ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

না’গঞ্জে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন বেড়েছে

প্রকাশিত: ১০:২৪, ৬ জুলাই ২০১৯

 না’গঞ্জে ধর্ষণ ও  যৌন নির্যাতন  বেড়েছে

মোঃ খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ ॥ নারায়ণগঞ্জে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা। রেহাই পাচ্ছে না শিশু ছাত্রীরাও। গত ২৭ জুন থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে পৃথক দুটি স্থানে স্কুলশিক্ষক ও মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকের লালসার শিকার হয়েছে অন্তত ৩২ কোমলমতি শিশুছাত্রী। ওই দুই ভয়ঙ্কর শিক্ষকের বিরুদ্ধে ৩২ শিশু ছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। যা এলাকার অভিভাবক ও এলাকাবাসীর মধ্যে চরম ক্ষোভ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে এসব এলাকার স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্রীদের অভিভাবকরা। ফতুল্লার মাহমুদপুরের বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা আল-আমিন শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হননি। অনেক শিশু ছাত্রীর ছবি তুলে মাথার অংশ কেটে নগ্ন ছবির সঙ্গে লাগিয়ে শিশু শিক্ষার্থীদের প্রতারণা করে পুনরায় ধর্ষণ করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সিদ্ধিরগঞ্জের অক্সফোর্ড হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক আরিফুল ইসলাম কমপক্ষে ২০ ছাত্রীকে ব্ল্যাকমেইলিং করে ও আপত্তিকর ছবি তুলে ভয়ভীতি দেখিয়ে অসহায় শিক্ষার্থীদের অসংখ্যবার ধর্ষণ করেছে। এছাড়াও একই জেলার সদর, সোনারগাঁও, রূপগঞ্জ, বন্দর ও আড়াইহাজার থানা এলাকার বিভিন্ন স্থানেও গণধর্ষণ, পালাক্রমে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ছাত্রী, শিশু, গার্মেন্টস কর্মী ও গৃহবধূসহ নানা বয়সী নারী। নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্টজন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা ধর্ষণের ঘটনার প্রতিরোধে অভিভাবকদের আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২নং ওয়ার্ডের সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি কান্দাপাড়া এলাকার অক্সফোর্ড হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক আরিফুল ইসলাম আপত্তিকর ছবি তুলে ও গোপন ভিডিও ধারণ করে কয়েক বছর ধরে অন্তত ২০ ছাত্রীকে ব্ল্যাকমেইলিং করে একেক শিক্ষার্থীকে একাধিকবার ধর্ষণ করে আসছিল। গত ২৪ জুন শিক্ষক আরিফুল ইসলাম স্কুলের নবম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীকে টার্গেট করে তাকে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রস্তাব দেয়। ওই শিক্ষার্থী বিষয়টি তার বাবা মা ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জানায়। পরে তারা বিষয়টি র‌্যাব-১১ কার্যালয়ে অবহিত করলে র‌্যাব-১১ -এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আলেপ উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি টিম ২৭ জুন বৃহস্পতিবার স্কুলে অভিযান চালিয়ে ওই শিক্ষক আরিফুল ইসলাম ও তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগে একই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম জুলফিকারকেও গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় ডিএডি আব্দুল আজিজ বাদী হয়ে ডিজিটাল আইসিটি আইনে শিক্ষক আরিফুল ইসলাম ও প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলামের নামে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় শিক্ষক আরিফুল ইসলামকে আসামি করে মামলা রুজু করেন। ধর্ষক আরিফুল ইসলাম স্কুলের পাশের একটি ভবনের তিন কক্ষ বিশিষ্ট ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া নিয়ে ছাত্রীদের কোচিং পড়ানোর নামে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন করতেন। যা আবার ভিডিও ধারণ করে কোন কোন শিক্ষার্থীর মাকেও ব্ল্যাকমেইলিং করে ধর্ষণ করত। এ ঘটনার রেস কাটতে না কাটতেই একই এলাকার কিছু দূরে ফতুল্লার ভূঁইঘরের মাহমুদপুরের পাকা রাস্তার বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক আল-আমিনের বিরুদ্ধে ১২ শিশু ছাত্রী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠে। এ ঘটনায় প্রধান শিক্ষক মাওলানা আল-আমিনকে ১২ শিশু ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগে গত ৪ জুলাই (বৃহস্পতিবার) র‌্যাব-১১ সদস্যরা গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ফতুল্লা থানায় আইসিটি ও নারী ও শিশু দমন আইনে দুটি মামলা দায়ের করা হয়। গ্রেফতারকৃত মাদ্রাসার শিক্ষক আল-আমিনের শাস্তির দাবিতে এলাকাবাসী বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ সময় তারা ওই শিক্ষকের ফাঁসির দাবিতে নানা ধরনের সেøাগান দেয়। এ দুটি ঘটনায় মাত্র ২ থেকে ৩ হাজার ফুট দূরের ঘটনা। বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসাটি মাহমুদপুরের পাকা রাস্তায় অবস্থিত। যা সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লা থানার সীমানা ঘেঁষা। এ দুটি ঘটনায় এলাকাবাসী দিনদিন ফুসে উঠছে। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে তাদের স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসায় পড়ুয়া সন্তানদের নিয়ে। তাদের একটাই কথা শিক্ষক হলো মানুষ গড়ার কারিগর। তারাই যদি এ ধরনের ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের মতো এত জঘন্যতম অপরাধ করতে পারে তবে আমাদের কোমলমতি শিশু সন্তানরা কোথায় গিয়ে শান্তিতে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। এদিকে ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জের স্কুল ও মাদ্রাসায় ৩২ ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা ছাড়াও ইদানীং নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন থানা এলাকায় বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনাও। সোনারগাঁয়ে এক নারী জামদানি কারিগরকে একাধিকবার ধর্ষণের ঘটনায় ২ জুলাই সোনারগাঁও থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। অবশ্য এ ঘটনায় পুলিশ মামলার প্রধান আসামি ইউসুফ আলীকে গ্রেফতার করে। ওই নারী জামদানি কারিগরকে ইউসুফ আলী গত বছর ধরে ধর্ষণ করে আসছিল। আবার সিদ্ধিরগঞ্জের ওমরপুরের আইয়ুবনগর এলাকা থেকে ৭ম শ্রেণীর এক ছাত্রী (১২) ও তার চাচাত বোন (১৭) কে ফুসলিয়ে অপহরণ করে ২০ দিন আটক রেখে ধর্ষণ করে দুই বন্ধু আল-আমিন ও রিয়াদ। এ অভিযোগে গত ২২ জুন সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করা হয়। গ্রেফতার করা হয় আল-আমিন ও রিয়াদকে। গত ২১ জুন সোনারগাঁয়ের ইমানের কান্দি এলাকায় কুয়েত প্রবাসীর স্ত্রীকে এক বখাটে ধর্ষণ করে। আবার আড়াইহাজারের নাগেরচর এলাকায় মাদ্রাসার এক ছাত্রী (১৩) কে রাতভর ধর্ষণ করে রাকিব নামে এক বখাটে। গত ১ জুন বন্দরের সাবদী এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে এসে দুই গার্মেন্টস কর্মী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ অভিযুক্ত ৬ জনকে গ্রেফতার করে। গত ২৭ মে রূপগঞ্জের তারাব এলাকা একটি স্পিনিং মিলের নারী শ্রমিক (১৬) কে নাঈম হোসেন, বাদশা মিয়া ও হাবিবুর রহমান পালাক্রমে ধর্ষণ করে। অবশ্য পুলিশ ওই ঘটনায় তিনজনকেই গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। এভাবেই নারায়ণগঞ্জে ইদানীং বেড়েছে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা। ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুই শিক্ষকের ৩২ ছাত্রী ধর্ষণ ও নির্যাতনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সমাজের বিশিষ্টজনরা অভিভাবকদের আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ বিষয়ে র‌্যাব-১১ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আলেপ উদ্দিন বলেন, ধর্ষণের ঘটনা নৈতিক বিচ্যুতির কারণে ঘটছে। শিক্ষক সমাজ কিংবা সাধারণ মানুষ হোক না কেন এটা তার ব্যক্তিগত দায়ভার। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হচ্ছে সামাজিক সচেতনা বাড়াতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যেমন আমাদের কাছে ভিকটিম কিংবা অভিভাবক যদি গোপনে সংবাদটি প্রেরণ করেন তবে আমরা অভিভাবক ও ভিকটিমের তথ্য গোপন রাখি। আমাদের ফেসবুক রয়েছে। আমাদের যোগাযোগের নম্বরগুলো বিভিন্ন জায়গা দেয়া হয়েছে। সামাজিকভাবে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। কারণ আমরা কারও পরিচয় প্রকাশ করি না। যেহেতু পরিচয় আমরা প্রকাশ করি না, সেহেতু তারা নির্ভয়ে আমাদের কাছে আসতে পারেন এবং তথ্য দিতে পারেন। সিদ্ধিরগঞ্জের অক্সফোর্ড হাইস্কুল ও ফতুল্লার বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসার ৩২ ছাত্রীকে যৌন হয়রানির যে তথ্য আমরা পেয়েছি। তা একদিনে ঘটেনি। প্রথম যে শিশুটি নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সেই শিশুটি যদি ঘটনাটি বলে দিতো। আইনশঙ্খলাবাহিনী যদি ব্যবস্থা নিতো। তাহলে এতগুলো ঘটনা ঘটত না। বাংলাদেশ মানবাধিকার কাউন্সিলের নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি এ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান মাসুম বলেন, ধর্ষণের ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। লজ্জার বিষয় যে শিক্ষকরা তাদের নৈতিকতা হারিয়েছে ও অসভ্যতার পর্যায়ে চলে গেছে। একজন দুজন শিক্ষক আজ এতগুলো শিক্ষক সমাজের কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীর এক ছাত্রী তার মাকে বলছে, তাদের প্রিন্সিপাল এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে। এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক বিষয়। আমরা মনে করি অভিভাবকদের উচিত কোচিং পরিহার করা। কোচিং সেন্টার খুলে শিক্ষকরা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সারাদিন কোচিং করায় এটা অভিভাবকদের মেনে নেয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থা আরও পরিবর্তন আনা উচিত। মাদ্রাসাগুলো অভিভাবকদের নিয়ে একটি মনিটরিং কমিটির ব্যবস্থা করা উচিত। সেখানে তারা প্রতিনিয়ত দেখবে। সর্বোপরি আজকে বাংলাদেশের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে। চারদিকে ধর্ষণ বেড়ে গেছে। মেয়েরা একেবারে নিরাপদ না। মেয়েরা বাসের চালকের কাছে নিরাপদ না, এমনকি শিক্ষকের কাছেও নিরাপদ না। তাহলে বাসের চালক ও শিক্ষকের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? এ ধরনের অপারাধী মানুষগুলোকে শাস্তি দিতে হবে। অভিভাবকদের আরও সচেতন হওয়াই প্রধান কাজ। নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এবি সিদ্দিক বলেন, ধর্ষণের আইন পরিবর্তন করা উচিত। যদি অপরাধী ধর্ষণের ঘটনা স্বীকার করে তবে এর সঙ্গে সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল করে দ্রুত বিচার করে তাদেরকে ফাঁসি দিতে হবে। এতে ধর্ষণের ঘটনায় কমে আসবে। একেবারেই শূন্যের কোঠায় চলে আসবে। ফতুলল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জের ঘটনাটি এখানে বিন্দু মাত্র ছাড় না দিয়ে ফাঁসির ব্যবস্থা না হলেও অতিদ্রুত যাবজ্জীবন সাজা দিতে হবে এবং অপরাধীর সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ওই সম্পত্তি ধর্ষণের শিকার পরিবারগেুলো দিতে হবে। অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে। অভিভাবকরা মাদ্রাসা ও স্কুল কলেজে তাদের সন্তানদের পাঠিয়ে বসে থাকলে চলবে না। তারা সেখানে কি করছে কোন হেনস্তার শিকার হচ্ছে কিনা খোঁজ-খবর নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, স্কুল বা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকেও নিরাপরাদ মনে করে বিনা দোষে ছেড়ে দেয়া উচিত নয়। তাদেরকেও আইনের আওতায় আনতে হবে।
×