ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

অমূল্য নিদর্শন হয়ে জাদুঘরে

ওস্তাদ গুল মোহাম্মদের তানপুরা, ৮০ বছরের পুরনো সাধনযন্ত্র

প্রকাশিত: ০৯:৫৮, ২৮ জুলাই ২০১৯

ওস্তাদ গুল মোহাম্মদের  তানপুরা, ৮০ বছরের  পুরনো সাধনযন্ত্র

মোরসালিন মিজান ॥ তানপুরাটি অনেকেই দেখেছেন। দেখে থাকবেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায় এটি বিশেষ দৃশ্যমান হয়েছে। উচ্চাঙ্গসঙ্গীত অনুষ্ঠানের শুরুতে কিংবা শেষে ড্রাগনমুখো তানপুরাটির ওপরই ফ্রিজ করা হতো ক্যামেরা। সেই ছবি নিশ্চয়ই অনেকে মনে রেখেছেন। তবে স্বতন্ত্র কারুকাজের জন্য নয়, তানপুরাটির সঙ্গে জুড়ে আছে ওস্তাদ গুল মোহাম্মদের মতো কিংবদন্তির নাম, এই নামের কারণেই বাদ্যযন্ত্রটিকে অমূল্য জ্ঞান করা হয়। উপমহাদেশের বরেণ্য উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিল্পী, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মহান সাধক এটি বাজাতেন। বহুকাল ধরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংরক্ষিত হওয়ার পর সম্প্রতি জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি নিদর্শন। কনজারভেশনের কাজ শেষে তানপুরাটিকে বাদ্যযন্ত্র গ্যালারিতে যুক্ত করা হবে। শুদ্ধ সঙ্গীতের কিংবদন্তি শিল্পী, তার নিবেদন এবং অর্জনের ইতিহাস আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এ যন্ত্র ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। জাদুঘরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে জানা যায়, মহান শিল্পীর নিত্যসঙ্গী ছিল এই তানপুরা। তাঁর সন্তানরাও এটি ব্যবহার করেছেন। সবশেষে ব্যবহার করেছেন নাতি নাতনিরা। তার চেয়ে বড় কথা, গুল মোহাম্মদের কাছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের তালিম নেয়া একাধিক খ্যাতিমান শিল্পী তানপুরাটি বাজিয়েছেন। এর পর থেকে পরিবারের সদস্যরাই বাদ্যযন্ত্রটি সংরক্ষণ করে আসছিলেন। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি হস্তান্তর করা হয় জাতীয় জাদুঘরে। গুল মোহাম্মদের নাতি আনসার উদ্দিন খান ও নাতনি ফারজানা নওশীন খানের কাছ থেকে অমূল্য নিদর্শন গ্রহণ করেন জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি হাশেম খান ও মহাপরিচালক মোঃ রিয়াজ আহম্মদ। তানপুরাটি কালচে খয়েরি রঙের। নিচের দিকের গঠন খুব চেনা। অর্ধবৃত্তাকার লাউয়ের তুম্বা। তুম্বার ওপরে ফাঁপা কাষ্ঠদন্ড। বেশ লম্বা এই কাষ্ঠদন্ডে চারটি কাঠের চাবি দৃশ্যমান। চাবিগুলোর প্রতিটির সঙ্গে একটি করে তার প্যাঁচানো আছে। লাউয়ের খোলের মধ্যস্থলে একটি সেতু বা সওয়ারী। এটি হাতির দাঁতে তৈরি বলে জানা যায়। সওয়ারীর ওপর দিয়ে তারগুলো খোলের নিচের অংশে এসে যুক্ত হয়েছে। ছুঁয়ে দিলে এখনও বাজে। তবে ওপরের দিকের গঠন সম্পূর্ণ আলাদা। দ-টির মাথায় ড্রাগনমূর্তি। হা করা মুখ। চোয়ালে চারটি দাঁত। এগুলোও হাতির দাঁত দিয়ে গড়া বলে শিল্পী পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এক জোড়া চোখও দৃশ্যমান। জাদুঘরের বাদ্যযন্ত্র গ্যালারি ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে থাকা তিনটি তানপুরার কোনটির সঙ্গে এই বাদ্যযন্ত্রের মিল নেই। গুল মোহাম্মদের তানপুরাটিকে তাই খুব সহজেই আলাদা করা যায়। স্বতন্ত্র গঠন বৈশিষ্ট্যের কারণে আকর্ষণও করে খুব। গুল মোহাম্মদ খানের তানপুরা গ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ছিলেন জাদুঘরের উপ-কিপার আসমা ফেরদৌসী। এই কর্মকর্তা বেশ যত্নের সঙ্গে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তিনি জানান, অনেক পুরনো হলেও তানপুরাটি বেশ ভাল অবস্থায় পাওয়া গেছে। এর দৈর্ঘ্য ১৩৮ সেন্টি মিটার। খোলের তলার ব্যাস ৩২ সেন্টি মিটার। তানপুরাটির মূল কাঠামো এক হলেও, সচরাচর দেখা তাপুরাগুলো থেকে এটি স্পষ্টতই আলাদা। বিশেষ করে ড্রাগনের অনুকৃতি থাকায় কৌতূহলী চোখে তানপুরাটির দিকে তাকাতে হয় বলে জানান তিনি। তানপুরাটির বাকি ইতিহাস জানতে কথা হয় গুল মোহাম্মদের নাতি আনসার উদ্দিন খানের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই বাসায় তানপুরাটি দেখে এসেছি। রেডিও টেলিভিশনে পারফর্ম করার সময় দাদা এটি সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। আমিও তার সঙ্গে অনেকবার গিয়েছি। দাদার মৃত্যুর পর বাবা ইয়াসিন খান এটি বাজিয়েছেন। বর্তমানে নিজের বয়স ৫০ বছর জানিয়ে তিনি বলেন, সে হিসাবে তানপুরাটির বয়স কমপক্ষে ৮০ বছর হওয়ার কথা। গুল মোহাম্মদ খানের আরেক নাতনি ফারজানা নওশিন খান বিন্দিয়া। নিজেও শিল্পী। হয়ত তাই নিদর্শনটি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অনেক বেশি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এটি আমার দাদাজীর শেষ স্মৃতিচিহ্ন। বাবাকে দেখেছি বিভিন্ন রাগের ওপর সুর বাঁধছেন। আমি নিজেও এই তানপুরা দিয়ে রেওয়াজ করেছি। তার চেয়ে বড় কথা তানপুরাটিকে বহু বছর আগলে রেখেছি। জাদুঘরে দেয়ার সময় তাই খুব কষ্ট হচ্ছিল। নিজের সবচেয়ে বড় আক্ষেপের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, তানপুরাটি নিয়ে আমি কোন স্টেজে উঠতে পারিনি। এই আক্ষেপ সারাজীবন রয়ে যাবে। তবে জাদুঘরে দান করায় এটি যথাযথভাবে সংরক্ষিত হবে, সাধারণ মানুষ দেখতে পাবেন-এই ভেবে ভাল লাগছে বলে জানান তিনি। জাদুঘরের জাতিতত্ত্ব ও অলঙ্করণ শিল্পকলা বিভাগের কিপার নূরে নাসরীন জানান, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তানপুরাটি ল্যাবে পাঠিয়ে দেয়া হবে। কনজারভেশনের কাজ হবে সেখানে। জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন ৭ আগস্ট এটি বাদ্যযন্ত্র গ্যালারিতে ডিসপ্লে করা হতে পারে এই তানপুরা। জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ রিয়াজ আহম্মদ বলেন, আমাদের দেশকে বলা হয় গানের দেশ। সেই গান সেই সুরের ঐতিহ্য জাদুঘরের গ্যালারিতে আমরা তুলে ধরেছি। ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খানের তানপুরা বাদ্যযন্ত্র গ্যালারিটিকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। গুল মোহাম্মদ ছিলেন ধ্রুপদ ও খেয়াল ধারার অগ্রগণ্য শিল্পী। রাগ পুরিয়া, ধানেশ্রী, রাগ বাগেশ্রী, মালকোষ, ও মূলতানীসহ কয়েকটি খেয়াল ও রাগের প্রতি ছিল তার বিশেষ দুর্বলতা। উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক জলসায় সঙ্গীত পরিবেশন করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সঙ্গীত প্রতিভার গুণে মাত্র ১৯ বছর বয়সে ভূপাল স্টেটের নবাব নসরুল্লাহ্ খান বাহাদুরের নিয়মিত সভা গায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন। পিতা ওস্তাদ আহমদ খাঁ ছিলেন দ্বারভাঙ্গা মহারাজার সভাগায়ক। পিতামহ ওস্তাদ নামদার খাঁও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে সম্মানের আসন নিয়েছেন। পিতার নিকট গুল মোহাম্মদের সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয়। পরে পিতা ও পিতামহের কাছে তিনি ঐতিহ্যবাহী ‘ডাগর’ ঘরানায় সঙ্গীত শিক্ষাগ্রহণ করেন। ভারতের আগ্রায় থাকাকালে আগ্রা ঘরানায়ও পারদর্শিতা লাভ করেন। পারিবারিক সূত্র জানায়, ১৯১০ সালে সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন গুল মোহাম্মদ। তৎকালীন ঢাকার নবাব ও ভাওয়ালের রাজার আহ্বানে ঢাকায় আসেন তিনি। সে সময় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে খেয়ালের প্রচলন থাকলেও, অত বিস্তার ঘটেনি। গুল মোহাম্মদ এই সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। বহু শিল্পী তৈরি করে গেছেন তিনি। লায়লা আরজুমান্দ বানু, ফেরদৌসী রহমান, রওশন আরা মুস্তাফিজ, উৎপলা সেন, দীপালি নাগ, প্রতিভা বসুর মতো খ্যাতিমানদেরও শিক্ষক ছিলেন তিনি। ১৯৩৬ সালে ঢাকায় অল ইন্ডিয়া রেডিওর ঢাকা কেন্দ্র চালু হয়। এদিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুরিয়া রাগ শুনিয়ে মুগ্ধ করেন গুল মোহাম্মদ। ১৯৩৯ সালে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও উচ্চাঙ্গসঙ্গীত পরিবেশন করেন। ঢাকা বেতারে সঙ্গীত শিক্ষক ও শিল্পী হিসেবে অনেক অনুষ্ঠান করেছেন। অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৮ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করা হয় তাকে।
×