ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে উপচেপড়া ভিড়

যে কোন জ্বরে আক্রান্ত হলেই ডেঙ্গু টেস্ট না করিয়ে যেন স্বস্তি নেই

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ১ আগস্ট ২০১৯

যে কোন জ্বরে আক্রান্ত হলেই ডেঙ্গু টেস্ট না করিয়ে যেন স্বস্তি নেই

নিখিল মানখিন ॥ ডেঙ্গু টেস্ট এবং টেস্টের রিপোর্ট দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকারী হাসপাতালগুলো। বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে এই চাপ তুলনামূলকভাবে কম। সরকারী হাসপাতালে বিনামূল্যে ডেঙ্গু টেস্টসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়ে থাকে। ফলে রাজধানীর প্রতিটি সরকারী হাসপাতালে ডেঙ্গু টেস্ট করাতে আগতদের ভিড় লেগেই আছে। ডেঙ্গু টেস্ট প্রার্থীদের সংখ্যা হাসপাতালের জনবলের সামর্থ্যরে কয়েকগুণ বেশি হওয়ায় সঠিক সময়ে টেস্ট রিপোর্ট দিতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আর বিভাগীয় শহরের বাইরে উপজেলা পর্যায়ে জ্বরে আক্রান্তদের ডেঙ্গু টেস্টের ব্যবস্থা না থাকার অভিযোগ উঠেছে। সরকার ডেঙ্গু টেস্ট ফি নির্ধারণ করে দেয়ায় প্রত্যেকে টেস্ট করাতে উৎসাহিত বোধ করছেন। তবে ডেঙ্গু টেস্ট করাতে সরকার নির্ধারিত ফি’র বেশি টাকা নেয়ায় ইতোমধ্যে রাজধানীর বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। জ্বর হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার বিষয়ে ইতোমধ্যে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। আর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পর প্রত্যেক রোগীকেই ডেঙ্গু টেস্ট করানোর বিষয়টি উল্লেখ করে প্রেসক্রিপশন দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ যে কোন জ্বরে আক্রান্তদের কেউই ডেঙ্গু টেস্ট না করিয়ে নিজেকে নিরাপদ মনে করছেন না। ফলে প্রতিটি সরকারী- বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গু টেস্ট করানোর জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন জ্বরে আক্রান্তরা। বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল সরেজমিন ঘুরে ডেঙ্গু টেস্ট প্রার্থীদের প্রচ- ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যেন দাঁড়ানোর ঠাঁই নেই। ডেঙ্গু রোগীর পাশাপাশি ডেঙ্গু টেস্ট করাতে আসা রোগীদের ভিড়ে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। ডেঙ্গু টেস্ট করাতে আসা শতাধিক মানুষের লম্বা লাইন। মহিলাদের লাইনে দাঁড়ানো একজন হলেন সালমা আক্তার (৩৪)। তার ছয় বছরের শিশু মোঃ বেলালের জ্বর। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, দেড় ঘণ্টা হয়েছে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন । তিনি শিশুটিকে প্যারাসিটামল খাইয়েছেন, কিন্তু জ্বর রয়ে গেছে। দেড় দিন ধরে এমন অবস্থা চলছে। কষ্ট হলেও লাইনে দাঁড়িয়ে সন্তানের ডেঙ্গু টেস্ট করিয়ে যাবেন বলে জানান সালমা আক্তার। একটু এগিয়ে দেখি ডেঙ্গু টেস্টের রিপোর্ট প্রদানের জায়গাতেই লম্বা লাইন। অনেক রোগীর স্বজনদের রিপোর্ট পেতে ভোগান্তি চরমে উঠেছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সামনে এগুতেই দুই দিক থেকে প্যাথলজি বিভাগের সামনে লম্বা দুটি লাইন। রোগীর স্বজনরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট পেতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে গরমে ঘামছেন, অপেক্ষা করছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এর মধ্যে কেউ রিপোর্ট পাচ্ছেন কেউ বা পাচ্ছেনই না। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকার ডেঙ্গু টেস্টের ক্ষেত্রে সরকারী হাসপাতালে ফি ফ্রি ঘোষণার পর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চাপ বেড়েছে অনেকগুণ। যে কারণে লম্বা সিরিয়ালে যেমন রোগী কিংবা রোগীর স্বজনদের দাঁড়াতে হচ্ছে, তেমনি প্যাথলজি বিভাগেও বেড়েছে ব্যস্ততা। একই জনবলে অসংখ্য রিপোর্ট ডেলিভারি দেয়া অসাধ্য হয়ে পড়েছে। রিপোর্ট প্রস্তুত হওয়ার পরই তা রোগীদের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান প্যাথলজি বিভাগের লোকজন। এদিকে, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালেও ডেঙ্গু রোগীর উপচেপড়া ভিড়। বুধবার ১নং ওয়ার্ডের রোগী আব্দুল জব্বার মিয়া (৩৭) জনকণ্ঠকে জানান, তার ছেলে মোঃ সোহরাব (১৩) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত তিনদিন ধরে হাসপাতালে। এখানে আসার পর জ্বর কমলেও প্রেসার কমেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে তার ছেলে মুখে খাবার নিচ্ছে বলে জানান আব্দুল জব্বার। এভাবে রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র ডেঙ্গু টেস্ট করানোর হিড়িক পড়ে গেছে। ডেঙ্গু টেস্ট করিয়ে মনের ভয় দূর করছেন কেউ কেউ। এতে অনেকগুণ চাপ বেড়েছে সরকারী হাসপাতালগুলোর ওপর। ডেঙ্গু টেস্ট রিপোর্ট প্রদানে হিমশিম খাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বুধবার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক উত্তম কুমার বড়ুয়া জনকণ্ঠকে জানান, নির্ধারিত রোগী শয্যার বাইরেও মেঝ, করিডোর ও জরুরী বিভাগের কোথাও নতুন ডেঙ্গু রোগী রাখার জায়গা নেই। তবু আমরা কোন ডেঙ্গু রোগীকেই ফিরিয়ে দিচ্ছি না। বর্তমানে হাসপাতালে ২৮১ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন নতুন রোগী যুক্ত হয়। এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬শ’ ডেঙ্গু রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন । তিনি আরও জানান, ডেঙ্গু টেস্ট করতে আসা রোগীদের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নেই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। প্রতিদিন শত শত মানুষ জ্বর নিয়ে টেস্ট করাতে আসছেন। এছাড়া সরকার ডেঙ্গু জ্বরের টেস্ট ফি ঘোষণার পর জ্বরে আক্রান্ত মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে হাসপাতালে। আমাদের স্বল্প জনবলে এই পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা মেশিনের যে ধারণ ক্ষমতা বা সক্ষমতা তাও কখনও কখনও অতিরিক্ত চাপে আউট অব অর্ডার হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে প্রতিদিনের রিপোর্ট প্রতিদিন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এটা শুধু আমাদের এই হাসপাতালেই নয় প্রায় সব হাসপাতালের চিত্র প্রায় একই। আমরা স্বাস্থ্য অধিদফতর বরাবর চিঠি লিখছি। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে যেন অতিরিক্ত জনবলের দ্রুত ব্যবস্থা করা হয়। ডেঙ্গু টেস্ট রিপোর্ট তাড়াতাড়ি দেয়ার জন্য ডিউটির নির্ধারিত সময়ের বাইরেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট লোকজন কাজ করছেন। কঠিন অবস্থার মধ্যেও এখন পর্যন্ত সাধারণ রোগীদের পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাসেবা সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখতে পেরেছি বলে জানান পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ উত্তম কুমার বড়ুয়া। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ঢাকা শিশু হাসপাতালে স্থাপন করা হয়েছে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার। এখানে ডেঙ্গু টেস্টের রিপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে খুব বেশি বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য সর্বক্ষণিক মশারি টাঙ্গিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে ভর্তিচ্ছু রোগীর বেশ চাপ রয়েছে। টেস্ট করানোর জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন কল্যাণপুর এলাকার বাসিন্দা মোঃ নজরুল মিয়া (৩৭)। তিনি গাড়ি মেরামতের দোকানে কাজ করেন। গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি থানায়। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, দু’দিন ধরে তার শরীরে জ্বর এসেছে। শরীরের তাপমাত্রা ১০২ ওঠার পর এখন ১০০ এর নিচে চলে এসেছে। কিন্তু ডেঙ্গুর জীবাণু থাকা, না থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য টেস্ট করাতে তিনি এসেছেন। ডেঙ্গু টেস্টের জন্য ৫০০ টাকা নেয়া হচ্ছে বলে জানান নজরুল মিয়া। ডেঙ্গু টেস্টেও রিপোর্ট হাতে নিয়ে হাসিমুখে ফিরে যাচ্ছেন মিরপুর পাইকপাড়াবাসী জুলেখা বেগম (২৯)। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, জ্বর আসার পর খুব চিন্তায় ছিলেন তিনি । এখন তার খুব ভাল লাগছে। তার ডেঙ্গু ধরা পড়েনি বলে জানান জুলেখা বেগম। ওয়ান স্টপ সার্ভিস থাকার কারণে ডেঙ্গু টেস্ট এবং ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসাসেবা সন্তোষজনকভাবে চলছে উল্লেখ করে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ সফি আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, হাসপাতালে ১৩৪ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। রোগী ও ডেঙ্গু টেস্ট করাতে আসা জ্বরে আক্রান্তদের চাপ রয়েছে। হাসপাতালে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু হয়েছে। আগতদের সঙ্গে সঙ্গে টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট ধরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আর সব ধরনের ডেঙ্গু রোগীদের এই হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয় না। তুলনামূলকভাবে ভাল অবস্থায় থাকা ডেঙ্গু আক্রান্তদের বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। জটিল ডেঙ্গু রোগীদের সিট দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি আরও জানান, জ্বর নিয়ে ডেঙ্গু টেস্ট করাতে আসা রোগীদের শতকরা ১০ ভাগ ডেঙ্গু শনাক্ত হয়ে থাকে। জ্ব¦র হলেই প্রত্যেকে টেস্ট করাতে ছুটে আসছেন। আজ (বুধবার) দেড়টা পর্যন্ত টেস্ট করাতে আগত ৫০ জনের মধ্যে মাত্র ৭ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে বলে জানান ডাঃ সৈয়দ সফি আহমেদ। এভাবে শুধু ঢাকা শিশু হাসপাতাল নয়, রাজধানীসহ সারাদেশেই জ্বরে আক্রান্তদের ডেঙ্গু টেস্ট করানোর হিড়িক পড়ে গেছে।
×