ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

হতাহতদের পরিবার এখনও বিচারের অপেক্ষায়

প্রকাশিত: ১১:০৯, ২৪ এপ্রিল ২০১৯

হতাহতদের পরিবার এখনও বিচারের অপেক্ষায়

রহিম শেখ ॥ দীর্ঘদিনেও বিচার শেষ হয়নি রানা প্লাজার ভবন ধসের মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনার। সহস্রাধিক মানুষ হত্যার দায়ে ১৪ মামলা হলেও একটি মাত্র মামলায় ভবন মালিক রানার সাজা হয়। ৪১ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশীট দেয়া হলেও বর্তমানে রানার পরিবারের সদস্য, সাভারের জনপ্রতিনিধি, প্রকৌশলী, কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সবাই আছেন জামিনে। কিন্তু যারা ওই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারের খোঁজ কেউ রাখে না। বিচারের অপেক্ষায় এখনও প্রহর গুনে সেসব পরিবার। যেন অনেকটা বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে দেশের শিল্প ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনায় এখনও আহতদের আহাজারি বাতাসে ভাসে। এ মামলায় হতাহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণে হাইকোর্ট যে কমিটি করে দিয়েছিল, কমিটির সেই রিপোর্ট চূড়ান্ত হলেও শুনানিই শুরুই হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে, এ ধরনের অবহেলায় মৃত্যুমিছিল কোনভাবেই থামানো যাবে না। সাভারের রানা প্লাজা ধসের মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনার ছয় বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে আজ বুধবার। ওই ঘটনায় পাঁচটি পোশাক কারখানার শ্রমিকসহ এক হাজার ১৩৬ শ্রমিক-কর্মচারী নিহত হন। আহত হন আরও কয়েক হাজার। এদের অনেকেই সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। রানা প্লাজা ধসের পর সেই ভবনের যারা বেঁচে আছেন তাদের অর্ধেকেরও বেশি আহত শ্রমিক এখনও দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। সেদিনের সেই দুর্ঘটনায় যারা বেঁচে ফিরেছেন তাদের মধ্যে ২০ দশমিক ৫০ শতাংশের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ৫১ শতাংশ শ্রমিক এখনও বেকার রয়ে গেছেন। এই কাজ করতে না পারাদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ শারীরিক দুর্বলতা এবং ২৭ শতাংশ মানসিক দুর্বলতার কারণে কাজ করতে পারছেন না। ভুক্তভোগীরা বলছেন, প্রতিবছর ২৪ এপ্রিল এলেই এ নিয়ে আলোচনা হয়। তারপরও আর কেউ খবর রাখে না। এ ঘটনার পর নানা অভিযোগে মামলা হয়েছে মোট ১৪টি। এর মধ্যে রয়েছে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ, রাজউকের করা ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন, নিহত একজন পোশাক শ্রমিকের স্ত্রীর করা খুনের মামলা এবং পুলিশের করা কয়েকটি মামলা। এসব মামলার মূল আসামি ভবন মালিক সোহেল রানা। সে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকলেও অন্য আসামিরা এখন জামিনে মুক্ত। মামলাগুলোতে বিভিন্ন সময়ে রানা ও তার পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও সাভারের জনপ্রতিনিধি, প্রকৌশলী, গার্মেন্টস মালিক ও কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতরের কর্মকর্তাদের জেলে যেতে হলেও বর্তমানে তারা জামিনে আছেন। এর আগে ওই দুর্ঘটনার দুই বছর এক মাস পর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৫৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে দুই মামলায় চার্জশীট দেয়া হয়। ২০১৬ সালের জুন ও জুলাইয়ে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চার্জ গঠন হলেও উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন ২১ অভিযুক্ত। তবে ওই হত্যা মামলায় স্থগিতাদেশের মেয়াদ হয়েছে গত বছরের ১২ মে। এদিকে সাভারে ধসে পড়া বহুল আলোচিত রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়েছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে মামলাটির বিচার ছয় মাসের মধ্যে শেষ করতে বিচারিক আদালতকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। চলতি মাসের ৯ এপ্রিল বিচারপতি মোঃ নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলমের বেঞ্চ জামিন প্রশ্নে জারি করা রুল খারিজ করে এ রায় দেয়। আদালতে অভিযোগপত্র দিলেও বিচারের ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি নেই বলে দাবি করেছেন গার্মেন্টস এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আক্তার। তিনি বলেছেন, ৪১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয়া হয়েছিল যাদের মধ্যে দু’জন মারা গেছেন। আমরা দেখলাম, ছয় বছরেও সহ¯্রাধিক মানুষ হত্যার দায়ে কারো শাস্তি হলো না। তাহলে কি ধরে নিতে হবেÑ বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে? দেশের শিল্প ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনায় এখনও আহতদের আহাজারি বাতাসে ভাসে। এখনও পঙ্গু জীবনযাপন করা মানুষগুলোর কান্না শোনা যায়। এত কিছুর পরও আমরা মনে করি, এই ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে, এ ধরনের অবহেলায় মৃত্যুমিছিল থামানো যাবে না। যতদ্রুত সম্ভব, বিচার কাজ শেষ করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হোক, এটাই আমাদের চাওয়া। এদিকে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের মধ্যে ২০ দশমিক ৫০ শতাংশের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ ছাড়া শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতার কারণে ৫১ শতাংশ আহত শ্রমিক কাজ করতে পারছেন না। এই কাজ করতে না পারাদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ শারীরিক দুর্বলতা এবং ২৭ শতাংশ মানসিক দুর্বলতার কারণে কাজ করতে পারছেন না। সম্প্রতি প্রকাশিত এ্যাকশন এইড বাংলাদেশের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গত বছরের ২২ দশমিক ৫ শতাংশের বিপরীতে এ বছর বিপর্যস্তদের হার ১০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। বর্তমানে ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ জীবিত শ্রমিক দাবি করেছেন, তারা কমবেশি স্থিতিশীল এবং ২১ শতাংশ পুরোপুরি আঘাত কাটিয়ে উঠেছেন। এতে দেখা যায়, ৪৯ শতাংশ আহত শ্রমিক বিভিন্ন ধরনের বেতনভুক্ত এবং স্বনির্ভর কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আর বাকি ৫১ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, তারা কোন কাজ করতে পারছেন না। ভবন ধসের পর নিহত ও আহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে একটি কমিটি গঠন করে দেয় উচ্চ আদালত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এম আকাশের নেতৃত্বের সেই কমিটি ক্ষতিপূরণের যে সুপারিশ দিয়েছিল, তার শুনানি এখনও শুরু হয়নি। তাই অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গেই কমিটির প্রধান বললেন, এই ঘটনার মীমাংসা হোক, এটা কেউ চায় না। তাই এ দশা। এদিকে হতাহতের ক্ষতিপূরণের জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে মিলে আইএলওর নেতৃত্বে ৩০ মিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেয়া (৩২০ কোটি টাকা) হয়। সেখানে প্রায় ২৪ মিলিয়ন ডলার জমা পড়ে। অর্থাৎ এখনও ঘাটতি আছে প্রায় ৬ মিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেন সূত্রে জানা যায়, রানা প্লাজার পাঁচ কারখানায় পোশাক তৈরি করত এমন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৯। এর মধ্যে ১৬ প্রতিষ্ঠান তহবিলে অর্থ দেয়নি। আর যেসব ক্রেতা প্রতিষ্ঠান দিয়েছে, তাদের বেশিরভাগেরই অল্প পরিমাণে। একমাত্র ব্যতিক্রম প্রাইমার্ক, ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রতিষ্ঠানটি দিচ্ছে ৯০ লাখ ডলার। এই অর্থ দিয়ে রানা প্লাজার দ্বিতীয় তলায় থাকা নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেডের ৫৮০ শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের আহ্বায়ক হামিদা হোসেন বলেন, শ্রমিকরা এখনও ক্ষতিপূরণ পায়নি, এটা সত্য ও সঠিক। হাইকোর্ট একটি প্যানেল গঠনের মাধ্যমে শ্রমিকরা কে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার স্কেল তৈরি করে। কিন্তু এরপর আর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এটা কোনভাবেই ঠিক নয়। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ছয় বছরেও দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া যায়নি। প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের সময় সম্ভবত আমরা পার করে ফেলেছি। আহত শ্রমিকদের ভেঙ্গে ভেঙ্গে সহযোগিতা করা হয়েছে, যেটা তাদেরও কাজে আসেনি। যে হিসাব করে শ্রমিকদের টাকা দেয়া হয়েছে তা খুবই সামান্য। সমস্যা হলো, আহত শ্রমিকদের ক্ষতির পরিমাণ ঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ড. আনোয়ার উল্লাহ্ বলেন, এটা ঠিক যে, দুর্ঘটনার পর সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একত্রে কাজ করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা ছিল এবং আছে। সমস্যা আছে পরিকল্পনায়। আর রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্তদের যে ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে তা পর্যাপ্ত কি-না, চিন্তার বিষয়। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৮টা। সাভারের নয়তলা ভবন রানা প্লাজার পাঁচটি কারখানার শ্রমিকরা দলবেঁধে প্রবেশ করছেন। যে যার মতো করে কাজে যোগ দিচ্ছেন। তখনও তারা জানতেন না কী ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। সকাল সাড়ে ৮টায় একযোগে চালু করা হয় ডজনখানেক জেনারেটর। কেঁপে ওঠে নয়তলা ভবনটি। এর কিছুক্ষণের মধ্যে বিশাল এ ভবনটি ধসে পড়ে। হাজারখানেক শ্রমিক প্রাণ হারায় ঘটনাস্থলেই। ভবনে আটকেপড়া ও হাসপাতালে মারা যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা গিয়ে দাঁঁড়ায় ১ হাজার ১৩৬ জনে।
×