ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কবীর চৌধুরী তন্ময়

দক্ষ মানবসম্পদই ঘুচাবে বেকারত্ব

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ৩০ জুন ২০১৯

 দক্ষ মানবসম্পদই ঘুচাবে বেকারত্ব

খুব ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে। আসলেও কি তাই? বাংলাদেশে লেখাপড়া জানাশোনা বা শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের বর্তমান প্রেক্ষাপট কী- এটি জানার চেষ্টা করতে গিয়ে গুগলসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণার প্রতিবেদনগুলো জানার ও বুঝার চেষ্টা করেছি। সেই সঙ্গে অর্থনীতির প-িতদের সঙ্গেও টেবিল-টক করেছি। অনেকের সঙ্গে আমিও আশাবাদী। আমিও স্বপ্ন দেখি, বিশ্বকে জয় করার সাহস রাখি। একটা সময় ছিল বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বা রাষ্ট্র বলা হতো। আবার অনেকে এটাও বলেছেন যে, বাংলাদেশ কোনমতে তার ভূখন্ড ও জনগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা সম্ভব হবে না। ওইসব অর্থনীতির প-িতরা হয়তো সে সময় ভুলে গিয়েছিল, বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে জন্মলাভ করেছে। ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখেরও বেশি নারীর সম্ভ্রম বিনাশ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। আমাদের আছে হিমালয় পর্বতের চেয়েও উচ্চ চূড়ার ব্যক্তিত্বের অধিকারী, বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো নেতা, সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো পরিকল্পনাবিদ, রাজনীতির কবি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পরে অনেকেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, এই জাতি আর মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। আর তাই ১৯৭৬ সালে ‘বাংলাদেশ : এ টেস্ট কেইস অব ডেভেলপমেন্ট’ বই-এ নরওয়ের অর্থনীতিবিদ ড. জাস্ট ফ্যালান্ড ও ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জ্যাক আর পারকিনসন তাদের মতামতে বলেন, ‘এই অবস্থা থেকে বাংলাদেশ যদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পারে, তাহলে দুনিয়ার যে কোন দেশই উন্নত হতে পারবে।’ এই আশঙ্কা শুধু বিদেশী অর্থনীতিবিদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তখন গোটা বিশ্বের সঙ্গে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রনায়ক ও আমাদের বিশেষজ্ঞদের মাঝেও এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশ কিভাবে এগিয়ে যাবে, কার নেতৃত্বে উন্নয়ন করবে- এ নিয়ে জ্ঞানী-গুণী-পন্ডিত বিশেষজ্ঞরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আর সেই সুবাদে পাকিস্তান তার ভাবধারায় বাংলাদেশ পরিচালিত করার সুযোগ লুফে নিয়েছিল তারই অদৃশ্য খোলসের প্রতিনিধি দিয়ে। তখনকার সময়ে অনেকে শুধু ভাবতেই পারেনি বরং মনে করারও চেষ্টা করেনি যে, বঙ্গবন্ধুর পবিত্র রক্তকণিকায় জন্ম নেয়া শেখ হাসিনা সব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে মৃত্যুর বুলেটের সামনে একদিন বাংলাদেশে আসবে এবং বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে একদিন নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুও নির্মাণ করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে আজকের উন্নত বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরবে। শেখ হাসিনার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রথমপর্ব বিশ্লেষণ করে ওই অর্থনীতিবিদ দীর্ঘ ৩১ বছর পর তাদের আগের বক্তব্য সংশোধন করে বলেছে, ‘বাংলাদেশ সীমিত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে।’ আবার তাদের মতই বিশ্বের অন্য বিশেষজ্ঞরাও বাংলাদেশ বিপুল উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে- এ কথা স্বীকার করেছে। আর তাই প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্ট ২০১২ সালের ৩ নবেম্বর ‘আউট অব দ্য বাস্কেট’ শিরোনামে এক নিবন্ধে বলেছে, ‘কী করা যায়, সেটা দেখিয়ে দেয়ার মডেলে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। কী করে উন্নয়নের মডেলে পরিণত হওয়া যায়, সেটা দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।’ আবার ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের প্রথম দিকে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুও বলে গেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন উড়ন্ত সূচনার পর্যায়ে রয়েছে। বিনিয়োগ বাড়লে প্রবৃদ্ধি হবেই। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২৯ শতাংশের সমপরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে। এটা সুন্দর ভবিষ্যতের একটি সংকেত। কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, শিগগিরই এশিয়ার নতুন বাঘ হিসেবে আবির্ভূত হবে বাংলাদেশ।’ অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মনে করেন, শুধু বিনিয়োগ বাড়াতে পারলেই ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ সংস্থা জেপি মর্গান বাংলাদেশকে ‘ফ্রন্টিয়ার ফাইভ’ বা প্রান্তিক দেশগুলোর মধ্যে অগ্রগামী পাঁচ দেশের একটি হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, ‘২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার সব ধরনের সম্ভাবনাই বাংলাদেশের রয়েছে’। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী সংস্থা ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিলও তাদের পূর্বাভাস দিয়েছে, ‘২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশসহ নেক্সট ইলেভেনভুক্ত (নেক্সট ১১) দেশগুলোর অর্থনীতি ইউরোপের ২৭ দেশের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে’। আর লন্ডন থেকে প্রকাশিত বিশ্বখ্যাত ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার মতে, ‘অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে ২০৫০ সাল নাগাদ’। আমি মনে করি, বাংলাদেশের এই বিপুল সম্ভাবনার পেছনে আমাদের তরুণ-তরুণীদের কাজে লাগাতে হবে। ২০৪০ সাল পর্যন্ত দেশী, বিদেশী কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক যুব শ্রমশক্তির ওপর ভর করে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছানোর সুযোগ রয়েছে আমাদের। আর এই যুব শ্রমশক্তির জন্য বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ- এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। তবে, বাংলাদেশে অন্যান্য জটিল সব সমস্যার মাঝে বর্তমানে বেকার বা কর্মহীন সমস্যা প্রকট হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো। বাংলাদেশে যত লোক বেকার, তাদের মধ্যে প্রতি ৫ জনের ২ জনই উচ্চমাধ্যমিক কিংবা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে সারাদেশে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার বেকার লোক আছে। তারা সপ্তাহে ১ ঘণ্টাও কাজের সুযোগ পাচ্ছে না। উচ্চমাধ্যমিক পাস তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ১৫ শতাংশ। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ৬ লাখ ৩৮ হাজার তরুণ-তরুণীরাও কোন কাজ পাচ্ছে না। কিন্তু তারা পড়াশোনা নয়, কাজ করতে আগ্রহী। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়ে ৪ লাখ ৫ হাজার লোক এখনও নিজেদের পছন্দ মতো কাজের সন্ধান পায়নি। স্নাতক ডিগ্রীধারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ১১ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে শুধু পড়াশোনা করার সুযোগ পায়নি- এই ধরনের মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম, যার সংখ্যা ৩ লাখ। তারা কিছু একটা করে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে নিজেকে এবং তাদের পরিবারকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, প্রাথমিক পাস করা বেকার সংখ্যা ৪ লাখ ২৮ হাজার। প্রাথমিক পাস করাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২ দশমিক ৭ শতাংশ। মাধ্যমিক পাস বেকারের সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ। তবে মাধ্যমিক পাস করাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অনলাইনে চাকরির বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান ‘বিডিজবস’ থেকে জানা যায়, চাকরি প্রার্থীরা প্রতিদিন প্রায় ৪০০ জীবনবৃত্তান্ত দিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানে রেজিস্ট্রেশন করছে। ১ মাসে প্রায় ৭ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়ে। আর একটি চাকরির বিজ্ঞাপন দিলেই তাতে প্রতিদিন অন্তত ৩ হাজারের উপরে আবেদন জমা পড়ে। যাদের বেশিরভাগই উচ্চশিক্ষিত। একটি অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, আমাদের দেশে শিক্ষিতরা আবার যেনতেন কাজ করতে চায় না। মেশিন চালানোর মতো কাজেও শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর মাঝে অনীহা দেখা যায়। তাদের সকলের একাডেমিক শিক্ষা সনদ থাকলেও অনেকে আবার ওই শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কারণ, ওইসব শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মাঝে দক্ষতা খুব বেশি একটা দেখা যায় না। দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেকে চাকরির দরখাস্ত পর্যন্ত করতে পারে না। আর তাই চাকরিদাতা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় চাকরি দিয়ে বোঝা তৈরি করতে চায় না। ২০১৯-২০ অর্থবছরে শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা খাতে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এখানে শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, শিক্ষা বাজেট বাস্তবায়নের জন্য মনিটরিং করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। একটা কথা প্রায়ই শুনি- অলস মস্তিষ্কে শয়তানের বসবাস। যার প্রতিফলন দেখছি নারী থেকে শিশু পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না ওইসব বিকৃত মস্তিষ্ক চিন্তাধারা ও শারীরিক ধর্ষণ থেকে। কথায় কথায় রাম দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যার মহাউৎসবে মেতে আছে আমাদের কতিপয় তরুণ। সেই সঙ্গে একদিকে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে মাদক গ্রহণ, অন্যদিকে কাঁচা টাকার প্রয়োজনে মাদক ব্যবসাসহ নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী জনশক্তিকে মানবসম্পদে রূপান্তর করতে পারলে, ভাষা ও কর্মদক্ষ করে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে তাদের কর্মসংস্থান ও বেতন নিশ্চিত করা সম্ভব হলে সামাজিক অবক্ষয় রোধসহ মানুষের মাঝে মানুষের সম্প্রীতির বন্ধনও তৈরি করা সহজ হয়ে পড়বে। কর্মব্যস্ততা আর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী মানুষকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। স্বপ্ন দেখতে ও বাস্তবায়ন করতে মানুষ উদ্যোমী হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনার পরিকল্পনায় ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তিগত ও কারিগরি শিক্ষা, ভোকেশনাল ট্রেনিংসহ মানবসম্পদ উন্নয়নে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে কাজ করলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে আমাদের তরুণ-তরুণীরা মুক্ত হয়ে নতুন নতুন কর্মসংস্থানও নিজেরা সৃষ্টি করতে পারবে আমার বিশ্বাস। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)
×