ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জলজট নিরসনে গতি নেই নতুন প্রকল্পেও

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ২০ জুলাই ২০১৯

জলজট নিরসনে গতি নেই নতুন প্রকল্পেও

ওয়াজেদ হীরা ॥ একটু বৃষ্টিতেই ডুবে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার রাস্তাঘাট, অলিগলি। বৃষ্টি থামলেও পানি নামতে সময় লাগছে কয়েক ঘণ্টা। অনেক এলাকার নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভাল না হওয়ায় পানি থাকছে সড়কেই। সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে ঢাকাবাসীর এবারের বর্ষা নিয়ে শঙ্কা বেড়েছে। সেই সঙ্গে রাজধানীর জলজট নিরসনে নেয়া নতুন প্রকল্পে গতি না থাকায় আশঙ্কা বেড়েছে আরও কয়েকগুণ। এই পরিস্থিতিতে ভরা বর্ষায় কাদাবৃষ্টির জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থাকছেই। জনগণকে সুবিধা দিতে নানা উন্নয়ন প্রকল্প নিচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। আর সরকারের এক শ্রেণীর কর্মকর্তার গাফিলতিতে প্রকল্পে গতি আসছে না। ফলে সরকারের যেমন দুর্নাম হচ্ছে তেমনি ভোগান্তি বাড়ছে মানুষের। এ অবস্থায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি নিয়েও নগরবাসীর প্রশ্নের অন্ত নেই। বর্ষায় রাজধানীবাসীর তিক্ত এক অভিজ্ঞতার নাম জলাবদ্ধতা। সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার দীর্ঘ ভোগান্তি পোহানো নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীবাসীকে জলজট থেকে মুক্তি দিতে ’১৮ সালের শুরুর দিকে দু’টি প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা ওয়াসা। আলোর মুখ দেখার আগেই প্রকল্প দু’টি বাতিল করে একই বছরের মাঝামাঝিতে নেয়া হয় আরেকটি প্রকল্পের উদ্যোগ, যা আগামী বছরের শেষ নাগাদ বাস্তবায়নের সময় থাকলেও এখন পর্যন্ত অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি। ফলে নতুন প্রকল্পটির ভবিষ্যত নিয়েও তৈরি হয়েছে শঙ্কা। শিক্ষার্থী রায়হান মুন্না থাকে হাজারীবাগে। অল্প বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় তার বসবাসের এলাকার গলি। রিক্সা না পেলে প্যান্ট হাঁটুর উপরে তুলে যেতে হয় স্কুলে। একই এলাকার বাসিন্দা খাদিমুল হোসেন বলেন, আমরা পত্রপত্রিকা পড়ে জেনেছিলাম এ বছর বর্ষায় ভোগান্তি থাকবে না। সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় পানি যাতে দ্রুত নেমে যেতে পারে এজন্য নানা কাজ হচ্ছে, কিন্তু অল্পবৃষ্টিতে যে রূপ দেখছি তা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। নগরের অন্য এলাকার বাসিন্দারাও জলজট নিয়ে ভাল মন্তব্য করেনি। শঙ্কা নিয়ে রায়েরবাজারে একাধিক বাসিন্দা প্রশ্ন তোলেন উন্নয়নের জন্য সরকারের দেয়া টাকা উন্নয়নে লাগানো হচ্ছে কি না? অনেকেই এটাও জানতে চান একটি শহরের জলাবদ্ধতা দূর করতে সংস্থাগুলোর কেন বছরের পর বছর লেগে যাচ্ছে? অনেক বাসিন্দা ক্ষোভে এ বিষয়ে কথাও বলতে চাননি। বাসিন্দাদের ছুড়ে দেয়া বিভিন্ন প্রশ্ন ও জলাবব্ধতা নিয়ে ক্ষোভ স্পষ্টই জানান দেয় ঢাকাবাসী ভাল নেই। বর্ষা এলে সন্তানদের স্কুলে আনা-নেয়া কিংবা অফিস আদালতে যাওয়া আসাসহ নিজের যে কোন প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে নানা ভোগান্তিই পোহান। অনেকেই এসময় প্রয়োজনীয় কোন বাহনও পাননা। রাজধানীর জলজট নিরসনে ’১৮ সালের শুরুর দিকে ‘হাজারীবাগ-বাইশটেকী, কুর্মিটোলা, মান্ডা ও বেগুনবাড়ি খালে ভূমি অধিগ্রহণ এবং খনন/পুনর্খনন’ এবং ‘কল্যাণপুর স্টর্ম ওয়াটার পাম্পিং স্টেশনসংলগ্ন রেগুলেটিং এ্যান্ড সংরক্ষণ (ফেজ-২)’ প্রকল্পের উদ্যোগ নেয় ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু প্রকল্প দুটি বাতিল করে একই বছরের জুনে ‘ঢাকা মহানগরীর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং খাল উন্নয়ন’ নামে নতুন একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এক বছর সময় পেরিয়ে গেলেও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ার অজুহাতে প্রকল্পের অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি। ৫৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ঢাকার ৫২ লাখ মানুষকে জলজট থেকে মুক্তি দেয়া। আর অগ্রগতি কম হওয়ায় এবারের বর্ষায়ও রাজধানীবাসীর জলজটের আশঙ্কা বেড়েছে। জানা যায়, নতুন করে নেয়া প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ’২০ সালের ডিসেম্বরে। অথচ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ৩২ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ২৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ওয়াসা সূত্র জানায়, মহানগরীর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং ১৬ খাল উন্নয়নের মাধ্যমে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, শঙ্কর, ঝিগাতলা, রায়েরবাজার এবং ঢাকা উত্তরের মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, শেরেবাংলা নগর, দারুসসালাম, মিরপুর, পল্লবী, ক্যান্টনমেন্ট, উত্তরা বিমানবন্দর এলাকার জলাবদ্ধতা দূর করাই প্রকল্পের প্রধান কাজ। এছাড়া প্রকল্প এলাকায় অবস্থিত বিদ্যমান খালগুলো খনন ও প্রশস্ত করে তীর উন্নয়ন এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে খালের দুই তীরের পরিবেশ উন্নত করা। এসব এলাকায় ১৬ খাল উন্নয়ন করে পাড় বাঁধার কাজ এখনও অধরা রয়ে গেছে। সে হিসেবে প্রকল্পের প্রধান কাজ এখনও শুরু হয়নি। সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় ঢাকা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে বর্ষা মৌসুমে জলজট সৃষ্টি হয়ে যানবাহন ও মানুষের চলাচলে যাতে ব্যাহত না হয়, তা নিশ্চিত করা হবে। এছাড়া প্রকল্প এলাকায় বসবাসরত মানুষের পানিবাহিত স্বাস্থ্যঝুঁকি লাঘব, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সর্বোপরি মহানগরীর স্বাস্থ্যসম্মত গুরুত্বপূর্ণ খালের ভূমি অধিগ্রহণ করে খালগুলো খননের গভীরতা ও প্রশস্ততা বৃদ্ধি, যাতে বর্ষা মৌসুমে নগরীর বৃষ্টির পানি ও গৃহস্থালি বর্জ্য সহজেই খাল দিয়ে নদীতে নিষ্কাশিত হতে পারে। ঢাকা মহানগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ১৫১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ৪৪ খাল, ১০ বক্স কালভার্ট ও বিভিন্ন সংস্থার কয়েক হাজার কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে ১৬ খাল খনন ও পাড় বাঁধা ‘ঢাকা মহানগরীর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং খাল উন্নয়ন’ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। ঢাকা ওয়াসা সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় ২০১৮-১৯ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) মাত্র ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। যে কারণে প্রকল্পে অগ্রগতি কম। অথচ বর্ষা এলেও প্রকল্পের অগ্রগতি না থাকায় এই সময়ে জলাবদ্ধতায় পড়তে পারেন রাজধানীর ওসব এলাকার মানুষ। শুধু তাই নয় নির্ধারিত সময় ’২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন নিয়েও দেখা গেছে শঙ্কা। প্রকল্পের পরিচালক শওকত মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এটা ঠিক যে বরাদ্দ পাওয়া টাকার অঙ্কটা কম। এজন্য প্রকল্পে অগ্রগতি কম। বরাদ্দ বেশি পেলে প্রকল্প সঠিক সময়ে শেষ হতে পারে সে কথাও শোনান কেউ কেউ। এদিকে, প্রতিবছরই জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগে পড়েন ঢাকাবাসী। আষাঢ়ের শেষভাগে এসে ২৮ আষাঢ় রাজধানীতে ৫০ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। প্রায় দিনব্যাপী থেমে থেমে বৃষ্টিতে বিভিন্ন এলাকায় তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ২৯ আষাঢ়ও বৃষ্টিতে ডুবে যায় রাজধানীর অনেক সড়ক। ড্রেন থেকে আবর্জনা উঠে সয়লাব হয়ে গেছে পুরো সড়ক, অলিগলি। এতে নগরীর বড়-ছোট সড়ক থেকে অলিগলিগুলোতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। সামনের দিনগুলো কেমন হবে সেটি নিয়ে এখনই ভাবতে শুরু করেছেন নগরবাসী। ঢাকা ওয়াসা সূত্র জানায়, রাজধানীর ১৫ খালের ২০ কিলোমিটার ও ৩০০ কিলোমিটার স্টর্ম ওয়াটার ড্রেন পরিষ্কার করা হয়েছে। চারটি স্থায়ী ও ১৫ অস্থায়ী পাম্পের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি অপসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। এদিকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ড্রেনগুলো পরিষ্কার করছে। তবে দুই সিটি কর্পোরেশনই বলছে, ওয়াসাকে পানি নিষ্কাশনের জন্য পাম্পের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। না হলে এবারও নগরীতে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। সম্প্রতি, ডিএসসিসি সংশ্লিষ্টরা তাদের ড্রেনগুলো পরিষ্কার করতে গিয়ে জানতে পারেন, ঢাকা ওয়াসার নিকাশী ব্যবস্থায় ঢাকা দক্ষিণের ৩০ স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে। এ নিয়ে একটি প্রতিবেদনও তৈরি করেছে তারা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলাবদ্ধতার কারণে ১৬ ওয়ার্ডের বাসিন্দারা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। অথচ এ নিয়ে ঢাকা ওয়াসা এখনও কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এ বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। তাদের ড্রেনের কারণে যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়, আমরা তার একটা তালিকা করে ঢাকা ওয়াসাকে দিয়েছি। আমাদের ড্রেনগুলো পরিষ্কার করতে গিয়েই মূলত ঢাকা ওয়াসার যেসব ড্রেন খুবই খারাপ অবস্থায় আছে সেসব জানতে পারি। পরবর্তীতে এর আর অগ্রগতি আমাদের জানানো হয়নি। আর ওনারা (ওয়াসা) কখনও যোগাযোগও করে না, আমরাই যোগাযোগ করি। দক্ষিণ সিটির ড্রেন বিষয়ে প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা বলেন, দেখুন আমাদের ড্রেনগুলো এবার বেশ ভাল অবস্থায় আছে। গত শুক্র শনিবার এত ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ার পরও দেখা গেল এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যেই পানি নেমে গেছে। আমরা সারাবছরই দুই থেকে আড়াই মাস পর পর সবগুলো ড্রেন পরিষ্কার করতে আদেশ দেই। আমাদের অধীনে মোট ৯৬১ কি.মি ড্রেন, যা পরিষ্কার করতে একটু সময় লাগে বলে দুইমাস পরপর আদেশ দেয়া হয়। ওয়াসা সূত্র জানায়, এবারের বর্ষায় রাজধানীতে যেন জলাবদ্ধতা না হয়, সেজন্য গত বছর ১৭ খালের ৩০ কিলোমিটার পুনর্খনন করা হয়েছে। পানি যেন দ্রুত ড্রেন দিয়ে নেমে যেতে পারে, এজন্য ৩শ’ কিলোমিটার স্টর্ম ওয়াটার ড্রেন পরিষ্কার করা হয়েছে। রাস্তার পানি যেন দ্রুত ড্রেনে ঢুকতে পারে, সেজন্য ৭০০ ক্যাচপিট (নালার ওপরের ছিদ্রযুক্ত ঢাকনা) পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সবার সহযোগিতায় জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি। প্রতিবছর বর্ষায় আশার বাণী না শুনিয়ে এর স্থায়ী সমাধান চান রাজধানীবাসী। সরকারের টাকা যথাযথ উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার হচ্ছে কি না তারও তদারকি প্রত্যাশা করেন তারা। সেই সঙ্গে আগামী বছর থেকে জলাবদ্ধতা নিয়ে আর যেন কোন কষ্ট সইতে না হয় এটাই চান তারা।
×