম হাজ্জাতুল বালাগ নামে পরিচিত। আরাফাত ময়দানে হজের দিনে লাখ লাখ আল্লাহ প্রেমিকের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক লাব্বায়েকা লা শারিকা লাকা লাব্বায়েক ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়ামাতা লাকওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর দরবার শরীফ
×