ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিবাদী নুসরাত ওদের মুখোশ উন্মোচন করেছে

প্রকাশিত: ০৮:৪৮, ২৯ এপ্রিল ২০১৯

প্রতিবাদী নুসরাত ওদের মুখোশ উন্মোচন করেছে

সারাদেশ শোকার্ত, প্রতিবাদে সোচ্চার এবং এক মাদ্রাসা শিক্ষকের লালসার আগুনে। দেশবাসী নিহত নুসরাতের হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে উচ্চকণ্ঠ। সবকিছুর পর বাস্তবতা হচ্ছে, চারজন তরুণী কিংবা তরুণ তাদেরই বয়সী একজন তরুণীকে নিজেদের হাতে বেঁধে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়ে হত্যা করেছে! এবং প্রকাশ্য দিবালোকে? এদের এই যুগের আলবদর ছাড়া আর কি নাম দেব? কেননা এদের হুকুমদাতা ধর্ষক তো জামায়াতের নেতা যে ব্যক্তি একের পর ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি করাকে তার ‘অধিকার’ গণ্য করে! উপরন্তু, সে দুর্নীতিবাজও! প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্নীতির জন্য যার জেল হয় সে কি আবার চাকরিতে বহাল হয়? মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, স্থানীয় মাদ্রাসাটির পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান, সদস্যরাই বা তাকে আবারও অধ্যক্ষ পদে বহাল করল কেন? আশ্চর্য হলেও সত্য, নুসরাতের প্রতিবাদী চরিত্র দেশের সাধারণ শিক্ষার স্কুল, কলেজে সচরাচর দেখা যায় না। অথচ মাদ্রাসার ছাত্রীটি তার নিজ শিক্ষকের বিরুদ্ধে নিজে থানায় গিয়ে প্রতিবাদ করে মামলা দিতে গিয়ে ওসির কাছ থেকে পেয়েছে অসহযোগিতা এবং অবমাননাকর আচরণ। যেখানে ওসির প্রথম কাজ ছিল- মামলার অভিযোগ লিখে নেয়া। যা ওসির নিজের কন্যা হলে সে তো অবশ্যই ওই মোল্লাকে ছাড় দিত না। এসপির ক্ষেত্রেও একই নিষ্ক্রিয়তা কেন লক্ষ্য করা গেল? সারাদেশে প্রায়শই শিশুকন্যা, কিশোরী, তরুণী, সন্তানের মা ধর্ষিত হওয়ার কথা শোনা যায়। কোন কোন ধর্ষিতাকে মারধরের পর কেরোসিন দিয়ে আগুন লাগানো হচ্ছে- যে বর্বরতা খান সেনাদের বর্বরতার চেয়েও কোন অংশে কম নয়! ফেসবুকে কোন যুবকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে কোন তরুণী বা কিশোরী যুবকের কথামতো কোন স্থানে দেখা করতে এসে কোন নির্জন বাড়িতে বা জঙ্গলে গ্যাং রেপ-এর শিকার হয়ে অনেকেই খুন হচ্ছে, কেউ কেউ সম্ভ্রম হারিয়ে প্রাণে বেঁচেছে! আর, প্রতিবেশী বয়স্ক পুরুষ পাশের বাড়ির শিশুকন্যাকে লজেন্সের লোভ দেখিয়ে খালি ঘরে এনে ধর্ষণ করছে- এমন ঘটনাও ঘটছে! এসব ঘটনার মামলা হয়, অপরাধী গ্রেফতার হয়, আবার দ্রুত জামিনে বের হয়ে মামলা তুলে নেয়ার হুমকিও দেয়ার কথাও শোনা যায়। এসব ধর্ষিতার পক্ষে নুসরাতই যথাযোগ্য প্রতিবাদী। এবং ধর্ষকের বর্বর পরিকল্পনার ফাঁদে পড়ে নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়! আমরা চাচ্ছি গ্রাম-মফস্বল থেকে ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করে দেশের উন্নয়নের নানা ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে আসবে। সরকারের বিপুল কর্মযজ্ঞ- বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, বিপুল সংখ্যক শিক্ষাবৃত্তি গরিবের ছেলে-মেয়েকে স্কুলে, কলেজে পড়তে সাহায্য করছে, যার ফল হিসাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে এবং বড় একটি অংশ পাস করছে। তবে, মানসম্মত শিক্ষা দিতে এখনও আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। এখানে সরকারকে নানারকম বিকল্প চিন্তা, কৌশল উদ্ভাবন করে শিক্ষার্থীদের জনসম্পদে পরিণত হবার সুযোগ করে দিতে হবে, যার কোন বিকল্প নেই। যা হোক, নুসরাতের প্রসঙ্গে প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে- সোনাগাজীর সংসদ সদস্য বা জনপ্রতিনিধি কে এবং তাঁর ভোটারদের প্রতি তিনি কি দায়িত্ব পালন করেছেন? দিন কিন্তু পাল্টে গেছে, ভোটের আগে দেয়া প্রতিশ্রুতি, জনপ্রতিনিধির কাছে জনগণের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত কতটা হয়েছে তা দেখা উচিত। তবে নারী নিগ্রহের বিচার ও আইনের প্রতি সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে নুসরাত। যার জন্য নারী সমাজ গর্বিত। একইসঙ্গে এসব ঘটনা আরও অনেক সত্যকে উদ্ঘাটন করেছে, যেমন- বোরকা-হিজাব নারীকে সুরক্ষা দেয় না বরং খুনীরাও বোরকা-হিজাবে মুখ বেঁধে আগুন লাগিয়ে মানুষ খুন করতে পারে। ধারণা ছিল এতে খুনীদের পরিচয় বের করা কিছুটা কষ্টসাধ্য হবে ভেবে। যদিও, এ মামলায় নুসরাত মামলা তুলতে সম্মত না হলে, ওকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার কাজটি করতে নির্দেশিত হয়েছিল তাদের নাম, পরিচয়, অবশ্যই ধর্ষক খুনী সিরাজ উদ্দৌলা এবং তার সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া সহযোগী শিক্ষক ও ছাত্র রিমান্ডে বলে দিতে পারবে। এমন কি যারা এই লম্পট অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করার জন্য মানববন্ধন করেছিল, তারাও খুনী। বর্তমানে সব খুনী, খুনের সহযোগী, পরিকল্পক, অর্থদাতা-সবার নাম উদ্ঘাটিত হয়েছে। সরকার এই ধর্ষক ও সব খুনী, সহযোগীদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার সম্পন্ন করে সর্বোচ্চ দন্ড দেবে- এটা সবার বিশ্বাস। শুধু নুসরাত নয়, আরও শত শত শিশু, বালিকা, তরুণী ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় কিন্তু সরকারকে ন্যায় বিচারের প্রমাণ দিতে হবে। শেষপর্যন্ত ধর্ষক খুনীরা প্রাণে বেঁচে থাকবে, কয়েক বছর জেল খেটে বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে, তা যেন না হয়, জনগণ এটি পর্যবেক্ষণ করবে। হাইকোর্টও পর্যবেক্ষণ করবে। মাদ্রাসায় ছাত্রী ধর্ষণের কথা বহুকাল আগে থেকে শুনেছি। বর্তমানে ছেলে-মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি, তার মধ্যে দু’চারটি দুঃসাহসী কন্যা প্রতিবাদ করছে যার জন্য কিছু তথ্য যা আগে গোপন থাকত, সেসব প্রকাশ পাচ্ছে। স্কুল কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা শুনিনি, তার একটা কারণ সম্ভবত মেয়েরা মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের স্কুলে-কলেজে পড়েছে, যেখানে শিক্ষক অধিকাংশ মহিলা। ছেলে-মেয়েতে প্রেম হয়েছে, কিন্তু ধর্ষণের ঘটনা শহরাঞ্চলে খুব বেশি শোনা যায়নি। তবে, বর্তমান ফেসবুক, মোবাইল, ব্লু-ফিল্ম, ইয়াবা, মাদক সেবনের হার বেড়ে যাওয়ার একটা বড় প্রতিক্রিয়া সমাজের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্যকে বদলে দিয়েছে, সুবিধার পাশে অনেক মন্দ বৈশিষ্ট্য নিয়ে এসেছে, এটা মানতে হবে। তবে, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী ও শিশুর প্রতি মমত্ববোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করার পরিকল্পিত কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। এখন সময় এসেছে, সারাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে একমুখী, এক ধারার করার। এক রকম লেখাপড়া করার সুযোগ, খেলাধুলা, প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশ নেয়া। এতেই দেশ ও জাতি দ্রুত উন্নত হবে, ধর্ষণ ও ধর্ষককে ঘৃণা করতে শিখবে। মাদ্রাসার অভ্যন্তরে নকলের মহোৎসব চলে সেটা সবার জানা। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কও এসব সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা দ্বারা আচ্ছাদিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। এরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হচ্ছে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান-বিজ্ঞান-সমাজ চিন্তায়, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের চর্চা বন্ধ হয়ে যাবে এবং প্রগতিশীল বিজ্ঞান মনস্ক নারী-পুরুষ ও অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি সহনশীল গ্র্যাজুয়েট তো পাওয়া যাবে না। সকল মাদ্রাসায় সাধারণ স্কুলের পাঠ্য বিষয়বস্তু, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া, জাতীয় পতাকা উত্তোলন বাধ্যতামূলক করে ধর্ম শিক্ষার বাংলা বই চালু করা। শুধু নুসরাত হত্যাকারী একজন সিরাজ মোল্লা নয়। এমন দানব হাজার হাজার জন্ম নিচ্ছে। এতে শুধু নারী, শিশু, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, শিয়া, আহমদীয়া, লালন ভক্ত, সংস্কৃতি সাহিত্যসেবীরাই আক্রান্ত হবে না, জাতি তার অসাম্প্রদায়িক চারিত্র হারিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রশ্ন উঠেছে, ওই ধর্ষক সিরাজের হাতে হাতকড়া ছিল না কেন? যেখানে সাংবাদিক বা অন্য পেশার মানুষকে গ্রেফতার করলে হাতকড়া লাগাতে দেখা গেছে। তাছাড়া আহমদীয়া জামায়াতের বার্ষিক সম্মেলন হচ্ছে না কেন? হামলাকারী হেফাজতপন্থী খতমে নবুয়ত সন্ত্রাসীর দল গ্রেফতার হচ্ছে না কেন? এ ঘটনা তো আমাদের প্রিয় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সংঘটিত হতে পারে না। তাছাড়া কোন ধর্মমতাবলম্বী তার ধর্ম পালন করতে না পারলে যে সুশাসনের এবং ন্যায় বিচারের অভাব ঘটে তার ফলে রাষ্ট্র কোন মতেই উন্নত রাষ্ট্র হতে পারে না। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×