ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভেজাল খাদ্য তৈরির কারখানার সন্ধান

কাপড়ের বিষাক্ত রং দিয়ে বানানো হয় গুড় আর ট্যাং

প্রকাশিত: ১০:৪০, ১৫ জুন ২০১৯

 কাপড়ের বিষাক্ত রং দিয়ে বানানো হয় গুড় আর ট্যাং

রিয়াজউদ্দিন জামি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ॥ দেখে মনে হবে সুস্বাদু গুড়। রং আর গন্ধ অতুলনীয়। গুড়ের সুদৃশ্য প্যাক আর হাঁড়ি দেখলে যে কোন মানুষ মুগ্ধ হবে। খাওয়ার লোভ হবে। কিন্তু সেই গুড়ে নেই স্বাস্থ্যকর কোন উপাদান। কাপড়ের বিষাক্ত রং, মেয়দোত্তীর্ণ আটা, চিনি ও ফিটকিরি দিয়ে তৈরি করা হয় গুড়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার প্রত্যন্ত উজানচর গ্রামে এমনই এক ভেজাল গুড় তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। একই উপজেলায় ভেজাল ট্যাং তৈরির কারখানারও সন্ধান পেয়েছে প্রশাসন। দাম কম হওয়ায় এসব ভেজাল পণ্যে সয়লাব হয়ে উঠছে স্থানীয় বাজারগুলো। সাধারণ মানুষ মানহীন এসব পণ্য কিনে একদিকে যেমন প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতেও রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ভেজাল খাবারে কিডনি রোগসহ নানা রোগ বাসা বাঁধছে মানুষের শরীরে। অনুসন্ধানে জানা যায়, আসল গুড়ের শাস, মেয়াদোত্তীর্ণ আটা, চিনি ও কাপড়ের বিষাক্ত রং দিয়ে তৈরি করা হয় ভেজাল গুড়। অবিকল আসল গুড়ের মতো, তাই দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। বাজারে এক কেজি আসল গুড়ের মূল্য প্রকার ভেদে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা আর ভেজাল গুড় বিক্রি হয় ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। তুলনামূলক দাম কম হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে ভেজাল গুড়ের চাহিদাও বেশি। ফলে ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক হওয়ায় বাড়ছে এর উৎপাদনও। বাঞ্ছারামপুরের প্রত্যন্ত উজানচড় গ্রামের ভেজাল কারখানায় প্রতিদিন শত শত মণ গুড় উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত এসব ভেজাল গুড় কম দামে সরবরাহ করা হয় উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে। হাতে কলমে কুষ্টিয়া ও নাটোর থেকে এক শ্রেণীর গুড়ের পাইকার ভেজাল গুড় উৎপাদন প্রণালী শিক্ষা দেয়। গত ৩ বছর ধরে বাঞ্ছারামপুর ছাড়াও এসব ভেজাল গুড় জেলার নবীনগর উপজেলা এবং কুমিল্লা জেলার হোমনা, তিতাস, বুড়িচং ও দেবিদ্বার উপজেলার হাট বাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়। প্রতি মণ গুড়ে অর্ধেকের বেশি লাভ করে অসাধু ব্যবসায়ীরা। শুধু বাঞ্ছারামপুরেই নয়, জেলার বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের গুড়ের কারখানা রয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। সম্প্রতি বাঞ্ছারামপুরে ১০০ মণ ভেজাল গুড় জব্দ করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর পর ভেজাল গুড় কারখানার প্রধান হোতা রামপ্রসাদ সাহা ও অজিত কুমার সাহাকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। মুচলেকা দেন কখনও ভেজাল গুড় উৎপাদন না করার। গেল রমজান মাসে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সদরের রেজিস্ট্রি অফিসের পাশে একটি ভেজাল ট্যাং তৈরির কারখানায় অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। ওই কারখানায় বিষাক্ত কাপড়ের রং ও ফ্লেভার মিশিয়ে ভেজাল ট্যাং তৈরি করা হতো। অভিযানে কারখানার দুইজন কর্মচারীকে আটকও করা হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, বাজারের মেয়াদোত্তীর্ণ আটা, চিনি, ফ্লাডি পাউডার, ভিনেগার, কাপড়ের বিশাক্ত রং মিশিয়ে ও বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশিয়ে উৎপাদন করা হতো ভেজাল ট্যাং। উপজেলার পৌর এলাকার স্টিল ব্রিজ এলাকায় অবৈধ ট্যাং কারখানা গড়ে তোলা হয়। জামাল মিয়ার বাড়িতে বছরের পর বছর ধরে বিক্রি করা হয় ভেজাল ট্যাং। নাম পরিবর্তন করে ক্রেতাদের ঠকানো হয়। অবিকল ট্যাংয়ের মতো এসব ভেজাল ট্যাং ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। বিএসটিআইয়ের ভুয়া সীল রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত ২ মণ র-ম্যাটেরিয়ালস (উপকরণ) ও বিপুল পরিমাণ প্যাকেটসহ ৫ মণ ট্যাং জব্দ করে। অভিযান পরিচালনাকারী বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, বাঞ্ছারামপুরে দীর্ঘদিন ধরে খাদ্য ভেজালকারী চক্র এভাবে গুড় ও ট্যাং উৎপাদন করে সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে আসছিল। তাদের শনাক্ত করে অভিযানের পর নিজেরাই স্বীকার করে মানুষকে ঠকানোর নানা কৌশল। মূলত ভেজাল খাবারে সমাহার ঘটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ভেজালে সয়লাভ। হরহামেশাই বিক্রি হচ্ছে ভেজাল খাবার। ভেজালের ঘটনা এখানেই শেষ নয়। নরসিংদীর কাপড়ের রং দিয়ে মিষ্টির দোকানে বিশেষ মিষ্টির রং দেয়া হয়। প্রস্তুত করা হয় সুস্বাধু বুরিন্দা। জেলার রাধিকা, নাসিরনগর, বাঞ্ছারামপুর ও নবীনগরসহ বিভিন্ন স্থানে ভেজাল মিশ্রিত খাদ্য বিক্রি হচ্ছে বলে অনুসন্ধানে সূত্রগুলো জানায়। এদিকে, জেলার নাসিরনগরে পোড়া মোবিল দিয়ে জিলাপি বানানোর সময় এক দোকানিকে জরিমানা করেছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রট। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের মেডিসিন কনসালটেন্ট ফায়জুর রহমান ফায়েজ বলেন, ভেজাল খাবার খেলে কিডনির সমস্যা লিভার সিরোসিস, জন্ডিস এবং ক্যানসারের মতো মরণব্যাধি রোগ দেখা দিতে পারে। শিশুদের শ্বাসকষ্ট, বমি হওয়, চর্মরোগ, শরীরে দ্রুত পানি চলে আসাসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, প্রশাসনের ভেজাল বিরোধী কার্যক্রম যথেষ্ট নয়। তাই বাড়ছে ভেজালকারীদের উলম্ফন। গ্রাম-গঞ্জের হাট বাজারগুলো মনিটরিং না থাকায় দিন দিন বাড়ছে ভেজাল কারখানার সংখ্যা। ব্যাঙের ছাতার মতো ভেজাল পণ্য ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে। গড়ে উঠছে বিস্কুট ফ্যাক্টরি। জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রশাসনের নিয়মিত কাজের ফাঁকেই ভেজাল কারখানার ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়ার কাজ চলমান। সোর্স লাগিয়ে যাচাই-বাছাই ও শনাক্ত করা হচ্ছে। এরপরই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে। তিনি দাবি করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে পরিচালিত মোবাইল কোর্টে জনজীবনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। গত এক মাসে অন্তত ৫শ’ লোককে ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় ভেজাল পণ্যসহ মেয়াদ উত্তীর্ণ খাদ্যসামগ্রী গুদামজাত রাখায় জরিমানা করা হয়। কারাদ- দেয়া হয়েছে ১১ জনকে। ওই সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রায় সাড়ে ২১ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে। এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাসে রেকর্ড বলে স্বীকার করেন জেলা প্রশাসক।
×