ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

নিহত বেড়ে ৩৫৯, কলম্বোয় সিনেমা হলের কাছে বিস্ফোরণ

শ্রীলঙ্কায় আইজি ও প্রতিরক্ষা সচিবকে পদত্যাগের নির্দেশ

প্রকাশিত: ১১:০০, ২৫ এপ্রিল ২০১৯

শ্রীলঙ্কায় আইজি ও প্রতিরক্ষা সচিবকে পদত্যাগের নির্দেশ

জুয়েল হাসান ॥ রবিবার খ্রীস্টানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ইস্টার সানডে উপলক্ষে শ্রীলঙ্কার কয়েকটি চার্চ ও হোটেলে একযোগে চালানো আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৫৯-এ দাঁড়িয়েছে। বুধবার শ্রীলঙ্কা পুলিশের মুখপাত্র রুয়ান গুনাসেকেরা নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধির কথা প্রকাশ করেন। তবে বিস্তারিত আর কিছু জানাননি তিনি। হামলায় অংশ নেয়া ৯ আত্মঘাতীর একজন ছিলেন নারী। রবিবারের বর্বর হামলার পরও দেশটিতে থেমে নেই বিস্ফোরণের ঘটনা। বুধবার কলম্বোর একটি সিনেমা হলের কাছে নতুন করে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। রবিবারের বোমা হামলার ব্যর্থতায় দেশটির পুলিশের আইজি ও প্রতিরক্ষা সচিবকে গ্রেফতারের দাবি ও বড় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য লুকানোর অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায় প্রেসিডেন্ট তাদের পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন বলেছেন, ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে হামলার প্রতিশোধ নিতে শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডেতে হামলা চালানো হয়েছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, এর স্বপক্ষে তাদের কাছে কোন গোয়েন্দা তথ্য নেই। রবিবার ইস্টার সানডের দিন দেশটির তিনটি গির্জা ও চারটি হোটেলে আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়। মঙ্গলবার পর্যন্ত নিহত ৩২১ ও আহত ৫ শতাধিক ছিল। মঙ্গলবার এ হামলার দায় স্বীকার করে জঙ্গীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) । আইএসের বার্তা সংস্থা আমাক সাত জঙ্গীর নাম প্রকাশ করে এরাই আত্মঘাতী হামলাগুলো চালিয়েছে বলে জানিয়েছে। গোষ্ঠীটি নিজেদের দাবির পক্ষে কোন প্রমাণ দেয়নি। তাদের দাবি যদি সত্য হয়ে থাকে তবে ইরাক ও সিরিয়ার বাইরে তাদের চালানো অন্যতম সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা হবে এটি। মঙ্গলবার রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ‘২৪ ঘণ্টার মধ্য’ প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানদের পরিবর্তন করার ঘোষণা দেন। তিনি জানিয়েছেন, হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করে প্রতিবেদন দেয়া হলেও সেগুলো তার সঙ্গে শেয়ার করা হয়নি, কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ‘কঠোর পদক্ষেপ’ নেয়ার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বিদেশী একটি রাষ্ট্রের কাজ থেকে গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়ার পরও সেটি আমাকে জানাননি। এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বলেন তিনি। এক সংবাদ সম্মেলনে অপরাধীদের শনাক্ত করার পথে তদন্তের অগ্রগতি হওয়ার কথা জানিয়েছেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। আমরা আইএসের দাবি খতিয়ে দেখব, আমাদের বিশ্বাস সম্ভবত কিছু সম্পর্ক আছে, বলেছেন তিনি। ৯ আত্মঘাতী হামলাকারীর একজন নারী ॥ শ্রীলঙ্কার কয়েকটি চার্চ ও হোটেলে একযোগে চালানো বোমা হামলায় নয় আত্মঘাতী অংশ নিয়েছে এবং তাদের একজন নারী ছিল বলে জানিয়েছেন দেশটির একজন মন্ত্রী। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে দেশটির প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী রাভন বিজয়বর্ধনে এসব কথা জানান। হামলাকারীদের মধ্যে আট জনকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। শাংগ্রিলা হোটেলে আত্মঘাতী হামলা স্থানীয় কট্টরপন্থী ইসলামী গোষ্ঠীর নেতা চালিয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজয়বর্ধনে। হামলাকারীদের একজন যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করেছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। তিনি আরও জানান, নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৫৯ জনে দাঁড়িয়েছে এবং এদের মধ্যে ৩৯ বিদেশী। রবিবারের ওই বোমা হামলায় জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ৬০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। কলম্বোয় নতুন বিস্ফোরণের খবর ॥ শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর জনপ্রিয় স্যাভয় সিনেমার কাছে একটি বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। বুধবার শ্রীলঙ্কা পুলিশ ওই সিনেমা হলের কাছে একটি নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটানোর কথা জানিয়েছে। স্যাভয় সিনেমার কাছে রাখা একটি সন্দেহজনক মোটরবাইক পরীক্ষা করার পদক্ষেপ নেয় পুলিশ। মোটরবাইকটির আসন খুলতে একটি নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে বলে পুলিশের গণমাধ্যম ইউনিট জানিয়েছে। মোটরস্কুটারটিতে কোন বিস্ফোরক ছিল না বলে পরে জানিয়েছে পুলিশ। যেভাবে আগাম তথ্য পেয়েছিল ভারত ॥ ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় সিরিজ বিস্ফোরণের আগে এ হামলার বিষয়ে দফায় দফায় দেশটিকে সতর্ক করেছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা। আর ভারতীয় গোয়েন্দাদের প্রাপ্ত তথ্যের অন্যতম উৎস ছিল সন্দেহভাজন এক হামলাকারীর সম্পর্কে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত। নিজেদের হাতে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই বার বার লঙ্কান কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে দেয় দিল্লী। যদিও শেষ পর্যন্ত এসব গোয়েন্দা সতর্কতা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয় শ্রীলঙ্কা। কলম্বোয় নতুন করে বোমা উদ্ধার ॥ ভয়াবহ সিরিজ বোমা হামলার তিনদিন পর শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় নতুন করে বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয় সময় বুুধবার বিকেলে কলম্বো থেকে একটি বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে রবিবারের হামলাই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ সিরিজ বোমা হামলা। পুলিশের আইজিকে গ্রেফতারের দাবি ॥ গির্জা এবং হোটেলে ভয়াবহ জঙ্গী হামলায় ৩৫৯ জনের প্রাণহানির ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার দায়ে শ্রীলঙ্কা পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) পুজিথ জয়সুন্দরকে গ্রেফতারের দাবি উঠেছে। দেশটির এক সংসদ সদস্য প্রেসিডেন্টের কাছে লেখা এক চিঠিতে এই দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, হামলার সম্ভাব্য গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়ার পর উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেয়ায় পুলিশের আইজি জয়সুন্দর ও প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি হেমাসিরি ফার্নান্দোকে দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তারা উভয়ই দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করেছেন। তাদের দু’জনকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। হামলাকারীরা পড়াশোনা করেছেন অস্ট্রেলিয়া-ব্রিটেনে ॥ রবিবার ইস্টার সানডে উদযাপনের সময় গির্জা ও হোটেলে ভয়াবহ বোমা হামলার ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে একজন অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রিটেনে পড়াশোনা করেছেন। তারা সচ্ছল পরিবারের সন্তান। আইএসের কর্মকা- থেকে উৎসাহিত হয়ে এবং জঙ্গীদের অর্থায়নে এই হামলা চালানো হয়েছে। আত্মঘাতী হামলাকারীদের বেশিরভাগেরই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল, কেউ কেউ বিদেশে বসবাস করছিল বা সেখানে পড়াশোনা করেছে বলে নিশ্চিত করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রুয়ান উইজেওয়ারডেন। আত্মঘাতী হামলাকারীদের দলটির বেশিরভাগই শিক্ষিত এবং তারা মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের। তারা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল এবং তাদের পারিবারিক অবস্থাও ভাল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটা একটি চিন্তার বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। মরদেহ চিনতে জুতাই সম্বল ॥ রবিবার ইস্টার সানডে উদযাপনের সময় গির্জা ও হোটেলে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় নিহতের সংখ্যা সাড়ে তিন শ’ ছাড়িয়ে গেছে। এ ঘটনার পর থেকে এখনও যাদের সন্ধান মেলেনি তাদের স্বজনরা ভিড় করছেন কলম্বোর ন্যাশনাল হাসপাতাল মর্গে। কারণ শনাক্ত না হওয়া মরদেহগুলো এখানেই রয়েছে। মর্গের দরজা খুলে বেরিয়ে সামনের টেবিলে রাখা ল্যাপটপ খুলে বসেন চিকিৎসক। এ সময় তাকে ঘিরে কিছুটা ভিড় সৃষ্টি হয় মর্গের সামনে। সবার দৃষ্টি ল্যাপটপের মনিটরে। তাতে একের পর এক নিহতের মুখ ফুটে ওঠে। তবে সেগুলো মুখ বললে ভুল হবে। দলা পাকানো দেহ, তাল তাল রক্ত মাখা মাংসপি-ের মাঝে কে যে কার প্রিয়জন, তা চেনাই দুষ্কর। এদিকে বিস্ফোরণে নিহত ও নিখোঁজদের তালিকা তৈরিতে সরকারের পাশাপাশি মাঠে নেমেছে কলম্বোর ক্যাথলিক সংগঠনগুলোও। সোমবার কলম্বোর বিভিন্ন সরকারী হাসপাতাল ঘুরে দেখেছেন দেশটির আর্চবিশপ শেলটন ডায়াস। তিনি বলেন, প্রতিটা মরদেহ এতটাই বিকৃত যে, চেনা যাচ্ছিল না। জুতা ছাড়া বাচ্চাগুলোর নরম শরীরের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সন্ত্রাস এমনই নির্মম।
×