ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

সমাজ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী

প্রকাশিত: ০৯:৪২, ২ জুলাই ২০১৯

 সমাজ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি  জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী

মনোয়ার হোসেন ॥ সেগুন বাগিচার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার চতুর্থতলা। নজরে আসে বিশাল এক বৃক্ষ। সবুজের বদলে গাছের পাতায় লেগেছে সাদা রং। সেসব পাতার ফাঁক গলে প্রতিটি ডাল ধরে ঝুলছে অসংখ্য কাচের বয়াম। সেসব বয়ামে যেন বন্দী হয়ে আছে লতা-পাতায় আবৃত সবুজের সমারোহ। কোন বয়ামের ভেতর থেকে আবার উঁকি মারছে কংক্রিটের বহুতল অট্টালিকা। স্থাপনাশিল্পটির শিরোনাম রুদ্ধশ্বাস। ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়নের প্রভাবে সংকুচিত হওয়া প্রকৃতির সঙ্গে পরিবেশ দূষণের বার্তা মেলে শিল্পকর্মটিতে। এটির ঠিক উল্টোদিকেই শূন্যে ঝুলছে শরীরজুড়ে গোলাপের ছবি আঁকা কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার। মেঝেতে রাখা সাদা বোর্ডে সারি বাঁধা কয়েকটি চুলা। সাম্প্রতিক দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আহত ও নিহত মানুষদের স্মরণ করিয়ে ফায়ার দ্যাট ব্রিংস ডার্কনেস শীর্ষক স্থাপনাশিল্পটি। সমকালীন ঘটনাপ্রবাহকে ধারণ করা এমন অনেক শিল্পসম্ভার এখন ছড়িয়ে আছে চিত্রশালার কয়েকটি গ্যালারিজুড়ে। দর্শকের চোখের সামনে ভেসে উঠছে শিল্পের সঙ্গে বাস্তবতার যোগসূত্র। অধিকাংশ কাজেই আছে তরুণ ও প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীদের নিরীক্ষাধর্মিতার ছাপ। চারপাশের পরিবেশসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে গড়া হয়েছে বেশ কিছু শিল্পকর্ম। সব মিলিয়ে বিশ্বব্যাপী চারুশিল্পের পরিবর্তনশীল গতি-প্রকৃতির আভাস মেলে। এভাবেই নতুনের জয়গান গেয়ে শুরু হলো ২৩তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী। শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত প্রদর্শনীটির সূচনা হয় সোমবার। চিত্রশালার দুই, চার, পাঁচ ও ছয় নং গ্যালারির সঙ্গে ভাস্কর্য গ্যালারি এবং প্লাজাতে সজ্জিত হয়েছে সারাদেশের শিল্পীদের নির্বাচিত শিল্পকর্মসমূহ। একুশ দিনের শিল্প সফরে দর্শকরা দেখতে পাবেন ৩১০ শিল্পীর ৩২২টি শিল্পকর্ম। বিচিত্র শিল্পরেখায় উজ্জ্বল প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমের ১৫৯টি চিত্রকলা, ৪৫ ভাস্কর্য়, ৫০টি ছাপচিত্র, ১৭ কারুশিল্প, ৮টি মৃৎশিল্প, ৩৭টি স্থাপনাশিল্প ও ভিডিও আর্ট । সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৭টি পারফরমেন্স আর্ট। সোমবার বিকেলে চিত্রশালা মিলনায়তনে প্রদর্শনীর উদ্বোধনের পাশাপাশি বিজয়ী শিল্পীদের পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ও বরেণ্য চিত্রকর মনিরুল ইসলাম। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভিাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক শিল্পী আশরাফুল আলম পপলু। উদ্বোধনী আয়োজনে আটটি বিভাগে পুরস্কার প্রদান করা হয়। সব মাধ্যমের ভেতর থেকে নির্বাচিত একটি শিল্পকর্মকে শ্রেষ্ঠ বিবেচনায় প্রদান করা হবে দুই লাখ টাকা মূল্যমানের শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার কামরুজ্জামান। ভাস্কর্য বিভাগের এক লাখ টাকা মূল্যমানের শিল্পকলা একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার পেয়েছেন তানভীর মাহমুদ। এক লাখ টাকা মূল্যমানের ছাপচিত্র, চিত্রকলা ও স্থাপনাশিল্পী বিভাগে সম্মানসূচক পুরস্কার পেয়েছেন যথাক্রমে রুহুল করিম রুমী, রাফাত আহমেদ বাঁধন ও সহিদ কাজী। এক লাখা টাকা মূল্যমানের বেঙ্গল ফাউন্ডেশন পুরস্কার উত্তর কুমার তালুকদার। কুড়ি হাজার টাকা মূল্যমানের দীপা হক পুরস্কার পেয়েছেন সুমন ওয়াহিদ। ৫০ হাজার টাকা মূল্যমানের চিত্রশিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেন পুরস্কার পেয়েছেন ফারিয়া খানম। প্রদর্শনীর শ্রেষ্ঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত কামরুজ্জামানের শিল্পের শিরোনাম ‘গ্লোবাল ওয়ামিং-২’। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট সংকটের চিত্র উঠে এসেছে লিথোগ্রাফ মাধ্যমে চিত্রিত শিল্পীর চিত্রপটে। চলার পথে নারীর প্রতিবন্ধকতাকে চিত্রপটে মেলে ধরেছেন ফারিয়া খানম তুলি। তার আঁকা ছবির শিরোনাম ‘প্রতিবিম্ব-৪’। বহুমাত্রিক জটিলতায় আবদ্ধ জীবনের গল্পকে ক্যানভাসে মেলে ধরেছেন উত্তম কুমার তালুকদার। পাটের স্বর্ণালি অতীত হারিয়ে যাওয়ার আক্ষেপময় সহিদ কাজীর চিত্রকর্মের শিরোনাম সোনালি আঁশ। আতিয়া ইসলাম এ্যানি, শারদ দাস ও সোমা সুরভী শিল্পের আলোকে প্রতীকীভাবে মেলে ধরেছেন সমাজ বাস্তবতার চিত্র। চিত্রকর্ম ও আলোকচিত্রের সম্মিলনে সৃষ্ট স্থাপনায় ঢাকার বাস্তবতার নান্দনিকা প্রকাশ ঘটিয়েছেন কুন্তল বাড়ৈ। ভিডিও আর্টের মাধ্যমে জগৎ ও জীবনের তাৎপর্যের সন্ধান করেছেন পলাশ ভট্টাচার্য। প্রদর্শনালয়ের দেয়ালে লেপটে থাকা বোর্ড থেকে বেরিয়ে আসা তারের ওপর অসংখ্য কাকের উপস্থিতিময় আবার বসন্ত নামের দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা গড়েছেন সাইদুল হক জুইস। মিশ্র মাধ্যমে বীজের গল্প বলেছেন ফারেহা জেবা। ধাবমান পৈশাচিক উল্লাস শিরোনামে ভাস্কর্য গড়েছেন ভাস্কর রাসা। একাত্তরে বাঙালীর ওপর চালানো পাকবাহিনীর গণহত্যার ভয়াল ও মর্মস্পর্শী অধ্যায়টি উঠে এসেছে এই ভাস্কর্যে । সীমাবদ্ধতার যন্ত্রণা নামের ভাস্কর্য উপস্থাপন করেছেন আরেক ভাস্কর হাবিবা আখতার পাপিয়া। অন্তরতর কথন শীর্ষক সিরিজের মাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন মোঃ আমিনুল ইসলাম। চকবাজার চুড়িহাট্টা অগ্নিকা-ের ভয়াবতা উঠে এসেছে বিপুল কুমার মালোর কাজে। মিনি করিমের ক্যানভাসে ধরা দিয়েছে সুন্দরবন। সুমনা হককে খুঁজে পাওয়া যায় রং ও রেখা শীর্ষক চিত্রপটে। শিশুবেলার স্মৃতিতে ক্যানভাস সাজিয়েছেন সামিনা নাফিজ। অনন্যা দাসের শিল্পের শিরোনাম প্রকৃতি ও নারী। এছাড়া বিশিষ্ট শিল্পীদের মধ্যে সিদ্ধার্থ দে, ঋতেন্দ্র কুমার শর্মা, সুলতানুল, ইসলাম, সুফিয়া বেগম, বিশ্বজিৎ গোস্বামীর নানা আঙ্গিকের শিল্পকর্মে সজ্জিত হয়েছে প্রদর্শনী। এর বাইরে জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীর তেইশতম আয়োজনে আউট অব মাইন্ড, হিউম্যানিটি, আমার পুনর্জন্ম, মানবদেহ পাখিতে রূপান্তর, তৈল সমাচার ও প্রেমপত্র শীর্ষক ছয়টি পারফরমেন্স আর্ট নিয়ে হাজির হয়েছেন ছয় শিল্পী। এই পারফরমেন্স আর্টিস্টরা হলেন রুবাইয়া সাওম দীনা, সৌরভ সাহা প্রেম, এস এম রিয়াদ, নাজমুল হোসেন, সুমনা আক্তার ও সুজন মাহাবুব। সোমবার থেকে সূচনা হওয়া একুশ দিনব্যাপী প্রদর্শনীটি শেষ হবে ২১ জুলাই। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা ও শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
×